পাহাড়, নদী আর বনভূমির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা কাপ্তাইয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কর্ণফুলী পেপার মিল (কেপিএম) একসময় ছিল বাংলাদেশের শিল্প সম্ভাবনার প্রতীক। ১৯৫৩ সালে যাত্রা শুরু করা রাষ্ট্রায়ত্ত এই কাগজকল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিল হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল। স্বাধীনতার পরেও এটি দেশের প্রধান কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, লোকসান এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধীরে ধীরে মিলটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এখন সেই কর্ণফুলী পেপার মিলকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক শিল্পে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছে পুনরুজ্জীবনের রোডম্যাপ।


এক সময়ের গৌরব

কর্ণফুলী পেপার মিল ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ১৯৫৩ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। কানাডার অর্থায়নে গড়ে ওঠা এই মিলেই প্রথম দেশীয় বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করে কাগজ উৎপাদনের প্রযুক্তি চালু হয়। এক সময় দেশের সরকারি অফিস, সংবাদপত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি পাঠ্যবইও মূলত কেপিএম থেকে উৎপাদিত কাগজেই ছাপা হতো। ‘বাঁশের কাগজ’ নামে খ্যাত এই কাগজ ছিল টেকসই, পরিবেশবান্ধব ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।

লোকসানী প্রতিষ্ঠান

সরকারি মালিকানায় থাকা সত্ত্বেও কেপিএম ধীরে ধীরে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন মাত্র ৮-১০ টন, যেখানে একসময় ১০০ টনের বেশি কাগজ উৎপাদিত হতো। গত ১০ বছরে মিলটির লোকসান প্রায় ৪৫৩ কোটি টাকা। বিসিআইসির কাছে মিলটির ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।

স্থায়ী জনবল মাত্র ২২০ জন, যাদের মধ্যে ১৮০ জনই শ্রমিক। বড় ধরনের সংস্কার হয়েছে প্রায় তিন দশক আগে। অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই অচল, উৎপাদনে অটোমেশন নেই। ফলে ব্যয়বহুল ও অকার্যকর উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

কেপিএমের একজন জ্যেষ্ঠ শ্রমিক বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরে ঠিকঠাক উৎপাদন চলছে না। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি আমরা নিজেরাই মেরামত করি, অনেক সময় নিজের টাকায় কিনে আনি কিছু যন্ত্রাংশ।’’ 

নতুন উদ্যোগ

শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির পরিকল্পনা অনুসারে, কেপিএমে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে আধুনিকায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার মূল দিকগুলো হলো: ৬টি নতুন উৎপাদন প্ল্যান্ট স্থাপন। আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন।ইন্টিগ্রেটেড কেমিক্যাল প্ল্যান্ট নির্মাণ
বাঁশভিত্তিক ফাইবার উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন। পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (ইটিপি) চালু করা। 

লক্ষ্য: বছরে ১ লাখ টন কাগজ উৎপাদন ও বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির নির্ভরতা কমানো।

উৎপাদনই ভবিষ্যৎ

শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘‘দেশে প্রচুর কাগজের চাহিদা রয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানি না করে নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। কর্ণফুলী পেপার মিলকে পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’’ 

তিনি আরও বলেন, ‘‘কাগজ তৈরিতে বিদেশি কেমিকেলের পরিবর্তে দেশীয় কাঁচামাল-যেমন বাঁশ, খড়, পাটকাঠি ও কাঠের পাল্প ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।’’ 

বাংলাদেশের কাগজ শিল্পের চিত্র

বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আমদানির উৎস দেশগুলো হলো চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। কাগজ আমদানিতে প্রতি বছর গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।

দেশীয়ভাবে উৎপাদিত কাগজের বড় অংশই প্রাইভেট সেক্টরের হাতে। খাতুনগঞ্জ, পাবনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে স্টারলেট, পারটেক্স, বিএম কাগজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিউজপ্রিন্ট ও কম মানের কাগজ উৎপাদন করলেও উচ্চমানের মালবাহী বা ছাপার কাগজের জন্য এখনো আমদানির বিকল্প নেই।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

কেপিএম পূর্ণভাবে চালু হলে এটি শুধু একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন হবে না, বরং হবে একটি আঞ্চলিক অর্থনীতির জাগরণ। কাপ্তাই ও আশপাশের এলাকায় প্রায় ৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। স্থানীয় বাঁশ, কাঠ ও পাটচাষিদের জন্য বাজার তৈরি হবে।

কাপ্তাই হ্রদ ও সড়কপথে পরিবহন খাতেও গতি আসবে। কাপ্তাইয়ে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় সম্প্রসারণ ঘটবে। জাতীয় পর্যায়ে আত্মনির্ভরশীল কাগজ শিল্পের ভিত্তি গড়ে উঠবে।

একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘‘কাপ্তাই অনেকটাই ঝিমিয়ে গেছে। চালু হলে শুধু শ্রমিকরাই নয়, পুরো অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে।’’ 

পরিবেশ ও স্বচ্ছতা: ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ

পরিকল্পনা যত বড়ই হোক, বাস্তবায়নের সময় পরিবেশ ও স্বচ্ছতা উপেক্ষা করলে তা আবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত এই মিল যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উপেক্ষিত হয়, তবে পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ড.

নাজমুল হাসান বলেন, ‘‘রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে বিনিয়োগ তখনই ফলপ্রসূ হয়, যখন সেটি বাজারভিত্তিক ও দক্ষ পরিচালনায় পরিচালিত হয়। কেপিএমে যে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তাতে সরকারের সদিচ্ছা আছে, কিন্তু বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, জনবল উন্নয়ন এবং বাজারপন্থী কৌশল না থাকলে তা আরেকটি দুর্বল প্রকল্পে পরিণত হবে। চ্যালেঞ্জ ঘোষণার চেয়ে বাস্তবায়ন বড় বিষয়। দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। অটোমেশন এবং ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ব্জার ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে উৎপাদন বাড়লেও লাভজনক হওয়া সম্ভব হবে না।’’ 

শিল্প মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘‘সরকারের সদিচ্ছা আছে, বিনিয়োগ পরিকল্পনা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় যদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হয়, তবে এটি আরেকটি ব্যর্থ রাষ্ট্রীয় প্রকল্পে পরিণত হতে পারে।’’ 

তিনি বলেন, ‘‘কর্ণফুলী পেপার মিল কেবল একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সম্ভাবনার প্রতীক। এক সময়ের গৌরবময় এই মিল যদি আবার ঘুরে দাঁড়ায়, তবে তা হবে একটি সফল শিল্পপুনর্জাগরণের উদাহরণ। এখন প্রশ্ন হলো-সরকারি ঘোষণার চেয়ে বাস্তবায়নের দৃঢ়তা বেশি হবে কি না।’’ 

শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘‘কর্ণফুলী পেপার মিল রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপুনর্জাগরণের প্রতীক হবে।’’

ঢাকা/টিপু 

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আমদ ন র শ ল পপ পর ব শ ক প এম সরক র ক সময়

এছাড়াও পড়ুন:

শেখ মুজিব জাতির জনক নন, তবে তার ত্যাগ স্বীকার করি: নাহিদ

শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জনক নন বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির জনক নন। আমরা স্বাধীনতা অর্জনে তার ভূমিকা এবং ত্যাগ স্বীকার করি। কিন্তু তার শাসনামলের জাতীয় ট্রাজেডিকেও স্মরণ করি।”

শুক্রবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে এ মন্তব্য করেন তিনি।

ওই পোস্টে নাহিদ ইসলাম লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভারতের একটি উপনিবেশ রাজ্যে পরিণত হয়। তার সময়েই ১৯৭২ সালে জনবিরোধী সংবিধান আরোপিত হয় এবং লুটপাট, রাজনৈতিক হত্যা ও একদলীয় বাকশাল একনায়কতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।’

আরো পড়ুন:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

খুলনায় মহররমের নামে শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের চেষ্টা

এনসিপি প্রধান বলেন, “আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট রাজনীতির অন্তরালে মুজিব পূজা ও মুক্তিযুদ্ধ পূজা, একটি রাজনৈতিক মূর্তির পূজা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। অত্যাচার, লুটপাট করার পাশাপাশি নাগরিককে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। এটি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে আধুনিক জমিদারি ছাড়া কম কিছুই ছিল না। তবুও মুক্তিযুদ্ধ ছিল সকল মানুষের সংগ্রাম। কয়েক দশক ধরে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে তার পৈতৃক সম্পত্তি, জবাবদিহিতাহীন শাসন এবং মুজিব নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি ও দমনপীড়নকে ন্যায্যতা দিয়েছে।”

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক দফার ঘোষক নাহিদ ইসলাম বলেন, “২০২৪ সালের জনগণের বিদ্রোহ এই জমিদারিদ্র্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি, পরিবার, মতাদর্শকে আর কখনো নাগরিকদের অধিকার কেড়ে নিতে বা বাংলাদেশের ওপর ফ্যাসিবাদ আরোপ করতে দেওয়া হবে না। জাতির পিতা অভিধাটি ইতিহাসের কোনো অংশ নয়, বরং রাষ্ট্রকে সংকুচিত করে আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বানানোর হাতিয়ার। বাংলাদেশে সব নাগরিকের অধিকার সমান, আর কোনো একক ব্যক্তি এটির মালিকানা দাবি করতে পারবে না।”

তিনি আরো বলেন, “শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধ নামে মুজিববাদ একটি ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ। আমাদের সংগ্রাম কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, ফ্যাসিস্ট আদর্শের বিরুদ্ধে। মুজিববাদ ফ্যাসিবাদ ও বিভাজনের একটি আদর্শ। এর মানে হল জোরপূর্বক গুম, হত্যা, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করা। মুজিববাদ মানে-ইসলামোফোবিয়া, সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যালঘুদের ভূমি দখল। এর মানে-বিদেশি শক্তির কাছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিক্রি করা। ষোল বছর মুজিবকে রাজনৈতিকভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল অস্ত্র হিসেবে, আর মূর্তির আড়ালে ছড়িয়েছিল গুম, খুন, লুটপাট ও গণহত্যা।”

“মুজিববাদ একটি আস্ত বিপদের নাম। এটিকে পরাজিত করার জন্য রাজনৈতিক, আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সংগ্রাম সমনাগরিকদের একটি প্রজাতন্ত্র, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার, যেখানে কোনো দল, বংশ, নেতা জনগণের ওপরে দাঁড়ায় না। বাংলাদেশ কারো সম্পত্তি নয়, এটা গণপ্রজাতন্ত্র।”

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ