সফল জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে অনেক বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এই সফলতাকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ বলেছেন দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র, কেউ বলেছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা, আবার কেউ বলেছেন একাত্তরের স্বাধীনতার ‘রিসেট’। কিন্তু জনগণের আদালতে এর কোনোটাই টেকেনি। যেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হলো দেশের ছাত্রসমাজ ও জনগোষ্ঠী ১৫ বছর জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা একটা ফ্যাসিবাদী সরকারকে হটিয়ে দিয়েছে। এখন চেষ্টা হচ্ছে একটা নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার রূপরেখা নির্ণয়ন করতে। এ চেষ্টা কতটুকু সফল হবে কিংবা আদৌ সফল হবে কি না, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তবু জনগণ আশান্বিত।

আশা করা হয়েছিল, এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ দেশের শাসকেরা নিজেদের মাথায় নিজেরা মুকুট দেওয়া বন্ধ করবেন। নিজেদের অভিষেককে অলংকৃত করতে আমরা বিগত সরকারগুলোতেও দেখেছি, এবার হওয়া উচিত ছিল তার ব্যতিক্রম। কিন্তু এ দেশে তা বোধ হয় হওয়ার নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ৮ আগস্ট তাদের শাসনভার গ্রহণ করার দিনকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা করেছে। এটা দেশের সচেতন জনগণকে দারুণভাবে বিস্মিত করেছে এবং হতাশ করেছে। কেন হঠাৎ নিজেদের শাসনভার গ্রহণ করার দিনটিকে অলংকৃত করা হলো? কেন সরকারের অভিষেকের দিনকে আলাদাভাবে স্মরণ করতে হবে বা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে?

জুলাই আন্দোলনের তিন ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও আখতার হোসেন এর প্রতিবাদ করেছেন এবং এ ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ধন্যবাদ দিতে হয় তাঁদের তিনজনকে, তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন বলেই আজ বিষয়টা নিয়ে অন্যরা সহজভাবে কথা বলতে পারছেন।

এর আগে বাংলাদেশে কত কত সরকারের আগমন নিয়ে আমরা কত বৈপ্লবিক বাণী শুনেছি—শেখ মুজিবের ‘সোনার বাংলা’ গঠনের সরকার, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ‘দেশ গড়ার’ সরকার, হাসিনার ‘স্বাধীনতার চেতনার’ সরকার। তাঁরা একেকজন দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু তাঁদের অভিষেক ও অলংকৃত বাণী আমাদের দেশের জন্য সুফল আনতে পারেনি।

এই সরকার ক্ষমতা নিয়েছে প্রায় ১১ মাস হলো। তাঁরা সরকারি কনফারেন্স টেবিলে বসে কীভাবে ঠিক করলেন যে তাঁদের সরকার গঠনকে বা তার পরবর্তী সময়টাকে ‘নতুন বাংলাদেশ’ অভিহিত করতে হবে!

সরকার কিছু সাংবিধানিক পরিবর্তনের কথা বলছে ঠিকই, এখনো এসব নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা চলছে। এই সরকার ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের অনেক হোমরাচোমরাকে জেলে নিয়েছে এবং বিচার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তা-ও একটা ইতিবাচক উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের আদালতগুলোয় যা চলছে, তাতে এই বিচারকাজকেও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।

পুরোনো বাংলাদেশটাকে যে কিছু কিছু মেরামত করার চেষ্টা হচ্ছে, না তা নয়। দেয়ালের যেসব ফাঁকফোকর দিয়ে টাকাকড়ি বেরিয়ে যেত, তা বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের কথা বলার সুযোগ আগের চেয়েও বেশি। একটা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতি জনগণকে আশাবাদী করেছে। এই আশাবাদের পাশাপাশি বিফলতাও যোগ হয়েছে অনেক। চারদিকে সামাজিক অস্থিরতা ও ‘মব সংস্কৃতির’ বিস্তার জনগণের জীবনকে অস্থির করে তুলছে।

দেশের বড় একটা মিউনিসিপ্যালিটি এক মাস ধরে কোনো সেবা দিতে পারছে না, এনবিআরের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান অকেজো হয়ে পড়ে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে একজন দায়িত্ববান কেউ সামনে এসে বলছেন না যে কেন এগুলো মেনে নেওয়া হচ্ছে? এসব ব্যাপার এত দৃশ্যমান যে এই প্রশ্নগুলো এখন সবার মনে দারুণভাবে তাড়া দিচ্ছে।

একটা সরকার ক্ষমতা নিয়েছে, কিছু কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে, তাই বলে তাদের ক্ষমতা নেওয়ার তারিখকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ বলার কোনো সুযোগ নেই। এটা একটা খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করল। এই সরকার যদি পুরোনো বাংলাদেশের কিছু বিচ্যুতি মেরামত করে দিতে পারে, সেটাও একটা বড় কাজ হবে। নতুন নির্বাচন হওয়ার সম্ভবত মাত্র ৯ মাস বাকি। আশা করা যায়, তারপর নতুন সরকার আসবে। এই ৯ মাসে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার সময় ও সুযোগ কোনোটাই বর্তমান সরকার পাবে না।

সরকার যদি সত্যি মনে করে, তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ছে বা গড়তে সক্ষম হবে কিংবা তাদের শাসনক্ষমতা নেওয়ার দিনটা সত্যি ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে স্মরণীয় হওয়া উচিত, তাহলেও তাদের উচিত তাদের মেয়াদটা শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ভবিষ্যৎই নির্ধারণ করবে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতাকে দেশের মানুষ কীভাবে স্মরণ করবে। আইয়ুব খানের তথাকথিত ‘উন্নয়নের দশ বছর’ কিংবা শেখ হাসিনার তথাকথিত ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ তারা ক্ষমতা ছাড়ার পরে টেকেনি।

এই সরকারের ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা মানুষকে দারুণভাবে বিভ্রান্ত করবে। একটা সরকার ইতিহাস গড়তে পারে, কিন্তু ইতিহাস লিখতে পারে না। বিগত দিনের কত সরকারের লিখিত ইতিহাস ও ‘মাইলস্টোন দিবস’ জনগণ ছুড়ে ফেলে দিয়েছ।

এটা সত্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থিতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতায় অধ্যাপক ইউনূসের বড় অবদান রয়েছে। সরকারের বাইরেও অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত সাফল্য রয়েছে। ৫ আগস্টের পর কে যে আমাদের দেশের হাল ধরবেন, তা ছিল অনিশ্চয়তার ব্যাপার। জুলাই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন বা তাঁদের পরামর্শক ছিলেন, তাঁদের কারও এমন কোনো পরিচিতি ছিল না যে তাঁরা কেউ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারতেন।

অধ্যাপক ইউনূস ওই সময় দেশের হাল ধরে জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন। তিনি আসায় আন্তর্জাতিক বিশ্বেও দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ কমে গেছে। এটাও সেই সময়ে দেশের জন্য ছিল একটা বিরাট পাওনা। কিন্তু সরকারে সরকারে তাঁর অংশগ্রহণকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ বলা সঠিক নয়। একটা নতুন সরকার আসা অবশ্যই দেশের জন্য অনেক আশার, বিশেষত ১৫ বছরের একনায়ক সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর। কিন্তু নতুন সরকার আসা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘নতুন বাংলাদেশের’ আশ্বাস বহন করে না।

এই সরকারে যাঁরা উপদেষ্টা রয়েছেন, তাঁরা বেশির ভাগই খুব বিনয়ী ব্যক্তিত্ব। তাঁরা ৮ আগস্টকে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা করে নিজেদের অভিষেক উদ্‌যাপনের জন্য নতুন মুকুট বানালেন কেন, তা বোঝা দুষ্কর। জুলাই আন্দোলনের স্বীকৃতির যা অলংকার, তার পুরাটাই প্রাপ্য ৫ আগস্ট, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’–এর এবং আন্দোলনের শহীদদের। এর বাইরে অধ্যাপক ইউনূসের বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন, নতুন সরকার গঠন এবং এই সরকারের শপথ গ্রহণ—এগুলো সবই ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা।

সত্যি কথা হলো, আমরা এখনো সেই পুরোনো বাংলাদেশকে নিয়েই হিমশিম খাচ্ছি। ‘সোনার বাংলার’ মরীচিকায় বিশ্বাস করে আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি। যদি কোনো সরকার আমাদের জন্য সত্যি সত্যি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে পারে, আমরা অবশ্যই পেছনে তাকিয়ে সেই সরকারের অভিষেককে অলংকৃত করব। তবে আগেভাগে অলংকৃত করা ঠিক হবে না। জুলাই মাসের আগমনী সময়ে আমাদের সব প্রশংসা ও স্মরণ শুধু ৫ আগস্টের, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’–এর জন্য এবং যাঁরা এই অভ্যুত্থানকে সফল করতে নিজেদের প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের জন্য।

সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল দ শ দ বস এই সরক র সরক র র ইউন স র সরক র ক ই সরক র র ক ষমত আম দ র র জন য নত ন ব কর ছ ন স মরণ আগস ট হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

আন্দোলনে স্থবির এনবিআর আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কার ও চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণের দাবিতে সারাদেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘শাটডাউন’ এবং রাজধানীতে ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি পালন করেছেন। গতকাল শনিবার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই আন্দোলনের কারণে প্রতিষ্ঠানটিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
চলমান পরিস্থিতিতে ১২টি শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের দাবি, আন্দোলনের কারণে শুধু পোশাক খাতেই দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে।
এদিকে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তাদের শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি রোববারও চলবে। তবে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কর্মসূচির বাইরে থাকবে।

গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন করছেন। গত ২৫ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এর পর ২২ জুন থেকে চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সারাদেশে এনবিআরের কর, মূসক ও শুল্ক দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শাটডাউন এবং মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচি পালন করেন। তাদের আন্দোলনে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। দেশের স্থলবন্দরগুলোতে যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক থাকলেও রাজস্ব আদায় এবং আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে পুরোপুরি অচলাবস্থা দেখা দেয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলের কাস্টম হাউসের কমিশনাররা রাজধানীর আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনের সামনে মার্চ টু এনবিআর কর্মসূচিতে অংশ নেন। সরেজমিন রাজস্ব ভবনের সামনে আন্দোলনকারীদের অবস্থান ঘিরে বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে দেখা যায়।

এনবিআর ভবনের তিনটি ফটকই বন্ধ রাখা হয়। আন্দোলনকারীরা ভেতরে ঢুকতে পারেননি। ভবনের সামনে নানা স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে বিক্ষোভ করেন।

আন্দোলনের মধ্যেই দুপুরে সংস্কার ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে। লিখিত বক্তব্যে পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার ও মহাসচিব সেহেলা সিদ্দিকা বলেন, দাবি আদায়ে রোববারও সারাদেশে ‘শাটডাউন’ ও ‘মার্চ টু এনবিআর’ কর্মসূচি চলবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সকাল ১০টার মধ্যে এনবিআর ভবনের সামনে থাকার আহ্বান জানান তারা।
পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘বর্তমান চেয়ারম্যানকে দায়িত্বে রেখে রাজস্ব খাতের সংস্কার সম্ভব নয়। রাজস্ব ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ, প্রকৃত, টেকসই ও বাস্তবসম্মত সংস্কারের স্বার্থে তাকে আগে অপসারণ করতে হবে। এ বিষয়ে ঐক্য পরিষদ অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে যে কোনো সময় আলোচনায় বসতে প্রস্তুত রয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘সমস্যার সমাধানে অর্থ উপদেষ্টার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আমরা প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

অবশ্য গতকাল যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শীর্ষস্থানীয় ১২টি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনোভাবে কাম্য নয়। এতে কোনো সফলতা আসবে না। এ ব্যাপারে ঐক্য পরিষদ বলেছে, কী কারণে পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলার অপসারণ ব্যবসায়ী সমাজের কাম্য নয়, তা তারা খোলাসা করেননি। ব্যবসায়ী সমাজকে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের বিষয়ে একমত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

পরিষদের সভাপতি বলেন, ১৯ জুন রাজস্ব অধ্যাদেশ সংশোধনের জন্য এনবিআর ছয় সদস্যের কমিটি করেছে। কমিটিতে ঐক্য পরিষদের কোনো প্রতিনিধিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উল্টো অধ্যাদেশকে যারা স্বাগত জানিয়েছে, তাদের রাখা হয়েছে। এর অর্থ, চেয়ারম্যান নিজের পছন্দের লোকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করতে চান। আন্দোলনের কারণে যে পাঁচ কর্মকর্তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছে, সে আদেশ প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানান তিনি।
গতকাল বিকেলেও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সংস্থার ১৬ সদস্যকে নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। ঐক্য পরিষদের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য পক্ষপাতদুষ্ট বক্তব্য দেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে, আন্দোলনকারীরা তাদের কাছে গিয়ে ধরনা দিক। এমন মনোভাবে সমস্যার সমাধান হবে না।

বন্দরগুলোতে অচলাবস্থা, ট্রাকের সারি বাড়ছে
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দরে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। পণ্য খালাস ঠিকমতো হচ্ছে না। বন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় পণ্যবাহী ট্রাকের সারি বাড়ছে। জেটিতেও পণ্য বোঝাইয়ের অপেক্ষায় গাড়িজট তৈরি হয়েছে। তবে আগে নিবন্ধন হওয়া জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানামা কার্যক্রম চলেছে। নিবন্ধনহীন নতুন জাহাজ জেটিতে ভিড়লে কনটেইনার ওঠানামা হবে না। তখন পরিস্থিতি খারাপ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস প্রায় ফাঁকা পাওয়া যায়। বন্দরের ফটকে কাস্টমস কর্মকর্তারা পণ্য স্ক্যানিং ও পরীক্ষণ বন্ধ রেখেছেন। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ পণ্য ছাড় দিচ্ছে না। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বন্দরে আমদানি-রপ্তানির শুল্কায়ন থেকে খালাস– সবকিছু কাস্টমসের অনুমোদনে হয়। তাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকলে বড় প্রভাব পড়বে।’


বন্দরের চিফ পার্সোনাল অফিসার নাসির উদ্দিন জানান, জেটিতে জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক রয়েছে। তবে খালাসের সেসব পয়েন্টে কাস্টমস যুক্ত, সেখানে কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে।
শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন জানান, সরকার দ্রুত সমস্যার সমাধান না করলে কার্যক্রমে সংকট দেখা দেবে। কারণ আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৯২ ভাগ এ বন্দরে হয়।
মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানান, মোংলা কাস্টম হাউস খোলা থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো কাজ করেননি। মোংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার মু. শফিউজ্জামান জানান, আন্দোলনের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও বোর্ড জনসংযোগ বিভাগের উপপরিচালক মাকরুজ্জামান জানান, আমদানি-রপ্তানিসহ জাহাজে পণ্য ওঠানামা স্বাভাবিক ছিল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শুল্কায়ন বন্ধের কারণে সোনামসজিদ স্থলবন্দর এবং রহনপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ ছিল। জিরো পয়েন্টে আটকা পড়েছে পণ্যবাহী ট্রাক। কাস্টমস ভবনের মূল ফটক বন্ধ করে ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবস্থান নেন।

জিরো পয়েন্টে প্লাস্টিক পণ্যের ১৩টি ট্রাক ভারতে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল। ভারতীয় অংশে প্রায় ২৫০টি পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষা করছে।
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, বেনাপোল কাস্টমস হাউসে পণ্য শুল্কায়ন, পরীক্ষণ ও লোড-আনলোড বন্ধ ছিল। ছয় ট্রাক পণ্য আমদানি হলেও কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি। কাস্টম হাউসের চেকপোস্ট কার্গো শাখার রাজস্ব অফিসার আবু তাহের জানান, কোথাও কোনো কাজ হয়নি। বৃহস্পতিবার অনুমোদন হওয়ায় কার্পাশে ছয় ট্রাক পণ্য আমদানি হয়েছে।

আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, আখাউড়া বন্দরের কাস্টমসে আন্দোলনের মধ্যে আটা ও মাছের ২৬টি ট্রাক ভারতে যায়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব পণ্যের কাগজপত্র আগের দিন সই হয়েছিল। এ ছাড়া ত্রিপুরার আগরতলায় বিকেল পর্যন্ত ২৩টি ট্রাকে করে ৯২ টন মাছ ও তিনটি ট্রাকে ৬৬ টন আটা রপ্তানি হয়। বন্দরে আন্দোলনের তেমন প্রভাব পড়েনি। কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটান।

বন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সদরুল হাসান চৌধুরী বলেন, আন্দোলনে থাকায় নতুন কোনো কাগজপত্রে সই করেনি কাস্টমস কর্মকর্তারা।
হাকিমপুর (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানান, হিলি স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অফিসে থাকলেও কর্মবিরতি পালন করেন। ফলে আমদানি পণ্যের ট্রাক বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।

পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, আন্দোলনের কারণে পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আটকা পড়েছে পাথরবোঝাই ১৪৮টি ট্রাক। ভুটান থেকে এসব ট্রাক এলেও কাস্টমসের ছাড়পত্র না পাওয়ায় আনলোড হয়নি। বিকেল পর্যন্ত বন্দর দিয়ে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি বলে স্থলবন্দর লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আবুল কালাম আজাদ জানান।

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ