বন্দর প্রশ্নে বামপন্থিদের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচির তাৎপর্য
Published: 26th, June 2025 GMT
গত বছরের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানে তখনকার সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন শামিল হয়েছিল– এ সত্য সবাই মানেন। ডানপন্থিদের সঙ্গে বামপন্থিরাও ছিলেন সমতালে। তবে এটাও সত্য, সে অভ্যুত্থানে ব্যাপক প্রাধান্য ছিল বিশেষ রাজনৈতিক মত ও পথের। সত্যটা অভ্যুত্থানের গোড়ার দিকে অনেকটা অস্পষ্ট থাকলেও, দিন দিন তা স্পষ্টতর হচ্ছে।
এই বিশেষ মত ও পথের মানুষ মনে করেন, এ দেশে শুধু সমাজতন্ত্র অ্যালিয়েন নয়, সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতাও বিষবৎ পরিত্যাজ্য; অথচ এ দুটোই ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের ইশতেহারের প্রধান বিষয়। ওই বিশেষ ধারার মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঘোর বিরোধী, যদিও এই বাঙালি জাতীয়তাবাদই পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। মনে হতে পারে, এ দেশে শত শত বছর ধরে বসবাসরত আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠীগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণের প্রশ্নে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গায় নতুন কিছু বসাতে চান। কিন্তু না। তারা তা করছেন ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর মনে সুড়সুড়ি দিয়ে রাজনীতিতে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার স্বার্থে। আর গণতন্ত্র তারা মানেন বটে, তবে তা নিজেদের তৈরি সংজ্ঞা অনুসারে। স্বীয় মতের বাইরের সবকিছুই তাদের কাছে ধূসর বা ব্রাত্য। যে কারণে এখানে এখন যে কাউকে, এমনকি অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধাদেরও ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দেওয়া যায়।
এমন একটা পরিবেশে বামপন্থিরা, বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে যারা নিজেদের অংশীজন মনে করেন ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের, তাদের একা হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। বাস্তবেও তা দেখা যাচ্ছে, বিশেষত রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাগুলোতে। কমিশনের সভা চলছে গত কয়েক মাস ধরে; মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে। সেখানে অন্য অনেক ইস্যুর সঙ্গে সংবিধানের মূলনীতিও পরিবর্তনের কথা উঠেছে। অন্য সবাই যখন বিনা প্রশ্নে সেই পরিবর্তন প্রস্তাবে সায় দিয়েছে, তখন গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদকে সঙ্গে নিয়ে সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত কয়েকটি দল ভিন্নমত পোষণ করেছে। তাদের মত– প্রয়োজনে আরও দশটা বিষয় মূলনীতিতে যুক্ত করা যাবে, তবে বিদ্যমান চার মূলনীতি অটুট রাখতে হবে।
বুধবার, এই নিবন্ধ যখন লিখছি, ঐকমত্য কমিশনের যে সভা হলো, সেখানেও বিষয়টা উঠেছিল। বৈঠক শেষে অনুষ্ঠিত ব্রিফিং থেকে বোঝা গেল, মুক্তিযুদ্ধকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সেই সময়কার মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রেক্ষাপটে ধারণ করতে আগ্রহী ওই বাম ও উদার গণতন্ত্রী দলগুলোর সঙ্গে বিশেষত সংবিধানের মূলনীতির প্রশ্নে অন্যদের মিল হচ্ছে না। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ওই মূলনীতিগুলো তুলে দিতে চায়। আশঙ্কা বিস্তর, ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যতই সিদ্ধান্ত থাকুক, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধানের উক্ত চার মূলনীতি বিদ্যমানরূপে থাকছে না।
কেউ হয়তো ওই সংস্কার সভায় এ বাম দলগুলোর উপস্থিতিকে বলবেন হংস মাঝে বক যথা; কেউবা বলবেন বক মাঝে হংস যথা। তবে তাদের এ দৃঢ়তার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আবেগ-অনুভূতির ধারক কোটি কোটি মানুষের কাছে এ বাম দলগুলো যে শ্রদ্ধার আসন পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
শুধু সংবিধানের মূলনীতি প্রশ্নে নয়; নির্বাচনের সময় নিয়েও এ বাম দলগুলোকে এমন একা হয়ে যেতে হচ্ছে। সবার মনে থাকার কথা, গত ২০ এপ্রিল ঢাকায় বিএনপির চায়ের দাওয়াতে এসে সিপিবি ও বাসদ নেতারা ঐকমত্য পোষণ করেন– যে কোনো মূল্যে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে হবে। তখন সংবাদমাধ্যমে প্রচার পায়, বিএনপি ও বাম দলগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে প্রয়োজনে যুগপৎ ধারায় মাঠে নামবে। সম্ভবত এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টা গত ঈদুল আজহার আগের দিন তাঁর সর্বশেষ ভাষণে আগামী এপ্রিলে নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিলে বিএনপি ও উক্ত বাম দলগুলো প্রায় সমস্বরে অসন্তোষ জানায়। কিন্তু ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উভয় পক্ষ একমত– নির্বাচনটি হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে, রোজার আগে, যদিও সেখানে এ সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
অনেকের ধারণা ছিল, নির্বাচনী রাজনীতিতে সচরাচর দুর্বল বাম দলগুলো হয়তো এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে অনুসরণ করবে। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে তারা আগের অবস্থানই ধরে রাখে। বাম গণতান্ত্রিক জোট সভা করে বিবৃতি দেয়, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনটি করতে হবে। এ জন্য সংস্কার ও বিচার যতটুকু পারা যায় করতে হবে, তবে এ নিয়ে নির্বাচন পেছানো যাবে না।
গত জুলাই-আগস্টে বামপন্থিরা অন্যদের মতোই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। আরও স্পষ্ট করে বললে, কারও কারও চেয়ে ওই আন্দোলনে বামপন্থিদের ঝুঁকি একটু বেশিই ছিল। তারপরও অনেক প্রশ্নেই তাদের একা করে দেওয়ার প্রবণতা অন্যদের মাঝে খুবই দৃশ্যমান। তেমনই একটা বিষয় মিয়ানমারের রাখাইনে করিডোর এবং চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি ব্যবস্থাপানায় দেওয়ার সরকারি তৎপরতা।
কয়েক মাস আগে যখন সরকারের একাধিক ব্যক্তি এ দুটি বিষয়ের পক্ষে একেবারে প্রকাশ্য সভায় জোর সওয়াল শুরু করেন তখন বামপন্থিদের সঙ্গে অন্য অনেক দলই এর প্রতিবাদ করে। এমনকি বিএনপিও করিডোর ও বন্দর ব্যবস্থাপনার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই বলে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়। কিন্তু আজকে যখন সরকারকে ওই জাতীয় স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে মাঠের কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজন হচ্ছে, তখন এর আয়োজনে শুধু বাম দলগুলোকেই দেখা যাচ্ছে।
বাম দলগুলো রাখাইনে করিডোর বা প্যাসেজ প্রদান এবং চট্টগ্রামের নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার পরিকল্পনা বাতিলের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড মার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ২৭ জুন অর্থাৎ আগামীকাল জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে এ রোড মার্চ শুরু হবে; ২৮ জুন চট্টগ্রামে সমাবেশের মাধ্যমে তা শেষ হবে। ওই সময় দেশের সব জেলা-উপজেলায়ও সংহতি সমাবেশ ও পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। কর্মসূচি সফল করতে এরই মধ্যে প্রচুর গণসংযোগ ও সভা-সমাবেশ করেছে সংশ্লিষ্ট দল ও সংগঠনগুলো।
তবে যে কথা বিশেষভাবে বলার জন্য এ লেখার অবতারণা; এ কর্মসূচিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বাইরের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন অংশ নিচ্ছে। আগেও বলেছি, দেশের বামপন্থিরা প্রধানত দুই রাজনৈতিক জোট বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চায় এবং নাগরিক সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটিতে কাজ করছেন। এতদিন নানা ইস্যুতে সবাই মাঠে থাকলেও আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু আজকে যখন স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার প্রশ্ন সামনে এসেছে, তখন সবাই এক মঞ্চে দাঁড়াচ্ছেন। আগামী দিনে ভোটাধিকারসহ অন্যান্য গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার রক্ষায়ও যখন তারা একসঙ্গে লড়বেন তা যে বর্তমান বিশৃঙ্খল রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখাবে, এতে সন্দেহ নেই।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ব ম গণত ন ত র ক জ ট ব মপন থ র ব ম দলগ ল র জন ত ক ঐকমত য ব এনপ স গঠন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদে নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি। ৬৭টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম এই কমিটি আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে প্রত্যাখ্যানের কথা জানায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে মনোনয়নের মাধ্যমে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত ৫০টি সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সংরক্ষিত নারী আসনসংখ্যা বাড়ানো ও সেসব আসনে সরাসরি নির্বাচনব্যবস্থা চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে নারী সংগঠনগুলো। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করলেও এ বিষয়ে একমত হয়নি দলগুলো। এ অবস্থায় নারী আসন নিয়ে আগের ব্যবস্থাই বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।
সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির পক্ষে আজ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেমের সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে সমান অধিকার, সমমর্যাদা ও দায়িত্বের সঙ্গে ভূমিকা পালন করতে বাংলাদেশের নারীরা এখন প্রস্তুত রয়েছেন। সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে এলে গণতান্ত্রিক চর্চা আরও শক্তিশালী হবে, যা নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে আরও বিস্তৃত ও অর্থবহ করে তুলবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নারী সমাজের দীর্ঘদিনের এই আন্দোলন ও দাবিকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্তে কীভাবে একমত হলো, সে বিষয়েও সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীর বিস্ময় প্রকাশ করছে।
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, জাতীয় সংসদের সাধারণ আসনে নারী–পুরুষ উভয়ই নির্বাচন করতে পারবেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনও থাকবে। জাতীয় সংসদে মোট আসনসংখ্যা ৪৫০ করতে হবে, যেখানে ৩০০ সাধারণ আসন ও ১৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন হবে। সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের প্রথা বাতিল করে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ ব্যবস্থাটি দুই থেকে তিন মেয়াদের জন্য বলবৎ থাকবে।
বিবৃতিতে নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার দাবি জানানো হয়।