কর্ণফুলী পেপার মিল : পুরোনো শিল্পের নতুন স্বপ্ন
Published: 30th, June 2025 GMT
পাহাড়, নদী আর বনভূমির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা কাপ্তাইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) একসময় ছিল বাংলাদেশের শিল্প সম্ভাবনার প্রতীক। ১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু করা রাষ্ট্রায়ত্ত এই কাগজকল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। স্বাধীনতার পরেও এটি দেশের প্রধান কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, লোকসান এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধীরে ধীরে মিলটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন সেই কর্ণফুলী পেপার মিলকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক শিল্পে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে পুনরুজ্জীবনের রোডম্যাপ।
এক সময়ের গৌরব
কর্ণফুলী পেপার মিল ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫৩ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। কানাডার অর্থায়নে গড়ে ওঠা এই মিলেই প্রথম দেশীয় বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদনের প্রযুক্তি চালু হয়। এক সময় দেশের সরকারি অফিস, সংবাদপত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পাঠ্যবইও মূলত কেপিএম থেকে উৎপাদিত কাগজেই ছাপা হতো। ‘বাঁশের কাগজ’ নামে খ্যাত এই কাগজ ছিল টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।
লোকসানী প্রতিষ্ঠান
সরকারি মালিকানায় থাকা সত্ত্বেও কেপিএম ধীরে ধীরে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন মাত্র ৮-১০ টন, যেখানে একসময় ১০০ টনের বেশি কাগজ উৎপাদিত হতো। গত ১০ বছরে মিলটির লোকসান প্রায় ৪৫৩ কোটি টাকা। বিসিআইসির কাছে মিলটির ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
স্থায়ী জনবল মাত্র ২২০ জন, যাদের মধ্যে ১৮০ জনই শ্রমিক। বড় ধরনের সংস্কার হয়েছে প্রায় তিন দশক আগে। অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই অচল, উৎপাদনে অটোমেশন নেই। ফলে ব্যয়বহুল ও অকার্যকর উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
কেপিএমের একজন জ্যেষ্ঠ শ্রমিক বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরে ঠিকঠাক উৎপাদন চলছে না। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি আমরা নিজেরাই মেরামত করি, অনেক সময় নিজের টাকায় কিনে আনি কিছু যন্ত্রাংশ।’’
নতুন উদ্যোগ
শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির পরিকল্পনা অনুসারে, কেপিএমে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আধুনিকায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার মূল দিকগুলো হলো: ৬টি নতুন উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন।ইন্টিগ্রেটেড কেমিক্যাল প্ল্যান্ট নির্মাণ
বাঁশভিত্তিক ফাইবার উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন। পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) চালু করা।
লক্ষ্য: বছরে ১ লাখ টন কাগজ উৎপাদন ও বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির নির্ভরতা কমানো।
উৎপাদনই ভবিষ্যৎ
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘‘দেশে প্রচুর কাগজের চাহিদা রয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি না করে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। কর্ণফুলী পেপার মিলকে পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘কাগজ তৈরিতে বিদেশি কেমিকেলের পরিবর্তে দেশীয় কাঁচামাল-যেমন বাঁশ, খড়, পাটকাঠি ও কাঠের পাল্প ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।’’
বাংলাদেশের কাগজ শিল্পের চিত্র
বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমদানির উৎস দেশগুলো হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। কাগজ আমদানিতে প্রতি বছর গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।
দেশীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজের বড় অংশই প্রাইভেট সেক্টরের হাতে। খাতুনগঞ্জ, পাবনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে স্টারলেট, পারটেক্স, বিএম কাগজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিউজপ্রিন্ট ও কম মানের কাগজ উৎপাদন করলেও উচ্চমানের মালবাহী বা ছাপার কাগজের জন্য এখনো আমদানির বিকল্প নেই।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
কেপিএম পূর্ণভাবে চালু হলে এটি শুধু একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন হবে না, বরং হবে একটি আঞ্চলিক অর্থনীতির জাগরণ। কাপ্তাই ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। স্থানীয় বাঁশ, কাঠ ও পাটচাষিদের জন্য বাজার তৈরি হবে।
কাপ্তাই হ্রদ ও সড়কপথে পরিবহন খাতেও গতি আসবে। কাপ্তাইয়ে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় সম্প্রসারণ ঘটবে। জাতীয় পর্যায়ে আত্মনির্ভরশীল কাগজ শিল্পের ভিত্তি গড়ে উঠবে।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘‘কাপ্তাই অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছে। চালু হলে শুধু শ্রমিকরাই নয়, পুরো অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে।’’
পরিবেশ ও স্বচ্ছতা: ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ
পরিকল্পনা যত বড়ই হোক, বাস্তবায়নের সময় পরিবেশ ও স্বচ্ছতা উপেক্ষা করলে তা আবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এই মিল যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উপেক্ষিত হয়, তবে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ড.
শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘সরকারের সদিচ্ছা আছে, বিনিয়োগ পরিকল্পনা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় যদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হয়, তবে এটি আরেকটি ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে পরিণত হতে পারে।’’
তিনি বলেন, ‘‘কর্ণফুলী পেপার মিল কেবল একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সম্ভাবনার প্রতীক। এক সময়ের গৌরবময় এই মিল যদি আবার ঘুরে দাঁড়ায়, তবে তা হবে একটি সফল শিল্পপুনর্জাগরণের উদাহরণ। এখন প্রশ্ন হলো-সরকারি ঘোষণার চেয়ে বাস্তবায়নের দৃঢ়তা বেশি হবে কি না।’’
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘‘কর্ণফুলী পেপার মিল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপুনর্জাগরণের প্রতীক হবে।’’
ঢাকা/টিপু
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আমদ ন র শ ল পপ পর ব শ ক প এম সরক র ক সময়
এছাড়াও পড়ুন:
আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে আলোকিত মুখ নারায়ণগঞ্জের আলিয়ার হোসেন
আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে এক আলোকিত মুখ নারায়ণগঞ্জের কৃতি সন্তান অধ্যাপক আলিয়ার হোসেন। লন্ডনের নর্থামব্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান, নেতৃত্ব ও ক‚টনৈতিক প্রশিক্ষক, সরকারি নীতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বিশেষজ্ঞ আলিয়ার হোসেন উচ্চ শিক্ষায় অনেকগুলো ডিগ্রী অর্জন করেছেন। আন্তজার্তিক বক্তা আলিয়ার হোসেন সংকট ব্যবস্থাপনা, কোচিং, টেকসই উন্নয়ন কৌশল, ক‚টনৈতিক এবং নির্বাহী নেতৃত্ব প্রশিক্ষণে দক্ষ একজন মানুষ।
যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া উভয় ক্ষেত্রেই বেসরকারি, সরকারি এবং উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পরামর্শ, শিক্ষকতা এবং নির্বাহী প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি শিল্প ও নাগরিক সম্পৃক্ততার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের পাশাপাশি লন্ডন ক্যাম্পাসে নিয়োগকর্তা নিয়োগ বোর্ডের উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি যুক্তরাজ্যের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট (পিএইচডি এবং ডিবিএ) তত্ত¡াবধায়ক এবং পরীক্ষকও।
আলিয়ার হোসেন স্পার্কের সহ-সভাপতি এবং যুক্তরাজ্যের স্কুল অফ লিডারশিপের আহŸায়ক। প্রায়শই তিনি বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতীয় সংলাপ, বিতর্ক, টিভি টক শো, একাডেমিক এবং মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনায় ভার্চুয়ালি এবং ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা, এসডিজি’স কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা, মন্ত্রী পর্যায়ের এবং ক‚টনৈতিক প্রশিক্ষণ, নেতৃত্ব উন্নয়ন, কর্পোরেট সংস্কৃতি, শাসন এবং কৌশলগত নীতির জন্য মূল বক্তা এবং অধিবেশন মডারেটর হিসাবে অসংখ্য যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও ব্যবসায়িক সংস্থা পরিদর্শন করেন।
তিনি যুক্তরাজ্য এবং বিদেশে এসএমই, পারিবারিক ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অলাভজনক সংস্থা, দাতব্য সংস্থা ও সরকারি সংস্থা থেকে শুরু করে শত শত নির্বাহী এবং ব্যক্তিদের সাথে কাজ করেছেন।
তিনি সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিশ্ব নাগরিকত্বের ধারণা, নীতিগতভাবে ব্যবসা করার গুরুত্ব এবং বিশ্ব গ্রামে টেকসই উন্নয়নের তাৎপর্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতেও উৎসাহী। এই বিস্তৃত আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে আলিয়ার হোসেন দুটি সময়োপযোগী রচনা (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট হ্যান্ডবুক-এ সাউথ এশিয়ান পারস্পেক্টিভ এবং ডেভেলপিং দ্য মিনিস্ট্রিয়াল মাইন্ডসেট-এ গেøাবাল ভিউ (গুগল সার্চে পাওয়া যায়) তৈরি করেছেন যা টেকসইতা এবং শাসনে কাজ করার জন্য আহবান করা অনেকের ত্রুটিগুলো তুলে ধরে। তিনি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে বেশ কয়েকটি অলাভজনক প্রকল্পকে সমর্থন করেন যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, টেকসই ব্যবসায়াকি ধারণা এবং বিনামূল্যে চিকিৎসার সাথে জড়িত।
আলিয়ার হোসেন ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনা শিক্ষাবিদ, চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের সদস্য, ইনস্টিটিউট অফ কনসাল্টিং-এর সদস্য এবং যুক্তরাজ্যের উচ্চ শিক্ষা একাডেমির সিনিয়র ফেলো। তিনি ২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রয়েল ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (চ্যাথাম হাউস) এর সাথে ৩৫ বছরের কম বয়সীদের গ্রæপে নিযুক্ত ছিলেন।
কেই এই আলিয়ার হোসেন?
আলিয়ার হোসেন নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সমাজ সেবক হাজী মোজাফ্ফর আলী কন্ট্রাক্টরের নাতি, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সাবেক এমপি আলহাজ্ব আফজাল হোসেন ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা আতাহার হোসেন সামসুর ভাতিজা এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে সাবেক তিনবারের এমপি এডভোকেট আবুল কালামের ভাগ্নে। চাচা আতাহার হোসেন সামসুকে দেখে ১৯৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত হন আলিয়ার হোসেন। এবং চাচা আতাহার হোসেন সামসুর বাসায় বিএনপির বৈঠকগুলোতে উপস্থিত থাকতেন তিনি। এরপর তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি কলেজে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যে যান এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার জন্য নতুন যাত্রা শুরু করেন।
২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ ভিত্তিক ডান্ডি ফাউন্ডেশনে যুক্ত হন আলিয়ার হোসেন। এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য হচ্ছে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন, মানসম্মত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা এবং টেকসইতা প্রতিষ্ঠা করা’। এছাড়া ফাউন্ডেশনের বাইরে গিয়ে টেকসই, স্মার্ট ও আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এখন কাজ করছেন তিনি।