পণ্য আমদানি-রপ্তানি স্থবির, দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা
Published: 30th, June 2025 GMT
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০০ কনটেইনার কাঁচামাল আমদানি করে। তার বিপরীতে দিনে রপ্তানি হয় ১৫০ থেকে ১৭৫ কনটেইনার পণ্য। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে গত শনিবার থেকে শিল্পগোষ্ঠীটির পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় সরবরাহব্যবস্থা গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া কাঁচামাল কারখানায় পৌঁছায়। আবার সেই কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করা হয়। বর্তমান অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে পণ্য রপ্তানি গুরুতরভাবে ব্যাহত হবে। আবার আমদানি পণ্য ছাড় করা না গেলে কাঁচামালের অভাবে কারখানা বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
কামরুজ্জামান আরও বলেন, ‘কাস্টমস বন্ধ থাকায় গত শনিবার আমাদের প্রায় ৮ হাজার ডলারের ক্ষতিপূরণ (পোর্টডেমারেজ) গুনতে হবে। এভাবে যতক্ষণ কাস্টমস বন্ধ থাকবে, ততক্ষণ আমাদের লোকসান বাড়তে থাকবে।’ তিনি জানান, গত অর্থবছর প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে।কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এনবিআরের সার্বিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ডাকা এই কর্মসূচির কারণে শনিবার সকাল ছয়টা থেকে ঢাকার এনবিআর ভবন ও সংস্থাটির চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, বেনাপোল ও সোনামসজিদ স্থলবন্দর, ঢাকা কাস্টমস হাউসসহ দেশের সব কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সব ধরনের শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ।
অচলাবস্থার কারণে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। কাস্টমস বন্ধ থাকায় গত শনিবার প্রায় ১০০ টন শাকসবজি বিমানবন্দর থেকে ফেরত নিয়ে যান রপ্তানিকারকেরা। শুধু তা–ই নয়, পণ্য পাঠাতে না পারায় কাতারে চলমান ফলমেলা একদিন আগেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আয়োজকেরা। কাতার সরকার ও বাংলাদেশ দূতাবাসের যৌথ আয়োজনে ২৫ জুন এই মেলা শুরু হয়। ১ জুলাই পর্যন্ত মেলাটি হওয়ার কথা ছিল। এতে বাংলাদেশ থেকে ২২ রপ্তানিকারক ও ২ জন চাষি অংশ নেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেন বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শাকসবজি ও ফলমূল রপ্তানি না হওয়ায় সেগুলো এক-তৃতীয়াংশ দামে বাজারে বিক্রি করতে হচ্ছে। তার চেয়ে বড় সমস্যা সরবরাহব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আমদানিকারকেরা অন্য দেশের দিকে ঝুঁকে যায়। আর একবার ক্রয়াদেশ হারালে সেটি ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন।
গত শনিবার সকাল ছয়টায় এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের শুল্কায়ন কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন। তবে কিছু জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো কার্যক্রম চালু ছিল। কারণ, এসব জাহাজের নিবন্ধনসহ অন্যান্য কার্যক্রমের অনুমোদন আগেই হয়েছে। তবে নতুন আসা জাহাজের নিবন্ধন হচ্ছে না।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি পণ্য কাস্টমসে শুল্কায়ন হওয়ার তিন দিন পর জাহাজে তোলা হয়। কাস্টমসের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর কোন কোন জাহাজ রপ্তানি পণ্যের কনটেইনার না নিয়ে রওনা হলো সেটি আজকের পর বোঝা যাবে। যেসব ক্রয়াদেশের পণ্য নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী রপ্তানি হবে না, সেগুলো পরবর্তী জাহাজে পাঠানোর অনুমোদন বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পেল কি না, তা মঙ্গলবারের পর বোঝা যাবে। অনুমোদন না পেলে নিজেদের খরচে আকাশপথে পণ্য পাঠাতে হবে কিংবা মূল্যছাড় দিতে হবে। এমনটি হলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ বাড়বে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ১১ মাসে ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি। গত মে মাসে সর্বোচ্চ ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
এনবিআরের এ অচলাবস্থা সহজেই এড়ানো যেত বলে মন্তব্য করলেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সব পক্ষের মধ্যে আলোচনা হলেই সংকটটি এই পর্যায়ে যেত না। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমঝোতার জন্য ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করছেন বলে জানান তিনি।
বিজিএমইএর সভাপতি আরও বলেন, কাস্টমস বন্ধ থাকায় দিনে ২৫০০-২৬০০ কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। তার থেকে বড় সংকট হচ্ছে নির্ধারিত সময়ে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ না হলে ক্রেতারা মূল্যছাড় চাইতে পারে। এমনকি ক্রয়াদেশ বাতিলও হতে পারে। এমন ধাক্কা বড় কারখানা সামলাতে পারলেও ছোটরা মুশকিলে পড়ে। অনেকে ঝরে পড়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭ হাজার ২৯২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৫ হাজার ৪৭৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এই আমদানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে গত অর্থবছর পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৪৪৭ কোটি ডলারের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৪ হাজার ৪৯৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক বন ধ থ ক য় ন ক রক বন ধ র হওয় র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।
এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।
আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।