ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাবার-সংকট অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। উপত্যকাটিতে দুই বছরের কম বয়সী ১ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গাজার কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে হামলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

টানা ১১ সপ্তাহ অবরোধের পর মে মাসের শেষের দিক থেকে গাজায় খুব সামান্য পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েল। এ ছাড়া ইসরায়েলে ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিতর্কিত ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে হত্যার শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার তিন ভাগের এক ভাগ মানুষ দিনের পর দিন না খেয়ে রয়েছেন।

গাজায় খাবার-সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী শিশুরা। উপত্যকাটির জনসংযোগ কার্যালয় থেকে গতকাল শনিবার জানানো হয়েছে, ফর্মুলা দুধ সরবরাহ না করা হলে আসন্ন মৃত্যুর ঝুঁকিতে রয়েছে দুই বছরের কম বয়সী ১০ লাখের বেশি শিশু। তাদের মধ্যে ৪০ হাজার শিশুর বয়স এক বছরের কম। ফর্মুলা দুধের অভাবে শিশুদের পানি খাওয়াচ্ছেন মায়েরা।

চরম দুর্দশায় রয়েছেন গাজার মায়েরাও। অপুষ্টির কারণে শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে পারছেন না তাঁরা। এমনই একজন জয়নব। তিনি বলেন, ‘এই অনাহারের মধ্যেই আমি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ি। যখন সন্তানের জন্ম দিই, তখনো অনাহারে ছিলাম। গত ৯ মাসে একটি ডিমও খেয়েছি কি না, মনে পড়ে না। এর বেশি আর কী বলব?’

খাবারের এই হাহাকারের মধ্যে আজ রোববার অনাহারে আরও পাঁচ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত মার্চে গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ শুরু পর থেকে এ নিয়ে অনাহার ও অপুষ্টিতে অন্তত ১২৭ ফিলিস্তিনির মৃত্যু হলো। তাঁদের মধ্যে ৮৫ জনের বেশি শিশু। এ ছাড়া ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলায় উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি।

আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন শিশুর হত্যাকারী জুবা মারা গেছেন৩ ঘণ্টা আগে

১০ ঘণ্টা হামলা স্থগিত রাখার ঘোষণা

ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ। উপত্যকাটিতে ‘ব্যাপক হারে দুর্ভিক্ষ’ ছড়িয়ে পড়ছে বলে গত বুধবার সতর্ক করেছিল শতাধিক মানবাধিকার সংস্থা। এ ছাড়া গাজায় দেখা দেওয়া ‘ভয়াবহ বিপর্যয়’ থামানোর জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গত শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি।

এএফপি জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আজ গাজার কিছু এলাকায় প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে ‘কৌশলগত সামরিক কর্মকাণ্ড’ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা বলেছে, উপত্যকার আল মাওয়াসি, দেইর আল-বালাহ ও গাজা নগরীতে সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত হামলা চালানো হবে না। এ সময়ে জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো সড়কপথে নিরাপদে ত্রাণ পাঠাতে পারবে।

আরও পড়ুনইসরায়েল বলছে তারা গাজায় ত্রাণ দিচ্ছে, তাহলে ফিলিস্তিনিরা না খেয়ে মরছে কেন৩ ঘণ্টা আগে

এ ছাড়া গাজায় আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে বলে আজ জানিয়েছে ইসরায়েল। উত্তর গাজায় এমনই একটি ত্রাণের বাক্স একটি তাঁবুর ওপর পড়ে অন্তত ১১ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। মিসর থেকেও রাফা ক্রসিং হয়ে ত্রাণের ট্রাক গাজায় প্রবেশ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আল-কাহেরা নিউজ।

এদিকে গাজাবাসীর জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের (এফএফসি) জাহাজ ‘হান্দালাকে’ বাধা দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। আজ এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলেছে, জাহাজটির আরোহীদের ‘অপহরণ’ করা হয়েছে। ওই সময় জাহাজটি গাজা উপকূল থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দূরে আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল।

আরও পড়ুনফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে ২২১ আইনপ্রণেতার চিঠি২১ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র য ক তর অন হ র আরও প অবর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

সমর্থক ও বিরোধীদের মহানবী (সা.) যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন

আমাদের মতোই মহানবী (সা.) নিত্যদিন নানামুখী জীবন–যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছেন, বিভিন্ন ধরনের মানুষের সমর্থন ও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন। তাঁর জীবনের ঘটনাবলি আমাদের শেখায় কীভাবে আমরা আমাদের উদ্দেশ্যের পথে অটল থাকব, সমর্থন গ্রহণ করব এবং বিরোধিতার মোকাবিলা করব।

১. ভিন্নমতের সমর্থকদের মূল্যায়ন

জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকবেন, যারা আপনার উদ্দেশ্য বিশ্বাস না করলেও আপনাকে সমর্থন করবেন, প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নেবেন। এমন সমর্থকদের মূল্য দেওয়া উচিত, এমনকি যদি তারা আমাদের বিশ্বাসে পুরোপুরি একমত না হন, তবুও। নবীজি (সা.)-এর জীবনে এমন একজন ছিলেন তাঁর চাচা আবু তালিব। তিনি ইসলাম গ্রহণ না করলেও নবীজি (সা.)-কে মক্কার কঠিন সময়ে সুরক্ষা দিয়েছেন। আবু তালিব কুরাইশদের বিরোধিতার মুখে অটল থেকে নবীজি (সা.)-এর পাশে দাঁড়িয়েছেন (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/২৬৫, কায়রো: মাকতাবাত মুহাম্মদ আলী সাবিহ)।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–র হিজরত মদিনায় হলো যে কারণে২৯ জুন ২০২৫

২. নিকটাত্মীয়দের বিরোধিতার মোকাবিলা

কখনো কখনো নিকটাত্মীয়রাও আমাদের উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেন। নবীজি (সা.)-এর জীবনে তাঁর চাচা আবু লাহাব ছিলেন এমনই একজন। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন এবং নবীজি (সা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কোরআনে আবু লাহাব ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে সুরা লাহাব (১১১) নাজিল হয়, যেখানে তাদের বিরোধিতার পরিণতি উল্লেখ করা হয়েছে।

বোঝা গেল, নিকটাত্মীয়দের বিরোধিতা আমাদের উদ্দেশ্য যেন দুর্বল করতে না পারে। উদ্দেশ্যে অটল থাকতে হবে, এমনকি যদি আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ আমাদের বিরোধিতা করে।

৩. অকৃত্রিম বন্ধুর পাশে থাকা

কোনো বন্ধু জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতিতে আপনার পাশে থাকবেন। নবীজি (সা.)-এর জীবনে এমনই একজন ছিলেন আবু বকর (রা)। তিনি ইসলাম গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই নবীজি (সা.)-এর পাশে ছিলেন এবং তাঁর সম্পদ ও জীবন দিয়ে ইসলামের জন্য নিবেদিত ছিলেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যখন আমি মানুষকে ইসলামের দিকে ডেকেছিলাম, সবাই কিছুটা দ্বিধা করেছিল, কিন্তু আবু বকর ছাড়া। তিনি কোনো দ্বিধা না করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন’ (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/১৫৮, কায়রো: মাকতাবাত মুহাম্মদ আলী সাবিহ)।

নবীজিও চিরদিন বন্ধু হিসেবে তার পাশে থেকেছেন। এমন বন্ধুর পাশে থাকা আমাদের জীবনকে কৃতজ্ঞতায় ভরিয়ে দেবে।

৪. পরিবারের সমর্থককে ভরসা করা

যখন পরিবারের সবাই আপনার উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করেন, তখনও কেউ একজন থাকবেন, যিনি সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আপনার পাশে দাঁড়াবেন। নবীজি (সা.)-এর জীবনে এমনই একজন ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই আলী (রা.)। তিনি অল্প বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ইসলামের আদর্শ প্রচারে অগ্রগামী ছিলেন। হিজরতের সময় নবীজি (সা.)-এর তাঁর বিছানায় আলী (রা)–কে রেখে যান, যিনি শত্রুদের ধোঁকা দিয়ে নবীজির (সা.) জীবন রক্ষায় সাহায্য করেন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,৬৮৫)।

নবীজি (সা.) পরবর্তী সময়ে অনেক অনেক বড় সাহাবির প্রস্তাব এড়িয়ে নিজের প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে (রা.) তার কাছে বিয়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুনমহানবী (সা.) যেভাবে সমালোচনা মোকাবেলা করতেন২৫ জুন ২০২৫

৫. নেককার স্ত্রীর অকুণ্ঠ সমর্থন

নবীজি (সা.)-এর জীবনে হযরত খাদিজা (রা.)-এর অবদান একটি অসাধারণ উদাহরণ। তিনি ইসলামের প্রথম দিন থেকে নবীজি (সা.)-এর পাশে ছিলেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তিনি আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যখন অন্যরা অবিশ্বাস করেছিল; তিনি আমাকে সত্যবাদী বলেছিলেন যখন অন্যরা মিথ্যাবাদী বলেছিল; তিনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন যখন অন্যরা পরিত্যাগ করেছিল; তিনি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন যখন অন্যরা তিরস্কার করেছিল; এবং আল্লাহ আমাকে তাঁর দ্বারা সন্তান দান করেছেন, অন্য নারীদের দ্বারা নয়’ (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/২৩৫, কায়রো: মাকতাবাত মুহাম্মদ আলী সাবিহ)।

খাদিজা (রা.)-এর এই অকুণ্ঠ সমর্থন আমাদের শেখায় যে, একজন নারীর সমর্থন একটি উদ্দেশ্যের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 ৬. প্রাথমিক বিরোধীদের রূপান্তর

কিছু মানুষ প্রথমে আপনার উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করতে পারে, কিন্তু পরে তারা আপনার সবচেয়ে বড় সমর্থক হয়ে উঠতে পারে। নবীজি (সা.)-এর জীবনে এমনই একজন ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা)। তিনি প্রাথমিকভাবে ইসলামের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি আল-ফারুক (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) হিসেবে পরিচিত হন এবং ইসলামের জন্য অগণিত অবদান রাখেন (ইবন হিশাম, আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, ১/৩৪৯, কায়রো: মাকতাবাত মুহাম্মদ আলী সাবিহ)।

এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, বিরোধীদেরও রূপান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের প্রতি ধৈর্য ও দয়ার সঙ্গে আচরণ করলে তারা আমাদের উদ্দেশ্যের শক্তি হয়ে উঠতে পারে।

৭. ক্ষমা ও গ্রহণযোগ্যতা

জীবনে কিছু মানুষ আপনার উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু তারা যদি তাদের ভুল স্বীকার করে এবং আপনার উদ্দেশ্য গ্রহণ করে, তবে তাদের ক্ষমা করা উচিত। নবীজি (সা.)-এর জীবনে এমনই একটি উদাহরণ হলেন ওয়াহশী, যিনি হামজা (রা)-কে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং নবীজি (সা.) তাঁকে ক্ষমা করেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৮১)।

এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, ক্ষমা ও গ্রহণযোগ্যতা একটি মহান উদ্দেশ্যের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সারকথা

মহানবী (সা.)-এর জীবন আমাদের জন্য একটি সম্পূর্ণ জীবনদর্শন। তাঁর জীবন থেকে আমরা শিখি কীভাবে সমর্থকদের মূল্য দেওয়া, বিরোধীদের মোকাবিলা করা, পরিবারের সমর্থন গ্রহণ করা, নারীর অবদানের গুরুত্ব বোঝা, বিরোধীদের রূপান্তর এবং ক্ষমার মাধ্যমে মানবতার উন্নতি করা যায়। এই শিক্ষাগুলো আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করলে আমরা আরও উন্নত মুসলিম এবং মানুষ হয়ে উঠতে পারি। নবীজি (সা.)-এর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকা এবং সকলের প্রতি দয়া ও ক্ষমা প্রদর্শনই একটি মহান উদ্দেশ্যের সাফল্য নিশ্চিত করে।

আরও পড়ুনসুস্থ জীবন যাপনে মহানবী (সা.)-এর ৯ অভ্যাস২৪ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সমর্থক ও বিরোধীদের মহানবী (সা.) যেভাবে মূল্যায়ন করেছেন