শৈশবে খিলগাঁওয়ে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন খ্যাতিমান সংগীতশিল্পী সোহরাব হোসেন। তিনি আমার বন্ধুর বাবা ছিলেন, খালু বলে ডাকতাম। কিন্তু তাঁর সঙ্গেও আমার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতোই। কারণ, তিনি রেডিও-টেলিভিশনে গান করতেন। তাঁর একটি হোন্ডা ফিফটি মোটরসাইকেল ছিল এবং তাঁর সঙ্গে ঘুরতে গেলে তিনি পেটিস খাওয়াতেন। শৈশব থেকে আমার রেডিও-টেলিভিশনের প্রতি ছিল অসামান্য ঝোঁক। সোহরাব খালুর সঙ্গে রেডিও-টেলিভিশনে যাওয়ার সুযোগ হতো। তাঁর হোন্ডা ফিফটি মোটরসাইকেলের পেছনে বসে সারা শহর ঘুরে বেড়াতাম। 

মতিঝিল পীরজঙ্গি মাজারের মোড়ে ছিল প্যারামাউন্ট কনফেকশনারি নামের একটি বেকারি। ছোটবেলা দেখেছি, সন্ধ্যে হলেই মহল্লায় কাচের বাক্স মাথায় নিয়ে ডাক ছাড়তো– ‘হট পেটিস’ বলে। ওই সময়ে কাচে ঘেরা এমন দোকান খুব একটা ছিল না। ডিআইটি থেকে টেলিভিশনে গান গাওয়া শেষ করে ফেরার পথে বেকারিতে বসে দু’জনে দুটি পেটিস খেতাম। এই লোভে সোহরাব খালুর সঙ্গে আমার ছিল সেই ভাব। যাই হোক, সোহরাব খালুর সঙ্গে একদিন সে সময়কার ডিআইটিতে টেলিভিশন ভবনে গিয়েছিলাম। তখনকার গানের অনুষ্ঠানগুলো সাধারণত লাইভ সম্প্রচার হতো। 

সেখানেই প্রথমবারের মতো দেখা মেলে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমানের সঙ্গে। এর আগে তাঁকে বহুবার টেলিভিশনে গান গাইতে দেখেছি, সামনা-সামনি কখনও দেখিনি। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর ফেরদৌসী রহমানের গান দিয়ে শুরু হয়েছিল বিটিভির (তখনকার পিটিভি, অর্থাৎ পাকিস্তান টেলিভিশন) প্রথম গানের অনুষ্ঠান। ২৭ ডিসেম্বর শুরু করেন জনপ্রিয় ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানটি। সেই ‘ফেরদৌসী রহমান’কে দেখে যে কী আনন্দ হয়েছিল! 

এমন সাদাসিধে, মার্জিত অথচ কী স্মার্ট আর আভিজাত্যে ভরা তাঁর ব্যক্তিত্ব! ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে গর্ব করে বলেছি, ‘জানিস, ফেরদৌসী রহমানকে আমি নিজ চোখে দেখে এসেছি!’ ম্যাট্রিকে বোর্ড স্ট্যান্ড করা, সারাদেশের মেয়েদের মধ্যে প্রথম হওয়া ফেরদৌসী রহমান শুধু গানের জন্য নয়, পড়াশোনায়ও ছিলেন আদর্শ। 

খুব সম্ভবত জোনাকি কিংবা মধুমিতা সিনেমা হলে রাজ্জাক-কবরী অভিনীত ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমার প্রথম শো দেখে বের হয়েছি। কানে তখনও লেগে আছে, কবরীর ঠোঁটে ফেরদৌসী রহমানের গান ‘গান হয়ে এলে.

..’। সে সময় সিনেমা হলের সামনে প্রদর্শিত সিনেমার গান নিয়ে নিউজ প্রিন্টে ছাপা ছোট বই বের হতো। সেখানে সিনেমার গানগুলোর লিরিক লেখা থাকত। 

মনে আছে, আমি সিনেমা হল থেকে বের হয়েই কিনে নিয়েছিলাম ওমন একটি বই। সেই শৈশব-কৈশোরে ফেরদৌসী রহমান আমার কাছে এভাবেই ‘গান হয়ে’ এসেছিলেন। শুধু আমার কাছে নন। আমার মনে হয়, আমার বয়সী অনেকের কাছেই ফেরদৌসী রহমান মিষ্টি গানের কোকিল। ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু’, ‘আমি কার জন্য পথ চেয়ে রব’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, ‘প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্বতলে’, ‘যে জন প্রেমের ভাব জানে না’, ‘পদ্মার ঢেউ রে’, ‘যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে’, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভ্রমরা’, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ এমন অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে ভরিয়েছেন আমাদের হৃদয়। 
পল্লীগীতি সম্রাটখ্যাত আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা ফেরদৌসী রহমান। তাঁর বাবা বিখ্যাত হয়েছিলেন পল্লীগীতি গেয়ে। পল্লীগীতি ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকসহ সব ধরনের গানই ফেরদৌসী রহমান করেছেন। বাংলা ছাড়া তিনি উর্দু, ফারসি, আরবি, জাপানি, রুশ, জার্মানসহ আরও বেশ কিছু ভাষায় গান গেয়েছেন। তিনি আমাদের প্রথম নারী সংগীত পরিচালক। 

আমরা চ্যানেল আই প্রতিষ্ঠা করার পর বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। দিনে দিনে বুঝেছি তিনি শুধু ভালো গানই করেন না, তিনি আসলে পবিত্র আত্মার মানুষ। যার সঙ্গে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। তাঁর কণ্ঠে যেমন সুর আছে, কথায় আছে জাদু। যে জাদু কথায় তিনি টেলিভিশনের অসংখ্য দর্শককে মুগ্ধ করেছেন, অগণিত শিশু-কিশোর উদ্বুদ্ধ হয়েছে গান শিখতে। ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংগীতের এই জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন ‘খালামণি’। 

‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠান থেকে অনেক শিল্পীই উঠে এসেছেন। এই সময়ের জনপ্রিয় শিল্পী কণাও যুক্ত ছিলেন ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানে। হয়তো অনেকেই খ্যাতিমান শিল্পী হয়ে উঠতে পারেননি। যারা ফেরদৌসী রহমানের সংস্পর্শে ছিলেন, তারা তাঁর আদর্শে, নীতিনৈতিকতায় সুন্দর মানুষ হয়ে উঠেছেন ঠিকই। যারা ছড়িয়ে আছেন দেশ-বিদেশে ফেরদৌসী রহমানের পরিবারের মানুষ হয়েই। ফেরদৌসী রহমান হয়ে আছেন আমাদের চ্যানেল আই পরিবারের একজন। তাঁকে আমরা পেয়েছি সবসময়। তিনিও চ্যানেল আইকে নিজের বাড়ি বলে জ্ঞান করেছেন। 

গত ২৮ জুন ৮৪ বছর পূর্ণ করলেন ফেরদৌসী রহমান। এ উপলক্ষে আমাদের আমন্ত্রণে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে এসেছিলেন তিনি। এই বয়সেও রয়ে গেছে সেই আগের প্রাণ-প্রাচুর্য। কণ্ঠে স্নেহ জড়িয়ে কথা বললেন। মাত্র ৮ বছর বয়স থেকেই তিনি রেডিওর ‘খেলাঘর’ অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শোনান। সেই হিসেবে ৮৪ বছর বয়সের ৭৬ বছরই তিনি আমাদের গান শুনিয়ে আসছেন। এই গুণী শিল্পীর গানে মিশে আছে আমাদের হৃদয়ের অনুভূতি, দেশের মাটি ও মানুষের কথা। তাঁর দীর্ঘ সুস্থজীবন প্রত্যাশা করি। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন রহম ন র জনপ র য় আম দ র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকায় চালু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয়

ঢাকায় প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য চালু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কার্যালয়। রোববার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ওনাদের সঙ্গে আমাদের সরকারের অনেকদিন ধরে আলোচনা চলছিল।

তিনি বলেন, এই মিশনের একটা শাখা ওনারা বাংলাদেশে খুলতে চাচ্ছিলেন, আলোচনা করছিলেন। এই আলোচনার একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

আইন উপদেষ্টা জানান, আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন হয়েছে। কয়েকজন উপদেষ্টা মিলে এটা পরীক্ষা করব। তা চূড়ান্ত করে ভলকার টুর্কের কাছে তা পাঠানো হবে।

আসিফ নজরুল আশা প্রকাশ করেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সাক্ষর হবে।

তিনি জানান, এই সমঝোতা স্মারক সাক্ষরের পর তিনি বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একটা অফিস হবে। প্রাথমিকভাবে এটা হবে তিন বছরের জন্য। তিন বছর পর দুই পক্ষই যদি মনে করে এটা নবায়ন করা দরকার তাহলে এটা বিবেচনা করে দেখতে পারবে বলেও জানান তিনি। খবর বিবিসি বাংলা

সম্পর্কিত নিবন্ধ