দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানির পরিমাণ ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। উচ্চ প্রযুক্তির ওষুধ উৎপাদন করে রপ্তানি করলেও অপেক্ষাকৃত সহজ প্রযুক্তির কীটনাশক উৎপাদনে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

কৃষিনির্ভর দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ দেশের কীটনাশকের চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। অথচ গত পাঁচ দশকে দেশে কৃষি উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি এ সময়ে কীটনাশকের ব্যবহারও বেড়ে হয়েছে প্রায় ১০ গুণ। কিন্তু কীটনাশকের আমদানিনির্ভরতার কারণে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণে কীটনাশক বাবদ কৃষকের খরচ বাড়ছে। তাতে কৃষির উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি খাতের বিশ্লেষকেরা বলছেন, বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে খাতটি এখনো আমদানিনির্ভর। কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে কঠিন শর্তের কারণে কীটনাশক উৎপাদনে আগ্রহ কম। কীটনাশক উৎপাদনের চেয়ে আমদানি অনেক সহজ। তাই স্থানীয়ভাবে কীটনাশকের উৎপাদন বাড়াতে হলে সরকারকে এ খাতে নীতিসহায়তা দিতে হবে।

আমরা একচেটিয়া কোনো ব্যবসা চাই না, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ চাই। কিন্তু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের আধিপত্য তৈরি করেছে। তাই বিপুল বিনিয়োগ করেও আমরা দেশে সালফার উৎপাদন করতে পারছি নাআনিস-উদ-দৌলা, চেয়ারম্যান, এসিআই গ্রুপ

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে রয়েছে উচ্চ শুল্কহার। উচ্চ শুল্কে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে কীটনাশক উৎপাদনের চেয়ে আমদানি করা অনেক সহজ ও লাভজনক। তাই দেশে কীটনাশকের উৎপাদন বাড়াতে হলে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে। আমদানি করা কীটনাশকের দামও অনেক বেশি পড়ে। এতে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তাই স্থানীয়ভাবে কীটনাশক উৎপাদনে সরকারের নীতিসহায়তার পাশাপাশি প্রয়োজনে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত।

ব্যবহার বাড়ছে

কীটনাশক নিয়ে কাজ করা অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড বায়োসায়েন্স ইন্টারন্যাশনালের (কেবি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল মাত্র চার হাজার টন। এখন তা বেড়ে ৪০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে, অর্থাৎ পাঁচ দশকের ব্যবধানে কীটনাশকের ব্যবহার বেড়ে ১০ গুণ হয়েছে। ১৯৯৭ সালেও দেশে কীটনাশকের ব্যবহার ছিল ১১ হাজার ৩৬৭ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২২ সালে দেশে কীটনাশক আমদানির পরিমাণ ছিল ৩৯ হাজার ২৮৩ টন।

বাজারের আকার

দেশের কীটনাশক উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাগ্রো কেমিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বামা)। সংগঠনটির হিসাবে, বর্তমানে দেশে কীটনাশকের বাজার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার। যার ৫৫ শতাংশ বা ৪ হাজার ১২৫ কোটি টাকার বাজার রয়েছে সাতটি বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। আর স্থানীয় আমদানিকারকেরা চাহিদার প্রায় ৪১ শতাংশ বা ৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকার কীটনাশক আমদানি করছে। কীটনাশকের বাজারে দেশি উৎপাদনকারীদের হিস্যা মাত্র ৪ শতাংশ বা ৩০০ কোটি টাকার। তবে কেবির হিসাবে, এই দেশের কীটনাশকের বাজারের আকার পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

স্থানীয়ভাবে কীটনাশক উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে না আসার জন্য নীতি দুর্বলতা, নীতিসহায়তার অভাব ও নিবন্ধন জটিলতাকে বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করছে কীটনাশক উৎপাদনকারীদের সংগঠন বামা।

দেশে এখন কীটনাশক আমদানিকারকের সংখ্যা সাত শতাধিক। ২০১০ সালেও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫০। তবে বামার হিসাবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এখন ৯৫০টির বেশি। মূলত শুল্কনীতি আমদানিবান্ধব হওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করছে সংগঠনটি। হাজারখানেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কীটনাশকের স্থানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২২।

কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে রয়েছে উচ্চ শুল্কহার। উচ্চ শুল্কে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে কীটনাশক উৎপাদনের চেয়ে আমদানি করা অনেক সহজ ও লাভজনক। উৎপাদন বাড়াতে হলে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবেজাহাঙ্গীর আলম, সাবেক মহাপরিচালক, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট  

আমদানিনির্ভরতার কারণ

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কীটনাশকের আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার ৫ শতাংশ। এর বিপরীতে কীটনাশক উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার ৩০ থেকে ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত। এ কারণে চাহিদার বড় অংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বামার সভাপতি কে এস মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুল্ক ও অশুল্ক বাধার কারণে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এসব বাধা দূর করা গেলে ওষুধের মতো কীটনাশকের আমদানি প্রয়োজন হবে না। এতে কীটনাশকের দামও ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে কীটনাশকের মান নিয়ন্ত্রণও সহজ হবে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের নির্দিষ্ট করে দেওয়া কিছু দেশ থেকে প্রতিযোগিতা ছাড়া বেশি দামে কাঁচামাল আনতে হয়। কিন্তু আমদানিকারকদের জন্য উৎস উন্মুক্ত থাকায় যেকোনো দেশ থেকে তাঁরা কম দামে কীটনাশক আমদানির সুযোগ পান। এ ছাড়া শুল্কনীতিও বৈষম্যমূলক।’

উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয়

বামার তথ্যমতে, চীনে আমদানি করা কীটনাশক ও কীটনাশকের কাঁচামালের মধ্যে শুল্ক পার্থক্য ৪০ শতাংশ। ভারতে তা ৩০ শতাংশ। ফলে দেশ দুটি নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের প্রায় ৬৫ শতাংশ কীটনাশকের জোগান দিয়ে থাকে। তাই কীটনাশকের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছে সংগঠনটি।

কীটনাশকের কাঁচামালের উৎস উন্মুক্ত করা হচ্ছে না কেন—জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো.

ছাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, উৎস উন্মুক্ত করার দাবির বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে আমদানিনির্ভরতা কমানো উচিত।

বিশ্বে এখন কীটনাশকের বাজার প্রায় ৮৫ বিলিয়ন বা সাড়ে ৮ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী দেশ চীন। এরপর উৎপাদনে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত ও জাপান।

এদিকে কীটনাশকের বাজারকে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করতে চলতি মাসে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসিআই গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বামার প্রধান উপদেষ্টা আনিস-উদ-দৌলার নেতৃত্বে এ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে আনিস-উদ-দৌলা প্রথম আলোকে বলেন, আমরা কমিটির পক্ষ থেকে কৃষি এবং বাণিজ্য উপদষ্টা ও সচিবের সঙ্গে দেখা করে আমাদের সমস্যার কথা বলব। আমরা একচেটিয়া কোনো ব্যবসা চাই না, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ চাই। কিন্তু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের আধিপত্য তৈরি করেছে। তাই বিপুল বিনিয়োগ করেও আমরা দেশে সালফার উৎপাদন করতে পারছি না। কারণ, কাঁচামাল আমদানিতে বেশি হারে শুল্ক দিতে হয়। আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তি আছে, তাই বিদেশিদের দারস্থ হওয়ার দরকার নেই। আমরা এ খাতে ওষুধ খাতের পর্যায়ে যেতে চাই। তাই কৃত্রিম বাধাগুলো দূর করা দরকার। জাতীয় স্বার্থে দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া উচিত।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে কৃষিপণ্য উৎপাদনে মোট উপকরণ ব্যয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশ খরচ হয় কীটনাশকের পেছনে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ম ল আমদ ন ত প রথম আল ক উৎপ দনক র ক আমদ ন ব যবহ র স গঠন

এছাড়াও পড়ুন:

স্ত্রীকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগ, স্বামী পলাতক

গাইবান্ধায় শিউলী বেগম নামে এক গৃহবধূকে গলা কেটে হত্যার পর মরদেহ বাড়ির পাশের একটি কলাবাগানে ফেলে পালানোর অভিযোগ উঠেছে স্বামী ফরিদ উদ্দীনের (৪৫) বিরুদ্ধে।

শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টার দিকে উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়নের কাটাবাড়ী গ্রামের বাগদা বাজার টাওয়ার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহত শিউলী বেগম কাটাবাড়ী গ্রামের মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে ফরিদ উদ্দীনের দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি একই ইউনিয়নের বোগদহ সদর কলোনী এলাকার শরীফ ড্রাইভারের মেয়ে। তাদের সংসারে একটি ৮ বছরের ছেলে সন্তান রয়েছে। প্রায় ১২ বছর আগে শিউলী ও ফরিদের বিয়ে হয়। এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করেন ফরিদ। ফরিদের প্রথম স্ত্রীর ঘরেও দুই সন্তান রয়েছে।

পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই নানা কারণে শিউলীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন ফরিদ। শনিবার সন্ধ্যায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধে। এক পর্যায়ে ফরিদ শিউলীকে মারধর করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে মরদেহ বাড়ির পাশে কলাবাগানে ফেলে রেখে পালিয়ে যান তিনি। প্রতিবেশীরা বিষয়টি দেখে পুলিশকে খবর দেন। 

খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) রশিদুল বারী।

নিহত শিউলীর বাবা শরীফ মিয়া ড্রাইভার ও স্বজনদের অভিযোগ, বিয়ের পর থেকে প্রায় সময় মেয়েকে (শিউলি) বিভিন্ন অজুহাতে গায়ে হাত তুলতেন ফরিদ। শিউলীকে হত্যা করে বাড়ির পাশের কলাবাগানে ফেলে রেখে পালিয়েছে সে। দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তাদের। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে গোবিন্দগঞ্জ থানার (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা (ওসি) বুলবুল ইসলাম জানান, ফরিদের প্রথম স্ত্রী রয়েছে। শিউলী ফরিদের দ্বিতীয় স্ত্রী। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হতো। নিহতের গলা ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন আছে। মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য রবিবার সকালে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ফরিদ ঘটনার পর থেকেই পলাতক। তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে।

ঢাকা/মাসুম/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ