বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকলেও রাশিয়া তার বিপুল জ্বালানিসম্পদের ওপর নির্ভর করে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার সেই অর্থের জোগান বন্ধ করতে চাইছেন।

ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ৮ আগস্টের মধ্যে যুদ্ধবিরতি না হলে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করা সব দেশের ওপর শতভাগ পরোক্ষ শুল্ক আরোপ করা হবে।

এর অর্থ হলো, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য করছে—এমন যেকোনো দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে। অর্থাৎ সেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্বিগুণ দামে প্রবেশ করবে।

রাশিয়ার রপ্তানির প্রধান খাত তেল ও গ্যাস। এসব পণ্যের বড় ক্রেতার মধ্যে আছে চীন, ভারত ও তুরস্ক। ট্রাম্প এক মাস আগে বলেছিলেন, ‘আমি অনেক কাজেই বাণিজ্য ব্যবহার করেছি, কিন্তু যুদ্ধ থামাতে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই।’ ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রেও এর আগে এ ধরনের শুল্ক ব্যবহার করেছিল ট্রাম্প প্রশাসন। তবে রাশিয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের পরোক্ষ শুল্ক আরোপ বিশ্ব অর্থনীতিতে আরও বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদক রাশিয়া। সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের পরেই তার স্থান। তবে ২০২৫ সালে তার জ্বালানি রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ। এই প্রেক্ষাপটে ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের কিয়ারান টমকিনস বলেন, রাশিয়ার জ্বালানি কেনে—এমন দেশগুলোর ওপর পরোক্ষ শুল্ক আরোপ করা হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে জ্বালানির দামের মাধ্যমে। এই শুল্ক কার্যকর হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির সরবরাহ কমবে। ফলে দাম বাড়বে।

২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের সময় ঠিক এমনটাই ঘটেছিল—বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল। যদিও এবার ট্রাম্প বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড পরিমাণ তেল উৎপাদনের কারণে তিনি চিন্তিত নন। এ ছাড়া ওপেক ও সহযোগী দেশগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদনের সক্ষমতা থাকায় বাজার কিছুটা স্থিতিশীল থাকতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কৌশল

রাশিয়া ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা এড়াতে একধরনের ছায়া নৌবহর তৈরি করেছে—মালিকানাবিহীন শত শত ট্যাংকারের মাধ্যমে তাদের তেল–বাণিজ্য চলছে। এই ‘শ্যাডো ফ্লিট’ রাশিয়ার তেল-গ্যাস রপ্তানির প্রক্রিয়া গোপন রাখতে সাহায্য করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড নেফিউ বলেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়েও বড় কাজ হলো তার বাস্তবায়ন। কারণ, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তারা তা এড়াতে সব রকম চেষ্টা করে।

ভারতীয় আইফোন আমদানিতে দ্বিগুণ শুল্ক

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল ক্রেতা হয়ে ওঠে ভারত। ট্রাম্প এ বিষয়ে সম্প্রতি সিএনবিসিকে বলেন, তারা যুদ্ধযন্ত্রে জ্বালানি দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে তাঁর খুশি হওয়ার অবকাশ নেই।

এই পরোক্ষ শুল্ক কার্যকর হলে ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হবে। এর প্রভাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য উৎস থেকে পণ্য কিনতে উৎসাহিত হবে। ফলে ভারতের রপ্তানি কমবে। এতে ভারত রাশিয়ার তেল কেনার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে—এটিই হচ্ছে যুক্তি।

বিশেষ করে অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান এখন ভারতেই আইফোন তৈরি করে আমেরিকায় রপ্তানি করছে—সেই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। কারণ, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোই এই শুল্ক পরিশোধ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই অতিরিক্ত খরচ গ্রাহকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ভারতীয় পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আছে। এই শুল্ক আরও অনেকটা বাড়ানো হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প।

ভারত এই পদক্ষেপকে দ্বিমুখী নীতি হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশটি এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এখনো রাশিয়ার কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানির কাঁচামাল ও সার আমদানি করছে—২০২৪ সালে এর পরিমাণ ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

চীনের সঙ্গে নতুন সংঘাত

রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা হলো চীন। কিন্তু চীনা পণ্যের ওপর একই রকম পরোক্ষ শুল্ক আরোপ করা অনেক জটিল হবে। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে প্রতিবছর ভারতের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি পণ্য আমদানি করে—বেশির ভাগই খেলনা, পোশাক ও ইলেকট্রনিক পণ্য।

এমন পদক্ষেপ ট্রাম্প-চিন পিং বাণিজ্য আলোচনায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আইএমডি বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক সাইমন ইভেনেট বলেন, এই অতিরিক্ত চাপে চীন মোটেও প্রভাবিত হবে না; বরং দুই দেশের সম্পর্ক আরও তলানিতে যাবে।

ইউরোপকেও ভুগতে হবে

ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্ক এখনো রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ জ্বালানি ক্রেতা। ২০২২ সালের পর ইউরোপ অনেকটা আমদানি কমিয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।

ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন সম্প্রতি বলেছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাণিজ্যের বাতাবরণ বিশ্বের সবচেয়ে বড়। নতুন করে ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপসহ তাদের মধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে। এখন যদি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে আবার ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়, তাহলে ইউরোপীয় রপ্তানিকারকেরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ওষুধ ও যন্ত্রপাতি হয়তো অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করা কঠিন হবে। ফলে মার্কিনরাও বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য হবেন।

রাশিয়া কি মন্দার কবলে পড়বে

২০২৪ সালে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই দাবি করলেও দেশটির অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেতনিকভ সম্প্রতি বলেছেন, অর্থনীতি এখন মন্দার দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএ) পূর্বাভাস, ২০২৫ সালে রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

যুদ্ধের প্রকৃত প্রভাব নিরূপণ করা কঠিন। কেননা, মস্কো অনেক অর্থনৈতিক তথ্য গোপন রেখেছে, বিশেষ করে তেল ও গ্যাস উৎপাদনসংক্রান্ত।

বর্তমানে রাশিয়ার সরকারি ব্যয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে জ্বালানি খাত থেকে। কিন্তু তাদের রপ্তানি কমছে এবং একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বাড়ছে-স্নায়ুযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ বা জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার অর্থনীতি অনেক বড়। ইউক্রেনকে যুদ্ধে টিকে থাকতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা প্রয়োজন হচ্ছে—জিডিপির ২৬ শতাংশ যুদ্ধে খরচ করছে তারা।

এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের নতুন শুল্কের উদ্দেশ্য হলো রাশিয়ার অর্থপ্রবাহ কমিয়ে ইউক্রেনকে সহায়তা করা এবং শেষমেশ এই রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা বন্ধ করা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র শ শ ল ক আর প ইউক র ন ইউর প সবচ য় আমদ ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে 

বাংলাদেশে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এক বছরে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থার প্রতিফলন দেখা গেছে।

বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সম্প্রতি যেসব দেশে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে, সেসব দেশে পরবর্তী এক বছরে এফডিআই উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পর এফডিআই কমেছে ১৯.৪৯ শতাংশ, চিলিতে ২০১৯ সালের পর কমেছে ১৫.৬৮ শতাংশ, সুদানে ২০২১ সালের পর ২৭.৬০ শতাংশ, ইউক্রেনে ২০১৪ সালের পর ৮১.২১ শতাংশ, মিশরে ২০১১ সালের পর ১০৭.৫৫ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৯৮ সালের পর ১৫১.৪৯ শতাংশ কমেছে। এই ধারাবাহিক হ্রাসের মধ্যে বাংলাদেশে এফডিআইর ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধির চিত্র বিশেষভাবে নজরকাড়া।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গুণ হলো—শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অর্থনীতিকে পুনরায় চালু করার অদ্ভুত ক্ষমতা। এই পরিসংখ্যান তার দারুন একটা প্রতিফলন। সাধারণত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়, কিন্তু আমরা উল্টা দেখছি। সঠিক নীতি নির্ধারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার আন্তরিকতা এবং প্রাইভেট সেক্টরের অদম্য স্পৃহা কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা সব সময় বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সব সমস্যার সমাধান হয়নি, তবে সদিচ্ছার কোনো ত্রুটি ছিল না। শিগগিই সারা বছরের একটি আমলনামা (রিপোর্ট কার্ড) প্রকাশ করা হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৪৮৮ দশমিক ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭০ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ হয় ৯২৪ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার, তবে ২০২৪ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৬৭৬ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই ধারা বজায় থাকা অত্যন্ত ইতিবাচক। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, দীর্ঘমেয়াদি নীতি সহায়তা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকা/নাজমুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নিউ ইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়রের মাকে কতটা জানেন?
  • বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে