চোখে আলো নেই, হৃদয়ে তার জ্বলে এক অন্যরকম দীপ্তি। অন্ধত্ব তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি, বরং ছুঁয়েই শিখেছেন, তৈরি করেছেন নিজের কাজের এক দারুণ জগৎ। দৃষ্টির অভাবকে শক্তিতে রূপ দিয়ে গড়ে তুলেছেন নিজের একটা কর্মজগৎ। যেখানে হস্তশিল্পই তার হাতিয়ার, আর আত্মনির্ভরতা তার প্রতিজ্ঞা। 

প্রতিকূলতাকে জয় করে, একা হাতে সংসারের হাল ধরেছেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের কর্ণগাঁও গ্রামের দৃষ্টিহীন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস (৩২)।

এই হতদরিদ্র মৃত্যুঞ্জয় দুই চোখে দেখতে পান না, চাইলেই হতাশায় ডুবে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন সংগ্রামের পথ। বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র তৈরি করাই তার পেশা।

স্পর্শ আর অনুভবে প্রতিদিনই তৈরি করেছেন কুলা, চাটাই, চাঙারি, টুকরি, উড়া, ডালা, চালুনি কিংবা মাছ ধরার খলই। এমনকি হাঁস-মুরগির খাঁচাও তার হাতের কারুকার্যে হয়ে উঠে দারুণ শৈল্পিক। এটিই তার রুটিরুজির মাধ্যম। বর্তমানে তার পরিবারের কেউ আর অভুক্ত থাকে না; বরং তার শ্রমেই চলছে সংসারের চাকা।

মৃত্যুঞ্জয়ের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, কর্ণগাঁও গ্রামের বীরেন্দ্র বিশ্বাসের ছেলে তিনি। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বর্তমানে স্ত্রী-সন্তান, বৃদ্ধ বাবা মা ও এক ছোট ভাইকে নিয়েই পাঁচ সদস্যের পরিবার। জন্মের পর সব ঠিকঠাক ছিল তার। ১২ বছর বয়সে মাথা ব্যাথা থেকে প্রথমে এক চোখে ব্যাথা হতো। সিলেটে চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। প্রাথমিক কিছু চিকিৎসা দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে এক পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। পরে বাম চোখের আলো হারিয়ে আস্তে আস্তে ডান চোখেরও আলো হারিয়ে একদম অন্ধ হয়ে যান। তখন অচল হয়ে পড়েন।

অভাবের তাড়নায় ছোট বেলা থেকেই মা-বাবার সাথে বাড়িতে হস্তশিল্পে জড়িয়ে পড়েন তিনি। যখন দুই চোখেরও আলো হারিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়, তখন তিনি চোখ ছাড়াই স্বপ্ন দেখেন নতুন এক জীবনের। চোখে না দেখেও শুধু অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দক্ষ হাতে বাঁশ ও বেতের কাজ শুরু করেন তিনি। তার তৈরি বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র বিক্রি করেই চলছে তার পরিবারের জীবিকা। কঠোর পরিশ্রম আর মনের জোরেই আজ নিজের পরিবারকে টেনে নিচ্ছেন তিনি। তার এই অদম্য মনোবল ও আত্মনির্ভরশীলতা এখন অনেকের জন্যই অনুপ্রেরণা।

হতদরিদ্র এই দৃষ্টিহীন মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিনি তার আপন গতিতে, নিঃশব্দে ও গভীর দরদ দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যেখানে প্রতিটি কাজেই ফুটে উঠছে তার নিষ্ঠা আর ভালোবাসা। এসময় তার সাথে কথা হয় ‘রাইজিংবিডির’।

তিনি বলেন, “মূলত ঘটনা আমার মাথা ব্যাথা থেকে, যখন আমার ১২ বছর ছিলো তখন বাম চোখ নষ্ট হয়। সিলেট গেলাম চিকিৎসা করলাম-ডাক্তার বলেছিলো তোমার নষ্ট হয়েছে। ওষুধ খেয়েছিলাম কিন্তু লাভ হয়নি, এর পর ১৮ বছর বয়সে আস্তে আস্তে ডান চোখেও ধেরে ফেলে। এক সময় একেবারেই অন্ধ হয়ে যাই।”

বাঁশ ও বেতের কাজ কীভাবে কখন শিখলেন প্রশ্নের জবাবে বলেন, “এই কাজটা আমি আগেই নিজ চেষ্টায় শিখেছিলাম। পরে আমি চোখ হারানোর পর চেষ্টা চালিয়ে গেছি। কিন্তু মানুষ বলেছে আমার হাতের কাজ নাকি খুব সুন্দর হয়। কিন্তু আমার দুঃখ নিজের হাতের বানানো জিনিসপত্র নিজেই দেখতে পারি না।” 

জীবনের কঠিন বাস্তবতা সঙ্গে নিয়ে দুর্বিষহ কষ্টে ভরা মৃত্যুঞ্জয়ের যাত্রা। দৃষ্টিহীন ও দারিদ্রের মতো সমস্যায় প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। এর মাঝেই যদি আরেকটি বড় বিপদ নেমে আসে। তখন জীবন যেন এক অসহনীয় বোঝায় পরিণত হয়, যেখানে বেঁচে থাকাটাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তেমনই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের জীবন।

কান্নাভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, “কষ্ট এইটাই অসহায় হয়ে পড়েছি। আগের মত আর কাজ কাম করতে পারি না, শরীরে রোগে ধরেছে। অভাবের সংসার। কারো পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগীতা পাই না। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চড়া মূল্যের বাজারে বাঁশ ও বেতের তৈরির জিনিস গুলো অল্প মূল্য বিক্রি করে চলছে জীবন। এখন দাবি সরকারের কাছে সরকার যদি আমাকে সাহায্য করে তাহলে আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারব।”

বর্তমানে মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের বাঁশ ও বেতের কাজের জন্য উপজেলার আক্তাপাড়া এলাকা থেকে বাঁশ কিনে এনে কেটে কাজের উপযোগী করে দিচ্ছেন তার মা সুচিত্রা বিশ্বাস। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, “আমার ছেলেটা অনেক কষ্টের মধ্যে পড়েছে। আগে সে একা একাই কাজ করছে, পরিবারে লোক সংখ্যাও কম ছিলো। এখন পরিবার বড় হচ্ছে কিন্তু আয় রুজি বাড়ছে না। বর্তমানে টুকরি, উড়া, ডালা বানিয়ে আর বিক্রি করে সংসার চলছে না। এর মধ্যে দিন দিন সেও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তার চলার কোনো পথই নেই। তিনি জানান আগে আগে কেউ কেউ আসছে দেখে গেছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কারো সহযোগীতা পাচ্ছে না। এমনকি বন্যায় আমাদের ঘর একেবারে ভেঙে গেছে, তাও কেউ দেখেনি।” 

একই গ্রামের বাসিন্দা সুশঙ্কর দেবনাথ বলেন, “আমাদের পাশের বাড়ির মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাস ছেলে হিসেবে সে খুবই ভালো। কিন্তু তার চোখ দুইটা নেই। বাঁশের বেত দিয়ে কিছু কাজ করে চলে সে। তার বাচ্চাও আছে একজন। সরকারি কোনো সাহায্য সহযোগীতা পায় না। আমরা চাই মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসকে যদি একটু সহযোগীতা করে সরকারে। আমাদের সবাইকে তো আল্লাহ ভালো রেখেছেন সে তো অন্ধ। তার কষ্ট দেখলে আমাদের খারাপ লাগে।”

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, “আমরা এরইমধ্যে জেনেছি, একজন অন্ধ ব্যক্তি যিনি প্রতিবন্ধিতার সত্ত্বেও বাঁশ আর বেত দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে সক্ষম। তবে আর্থিকভাবে সে সমস্যায় আছে জেনেছি। আমরা যদি আবেদন পাই তাহলে আমরা সহায়তা প্রদান করব। পাশাপাশি আমরা এনজিও গুলোকেও অনুরোধ করব যে তারা যেনো প্রয়োজনে প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে।”

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম ত য ঞ জয় ব শ ব স জ ন সপত র র পর ব র সহয গ ত আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

গভীরতার প্রয়াস দেখি না, শুধু উপরতলে ভাসছি: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক, সাহিত্য-সমালোচক, শিল্প-আলোচক এবং অনুবাদক―নানা অভিধায় সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে চিহ্নিত করা যায়। দেশে শিক্ষার বিস্তার এবং গণতান্ত্রিক-মানবিক ধারার বিকাশে তাঁর ভূমিকা অনন্য। একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পাঠক সমাবেশের ‘মঙ্গল সমাবেশ’ আড্ডার উদ্বোধনী পর্বে মধ্যমণি হয়ে এসেছিলেন। সেখানে তিনি শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন। আড্ডাটি সঞ্চালনা করেন মোজাফ্ফর হোসেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সম্প্রতি অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর এই অকাল অন্তর্ধানে তাঁকে স্মরণ করে আড্ডার নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হলো। অনুলিখন করেছেন শাহাদাত হোসেন তৌহিদ। 

প্রশ্ন: স্যার, এই আড্ডার আয়োজন কেমন লাগছে? এই যে আমরা বসতে চাচ্ছি আপনাদের নিয়ে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমার তো নিজের কাছে একটু কুণ্ঠাই লাগছে। যদি অন্য কাউকে দিয়ে শুরু করতে, আমার ভালো লাগত। আমি অবশ্য খুবই আড্ডাঅন্তপ্রাণ মানুষ। আড্ডাটা আমি মনে করি বাঙালি সংস্কৃতির ভেতরের জিনিস। আমি ছোটবেলা থেকেই আড্ডাতে খুব অভ্যস্থ। এখন তো মানুষ ফেসবুকে আড্ডা দেয়। নিজের মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। চার পাঁচজন মিলে আড্ডা দিচ্ছে―এরকম দেখাই যায় না। দ্বিতীয়ত, আড্ডাটা এখন অনেক সময় কোলাহল-ঝগড়া অথবা বিবাদে পরিণত হয়। প্রাণময় আড্ডা খুব একটা দেখতে পাই না। কিন্তু আমাদের সময় ছিল।

প্রশ্ন: স্যার, আপনি ফেসবুকের কথা বলছেন, আপনি ফেসবুকে আড়িপাতার মতো করে থাকেন। আমরা ভয়ে-শঙ্কায় থাকি (সহাস্যে)।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আড়িপাতা না, এটাকে স্টকিং বলে (সহাস্যে)। ফেসবুকে আমি যাই, দেখি। মাঝে মাঝে আমার ইনবক্সে অনেক কাজের জিনিস আসে। ফেসবুকের ভালো-মন্দ দুটো দিক তো আছেই। যে কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভালো-মন্দের মিশ্রণ নিয়ে হাজির হয়। আমি ভালোটা দেখার চেষ্টা করি, মন্দের হাতে পড়লে সময় নষ্ট হয়। সময়টাই এখন আমার কাছে সাংঘাতিক মূল্যবান, সে জন্য আমি খুব বেশিক্ষণ ফেসবুকে থাকতে চাই না। আর আমি যদি পোস্ট দিতে শুরু করি, ছবি আপলোড দিই, অনেক সময় চলে যাবে! তারপর সেটার জন্য মানুষজন একটা উত্তর দিলো, তারও আবার প্রতিউত্তরের আশা করবে। সমস্ত দিন চলে যাবে। আমি যাই রাত একটা দুইটার দিকে। পনেরো-বিশ মিনিট থাকি। তাও প্রতিদিন সুযোগ হয় না।

প্রশ্ন: তারপরও দেখি ফেসবুকভিত্তিক আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে যে আলোচনা হয়, আপনি তার কিছুই মিস করেন না!

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আমি একবার দেখে নিই। যেহেতু উত্তর দেওয়ার কোনো দায় থাকে না, খুব দ্রুত আমি দেখতে পারি। যেগুলি নিজস্ব বিজ্ঞাপন, রান্নার বিশাল ছবি দিয়ে দেয়―এ ধরনের পোস্ট একদম এড়িয়ে যাই। ফলে আঙুল খুব দ্রুত যায়। তবে যেগুলি একটু মূল্যবান সেগুলো আমি যতœ করেই দেখি। অনেক কিছু শেখার আছে, অনেক বিষয়ে নতুন জ্ঞান তৈরি হয়। তোমাদের লেখালেখি তো খুব সুন্দর লাগে। একটা প্রতিবাদী চরিত্র, সামাজিক অসঙ্গতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে তোমরা যখন লেখ, আমার পড়তে ভালো লাগে। কারণ জীবনের একটা উত্তাপ, সমকালীন একটা উত্তাপ থাকা জরুরি। 

প্রশ্ন: স্যার, এটা আপনি অনুভব করেন কিনা, আগে অ্যাক্টিভিজমের জায়গা ছিল রাজপথ। আপনাদের ৭০-৮০-৯০ দশক পর্যন্ত আন্দোলন হতো মাঠকেন্দ্রিক। এখন ফেসবুকও একটা প্লাটফরম, যেখানে আমরা যে কোনো ইস্যুতে আমাদের প্রোটেস্ট করতে পারি। ফেসবুকে কিছু লিখলে তো নতুন প্রজন্মের কাছে আপনার বার্তাটা পৌঁছাবে!

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: আসলে অভ্যাসের বিষয়। সময় পাল্টায়, সংস্কৃৃতিও পাল্টায়। তখন আমাদের দৃশ্যসংস্কৃতি ছিল না। ফলে আমাদের সবকিছু ছিল লেখালেখিকেন্দ্রিক। আমাদের পড়তে হতো, শুনতে হতো। ফলে আমাদের সক্রিয়তা যেটা ছিল রাজনৈতিক সক্রিয়তা, সেটি জোরেশোরে আমাদের শ্লোগান দিয়েই প্রকাশ করতে হতো, দৃশ্যমান হতেই হতো, রাস্তায় বের হতেই হতো। এটি ছিল সময়ের দাবি। এখন দৃশ্যমাধ্যম চলে আসায় পাটাতন বদলে গেছে। এখন দৃশ্যমাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সক্রিয়তাগুলো দেখাতে পারি। কিন্তু তার জন্য যে প্রস্তুতি থাকা দরকার, সেই প্রস্তুতিটা আমার আসলে নেই। আমি অত প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ নই, প্রযুক্তি ছাড়াই থাকতে চেষ্টা করি। প্রযুক্তিবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করছি। সেটা অবশ্যই কঠিন একটা কাজ। তোমরা যেভাবে দ্রুত লিখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পার, আমি সেই চরিত্রের মানুষও না। আমার প্রতিক্রিয়া দেখানোর একটা সময় লাগে। কারণ আমি আত্মস্থ করতে চাই বিষয়টা। যে কোনো বিষয় কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেষ্টা করি। তারপর আমি একটা প্রতিক্রিয়া জানাই। না হলে আমাদের দেশে বিভেদের সৃষ্টি হয়ে যায়। তোমরা যতই বলো, তোমাদের বিপরীত মতগুলোর তো কোনো যুক্তি নেই। আমি এমন কোনো তর্কে যাব না, যেখানে আমি একপক্ষে যুক্তির কথা বলছি আর অন্যপক্ষ শুধু অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছে। অন্ধ আবেগ, উগ্রতা অথবা হিংস্রতা―যেখানে যুক্তি চলে না। আমি মাধ্যমের দোষ দিচ্ছি না, ব্যক্তি তো বদলে গেছে। আমি মনে করি, যতদিন পড়াশোনাটা ছিল ততদিন মানুষ চিন্তা-ভাবনা করত। বই হাতে নিলে তো মানুষের চিন্তার একটা সূত্রপাত হয়। 

প্রশ্ন: যখন আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আপনারা আড্ডা দিতেন। বিশেষ করে আপনার বন্ধু হেলাল হাফিজের কথা যদি বলি―আলোচনার সূত্রটা যদি এখান থেকে ধরি। 

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এখন অনেকের কাছে বিস্ময়কর লাগতে পারে যে, একটা ছোট্ট চায়ের দোকান কীভাবে অনেক মানুষকে জাগাতে পারে। নাম ছিল ‘শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৮-৬৯ উত্তাল সময়। গণআন্দোলন হচ্ছে তখন। সেই সময় মধুর ক্যান্টিন ছিল একেবারেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের পদচারণার জায়গা। এখন যেরকম ভয়ের একটা পরিবেশ থাকে, তখন কিন্তু সেরকম ছিল না। ছাত্রনেতারা যারা ছিলেন―তোফায়েল আহমেদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন রিকশায় চড়ে হল থেকে আসতেন। তারা নেমে কে ভাড়াটা দেবেন সেটা নিয়ে মধুর তর্ক লেগে যেত। এখন দেখি ছাত্রনেতারা গাড়ি করে এসে নামে, তাদের এক-দুইশ মোটরসাইকেল পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে―কল্পনাই করা যায় না! 

তখন মধুর ক্যান্টিনে আমরা যেতাম না। কারণ তাদের রাজনৈতিক একটা সক্রিয়তার আবর্তে পড়ে আমাদের দিনটা মাঠে মারা যাবে। মধুর ক্যান্টিন ছেড়ে আমরা যেতাম শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে। সেখানে আট আনা দিয়ে বিরিয়ানি পাওয়া যেত। আট আনা তখন অনেক টাকা। তাও আমি কষ্ট করে খরচ করতাম। কারণ আট আনার বিরিয়ানি খেতে খেতে অনেক কিছু শুনতাম সাহিত্য সম্পর্কে―সরাসরি কবিদের মুখ থেকে, নিজেদের লেখা সম্পর্কেও তারা অনেক কথা বলতেন।

প্রশ্ন: কারা কারা যেতেন?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কে যেতেন না? মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, নুরুল হুদা―নাম বলে শেষ করা যাবে না। আমরা পেছনের দিকে জায়গা পেতাম। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়েছি। শুনতাম, একজন প্রশ্ন করছেন আরেকজনকে―তোমার এ কবিতাটা ভালো লাগেনি, তোমার ওটা ছন্দ হয়নি। তিনি ছন্দের ওপর একটা পাঠ দিয়ে দিলেন। কান খাড়া করে শুনতাম আমরা। আবুল হাসানকে বলা হলো, তোমার কবিতার নাম ‘পৃথক পালঙ্ক’ কেন দিলে? তিনি তখন ইতিহাসটা বললেন। জানা হয়ে গেল আমার। এই আড্ডা তো আর পাওয়া যাবে না। তারপর আমাদের সর্বশেষ আড্ডা ছিল প্রগতি প্রকাশনী নামে নিউমার্কেটের একটি বইয়ের দোকানে। কবির খান ছিলেন প্রকাশক। আমার প্রথম বাংলাদেশি বই ‘থাকা না থাকার গল্প’র প্রকাশক ছিলেন কবির খান। তার ৮ বাই ৬ ফুট দোকান, সেখানে ১০ থেকে ১২ জন বসে আড্ডা দেওয়া যেত। মনজুরে মওলা থেকে শুরু করে মহাদেব সাহা সবাই আসতেন। হুমায়ুন আজাদ মাঝেমধ্যে ঢুকতেন এবং একটা করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতেন। হা হা হা। এই আড্ডাগুলোতে প্রচুর জিনিস শেখা যেত। কারণ তুমি যদি তোমার লেখা সম্পর্কে কোথাও আন্তরিকভাবে কথা বলো―অনানুষ্ঠানিক একটা জায়গায়, তখন কিন্তু অনেক বেশি অন্তরঙ্গভাবে তোমাকে জানা সম্ভব হয়। আর তুমি লিখতে বসলে তখন অনেক সতর্ক হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: প্রগতি সাহিত্যের ব্যাখ্যা কী?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : প্রগতি সাহিত্যের ব্যাখ্যা সবার কাছে এক না। যারা প্রগতির পক্ষে থাকে তারা জানবে কোনটা প্রগতি। তাদের সংজ্ঞা দিতে হবে না। যেমন সুস্থতা। কোনো ডাক্তার বলবে না যে আপনাকে সুস্থ মনে হচ্ছে। কারণ আমি জানি তো আমি সুস্থ। আপনার কাছে অসুস্থ হলে যাব আমি। তো ডাক্তারের কাছে অসুস্থতার সংজ্ঞা আছে। সুস্থতার সংজ্ঞা একই যে অসুস্থতা নেই। এটাই হচ্ছে আপনার সুস্থতা। মানে আমি প্রগতির পক্ষে আছি এটাই আমার প্রগতি। যারা প্রগতির বিপক্ষে থাকে, তারা প্রগতিকে নানানভাবে বিপদগ্রস্ত করার জন্য বা এটাকে প্রবলেমাটাইজ করার জন্য হয়তো বলবে যে প্রগতি জিনিস আপনি কী বুঝেন? এটাই কি প্রগতি? একজন হয়তো আমাকে বলবে যে, দেশের উন্নয়নটাই কি প্রগতি? আমি বলব, না। আমার বিচারে প্রগতি হচ্ছে যার চিন্তাটা খুব স্বচ্ছ। যে সময়ের সঙ্গে চলতে পারে। যার একটা বৈশ্বিক দৃষ্টি আছে। যার ভেতর উদারনীতি আছে, যে সাম্প্রদায়িক না, সংকীর্ণমনা না―এইতো। আমি দশ-বারোটা দিলাম, আরও দশ-বারোটা দিতে পারবে মোজাফ্ফর। কিন্তু যারা প্রগতির পক্ষে নেই তারা কিন্তু এগুলিকেই প্রবলেমাটাইজ করে ফেলবে। তারা বলবে যে, সংকীর্ণ বলতে আপনি কী বোঝেন? আমি তো এই বিষয়টা বলছি। ওটা তো ওখানে আছে, নানা রকমের রেফারেন্স দেবে। কিন্তু প্রগতির বিপক্ষের সাহিত্য যারা রচনা করছে, তারা একটা সাব-কালচারেরর মধ্যে ডুবে গেছে। সাব-কালচারও বলা যায় না, এটা কাউন্টার কালচার, যার স্থায়িত্ব খুব বেশি দিনের হয় না। এগুলি পড়ে পড়ে তাদের মনটা কি খুব পরিষ্কার হচ্ছে?

প্রশ্ন: ষাট-সত্তর দশক বা তারও আগে হুমায়ুন আজাদরা প্রগতির কথা বলেছেন, এখন কি সে কথাগুলো বলতে পারব? বলার মতো পরিস্থিতি আছে?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এখানে আমার একটা দ্বিমত আছে। আমি যখন এই রাস্তা দিয়ে হাঁটি তখন একভাবে কথা বলি। একটাই বইয়ের দোকানে এসে আমি চিৎকার করে কথা বলতে পারি না। আমি যদি সিনেমা হলে যাই, আমি কথাই বলতে পারব না। তার মানে আমি যে কথা জানি না, তা নয়। স্থান-কাল পাত্রভেদে কথা বলার শক্তি বা উপায় বা কথার ধার ইত্যাদি পাল্টায়। এখন আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদরা যখন বলতেন, তখন মানুষ শুনতো বেশি, আর পড়তো বেশি। আর এখন  মানুষ শুনতে রাজি না, দেখতে বেশি পছন্দ করে। কাজেই আমি দৃশ্যমাধ্যমে কথা বলব, কিন্তু তোমরা যেটা করছ সেটা কিন্তু প্রচুর একটা শক্তিশালী কাজ। আহমদ শরীফ যদি এখন থাকতেন তিনিও ফেসবুকে গিয়ে তোমাদের মতো পোস্ট দিতেন, হা হা হা। 

তো, এই দিন তো এখন আর নেই। কাজেই এখন তোমরা যেটা করছ আহমদ শরীফরা জোর গলায় সেটি বলে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখাই। প্রতিক্রিয়া যারা খুব তাড়াতাড়ি দেখায়, তারা খুব সক্রিয়তা দেখাতে পারে না। কারণ প্রতিক্রিয়াটা জেনে-বুঝে দিতে হয়। একজন আপনাকে গালি দিল, আপনার তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আপনিও ওটার পাল্টা গালি দিলেন, তাহলে প্রার্থক্য কোথায়? অথবা আপনি শুনলেন, কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে চলে গেলেন―সেটাও একটা প্রতিক্রিয়া। সেটা হয়ত যার রুচিটা সেরকম না তাদের। অথবা আপনি শুনলেন, কিন্তু জানার চেষ্টা করলেন, কেন সে গালিটা দিয়েছে। সেই ছেলেকে যখন আপনি পাবেন, তাকে তখন আপনি আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলবেন, তুমি যখন গালিটা দিয়েছিলে আমি হজম করলাম, কিন্তু গালিটা দিয়ে তোমার কী লাভ হলো? তার সঙ্গে যদি আমি এ ধরনের কথাবার্তায় যাই, হয়তো তার পরিবর্তন হতেও পারে। তো, শিক্ষকদের কাজ কিন্তু তিন নাম্বারটা। সে জন্য আমি অনেক সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাই। খুব দ্রুত জানাই না। অনেকে দেখি ঝগড়া শুরু করে দেয়। ফেসবুকে একজনে একটা লাইক দিলো, ব্যস তা নিয়ে বিরাট ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। 

তাছাড়া গভীরে গেলে বিতর্ক হয় না। কারণ গভীরে সব সিদ্ধান্তই দেওয়া আছে। গভীরতার প্রয়াসই তো আমরা এখন দেখি না। আমরা শুধু উপরতলে ভাসছি। তো, দেখার সংস্কৃৃতির সমস্যাটা হচ্ছে, দেখার সংস্কৃতি মানুষকে চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। আমি এখনও মনে করি, যে প্রযুক্তি মানুষকে ভাবতে শেখায় না, সেই প্রযুক্তি গ্রহণ করাটা বিপদগ্রস্ত করে তোলে। আমাকে অনেক ভেবেচিন্তে সেই প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে। সুখের বিষয় এই যে, বই ছাপাখানা থেকে উধাও হয়ে যায়নি পর্দায়। পর্দায় যেদিন বই চলে যাবে সেদিন হয়তো বই নিজের স্বকীয়তার জায়গা তৈরি করে নেবে। কিন্তু সেটা অনেক কষ্ট করে করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি আমরা তৈরি করি না, আমরা ভোক্তা শুধু। ভোক্তা হিসেবে আমাদের ক্ষমতা নেই প্রযুক্তি বদলে দেওয়ার বা কোনো শর্তে তাকে আবদ্ধ করার। সে জন্য আমাদের এই প্রযুক্তিটা গ্রহণ করতে হবে ভাবনা-চিন্তা করে, যাতে আমরা প্রযুক্তির দাসে পরিণত না হই। আমি প্রযুক্তির মালিক না হই কিন্তু দাসে কেন পরিণত হব? মাঝখানে তো থাকা যায়।

প্রশ্ন: আমাদের লোকসাহিত্য নিয়ে যতটা কাজ হওয়ার কথা ছিল, ততটা কাজ হচ্ছে কি না? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কেন হচ্ছে না? আর আমরা যারা লোকসাহিত্য নিয়ে কাজ করছি আমাদের জন্য পথনির্দেশনা, পরামর্শ বা উপদেশ থাকলে যদি বলেন...। 

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:  লোকসাহিত্য নিয়ে যদি গবেষণার কাজ হয়, তাহলে এটি দুইভাবে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মাধ্যমে হতে পারে, যেটা বাংলা একাডেমিতে হয় বা অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ আছে সেখানে হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম; তারাও কাজ করছে। কিন্তু যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল, হয়তো সেটি হচ্ছে না। আমি জানি না কেন হচ্ছে না। আর দ্বিতীয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে। আমাদের মনসুর উদ্দিন যখন গান সংগ্রহ করছেন তখন তো তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি নিয়ে করেননি। নিজের স্বার্থে, নিজের ইচ্ছায় করেছেন। আমি মনে করি আপনাদের মতো প্রত্যেকে যারা ফোকলোর নিয়ে কাজ করছেন তারা যদি প্রত্যেকেই এই চিন্তাটি মাথায় রেখে অগ্রসর হন যে, আমি একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাব, তাহলে সেটা একটা। এ কাজগুলি আমাকে সম্পূর্ণ করতে হবে। আপনারা একসঙ্গে করতে পারেন, একা একা করতে পারেন। কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে করতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিক সাহচর্য ছাড়াও করতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় এটা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তির সিদ্ধান্ত। আমি যদি আমার লোকসাহিত্যকে ভালোবাসি তাহলে অবশ্যই আমি সেই কাজগুলো করে যাব। 

আর গবেষণার অনেক রকম কারণ থাকে। আপনি যদি কোনো অভিসন্দর্ভ বিষয়ে লিখতে চান তাহলে এক ধরনের ঘটনা, আপনি যদি কোনো হারানো বিষয়ে লিখতে চান তাহলে এক ধরনের গবেষণা করতেই পারেন। নিমফিয়া পাবলিকেশন্স কতগুলো বই করেছে বাংলাদেশের অনেক বিষয় নিয়ে। যেমন সন্দেশের যে ছাঁচ সেটা নিয়ে একটা বই লেখা হয়েছে―আপনি কি জানেন? কি চমৎকার একটা বই সন্দেশ তৈরির ছাঁচ নিয়ে। অনেকে জানেন, সন্দেশের ছাঁচ হয় তারও যে একটা ইতিহাস আছে, একেবারে লোকজ ধারা থেকে চলে আসা ইতিহাস, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। 

পরামর্শ দিতে পারি, কোনো উপদেশ দিই না আমি। একটা পরামর্শ হতে পারে যে, আপনারা কাজ করুন এবং সেটি প্রকাশের ব্যবস্থা করুন। ইংরেজি ভাষায় কিছু কাজ করুন যাতে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে। আর প্রধানত বাংলায় লিখুন। যেখানে যেখানে ফোকলোরের কাজ হয় সেখানে বছরের অন্তত একবার একটা সেমিনার করুন। এখন তো যেটা হয়, অনেক বিভাগ মিলে একটা কাজ হয়। যেমন ফোকলোর শুধু ফোকলোরে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। ফোকলোরের চিন্তাগুলো সাহিত্যেও আসে। সাহিত্যের বিভাগগুলোর সঙ্গে আপনারা কথা বলুন। সমাজতত্বের বিভাগগুলোর সঙ্গে কথা বলুন। অ্যানথ্রোপলোজি আছে, জেন্ডার স্টাডিজ আছে―সবখানে ফোকলোরের একটা চিহ্ন থাকতে পারে। যেখানে যেখানে আছে তাদের সঙ্গে মিলে যদি কাজটা করতে পারেন তাহলে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে চর্চার পরিধিটা বেড়ে যাবে। আর যদি শুধু ফোকলোরের দিকে সংকীর্ণভাবে কাজ করা হয়, তাহলে ফোকলোরের এক ধরনের উন্নয়ন হবে সেটা সময় লাগবে। আর বিস্তৃতভাবে করলে আমার মনে হয় যে কাজ হবে।

প্রশ্ন: আধুনিক কবিতা কী? আধুনিক কবিতা বা উত্তরাধুনিক কবিতার কোনো বিতর্ক আছে কি না?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কবিতায় উত্তরাধুনিকতা দেখা খুব কঠিন। আমি মনে করি, উত্তরাধুনিক কবিতা যাদের বলা হয়, সেগুলি আসলে আধুনিক কবিতাই বটে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আধুনিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আধুনিকতার সংজ্ঞা ভেঙে ফেলে এটা হয়। যেমন আমি একটা কবিতার কথা বলি, সত্যিকারার্থে উত্তরাধুনিক কবিতা। এটা শুনলে বুঝতে পারবেন উত্তরাধুনিক কবিতা আসলে কী। কবিতার শিরোনাম হচ্ছে : ‘দেয়ার ইজ নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার।’ ১৪ লাইনের কবিতার প্রথম থেকে শেষ লাইন : দেয়ার ইজ নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার। 

এটা কীভাবে কবিতা হলো? আমার ছাত্রদের যখন পড়াচ্ছিলাম তখন ওরা হাসছিল। ছাত্ররা বলছে, স্যার, এটা কী ধরনের কবিতা? কবিতাটা কল্পনা করলে মনে হয় একটা ড্রয়ারের ছবি। একটা বাচ্চা যদি কিছু লুকিয়ে রাখে মা এসে বলছে, তুমি বিস্কুটটা কোথায় রেখেছ? নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার? র‌্যাব আসছে বাসায়, ড্রয়ারে কি আছে? দেয়ার ইজ নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার, একটা মেয়ে প্রেমপত্র পড়ছে, বাবা এসে ঢুকলেন, দেখলেন ড্রয়ার। মেয়ে বলল, দেয়ার ইজ নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার, বাবা এদিকে যেও না―দেয়ার ইজ নাথিং ইন দ্য ড্রয়ার। 

অর্থাৎ আঠারো রকমের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এই বাক্যটা দিয়ে। উত্তরাধুনিকতা কেন বলছি এটাকে? কারণ উত্তরাধুনিক কবিতা আধুনিক কবিতার কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এখানে কাঠামো ভেঙে ফেলছে। এটা কিন্তু ১৪ লাইনের সনেট। তো, সনেটে আমরা জানি যে ৮-৬ অথবা ৪-৪ দুই―যেটা শেক্সপিয়র করেছিলেন। এখানে তার বালাই নেই। কিন্তু একটা ভাব তৈরি করে দিলো এবং চিন্তার সূত্রপাত করল। এই দৃশ্যমাধ্যম যেটাকে আমি বলছি, সেখানে কিন্তু অনেকটা গ্রাফিক্স ডিজাইনে নিয়ে আসলে একটা ড্রয়ারের ছবি দিলো। এই দৃশ্যের মাধ্যমে অনেকগুলো চিন্তার সমাহার ঘটাল। ফলে একসময় শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ থাকল না। চিত্রকল্পটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল এবং একটি বাক্য দিয়ে যে আমি পুরো একটি কবিতা, শিরোনাম সব করে ফেলতে পারি এই বিষয়টা গুরুত্ব পেল সেখানে। আধুনিক কবিতা এই সাহস দেখাতে পারবে না। আমাদের আধুনিক কবিতার একটা সমস্যা হচ্ছে এত আকীর্ণ করে ফেলে শব্দ দিয়ে এবং কলকব্জা দিয়ে, যেটি বলি না কেন...। 

অনেক গল্প দেখেছি, এই গল্প আমার কষ্ট হয় পড়তে। যখন দেখি যে প্রচন্ড রকমের কঠিন করে ফেলেছে ভাষা। যেন ভাষার কাঠিন্যটা হচ্ছে গল্পের একটা বড় সূত্র। এটি লিখিত হয়েছে যারা সাহিত্যের একেবারে অন্ধ সমর্থক, তারা ওই বিষয়টা হয়তো চর্চা করেন, তাদের জন্য। তার ভাষাটা হতে হবে জটিল। কিন্তু যারা কথ্যসাহিত্যের অনুসরণ করেন তারা দেখবেন ভাষাটা কখনো জটিল না, খুব সহজে বোঝে। একটা বাচ্চাও বুঝেছে আবার বৃদ্ধও শুনছেন, তিনিও বুঝছেন। অর্থাৎ বোধগম্য ভাষায় সেই একই ভাবনাগুলি সঞ্চারণ ঘটানো খুব কঠিন একটা কাজ। আমি মনে করি, আমরা যারা এই মুহূর্তে লিখছি, আমাদের প্রজন্মের বলি―আমাদের প্রত্যেকেরই এই কথ্যসাহিত্যের প্রতি একটা আগ্রহ ছিল সবসময় ছোটবেলায় শুনেছি। কাজেই প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে আমি কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের ভেতরে সেই গল্পের মেজাজটা পাই। রবীন্দ্রনাথের ভেতরে কথ্যসাহিত্যের মেজাজটা আছে। হূমায়ুন আহমেদের ভেতরে আছে। আমি নিজেও সেটাকে বহুদিন থেকে চর্চা করছি। এবং কথ্যসাহিত্যে দেখবেন যখন একজন কথক বলছেন কথাগুলি, তিনি আবার নিজেকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছেন―আমি কি ঠিক বলছি? 

আমেরিকার একজন ঔপন্যাসিক আছেন, তিনি তার গল্পে বলছেন―listen. কাকে বলছেন? পাঠককে। কেন বলছেন? কারণ ওই কথ্যসাহিত্যের বিষয়টা। আমেরিকার একজন ঔপন্যাসিক যখন কথ্যসাহিত্যের মেজাজে লেখেন তখন তিনি খুব সহজেই ইতিহাসকে বিনির্মাণ করতে পারেন, প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেন। ইচ্ছেমতো তিনি আয়রনি যত রকমের স্যাটায়ার―এগুলোর সমাহার ঘটাতে পারেন। তার একটা লাইসেন্স পাওয়ার হয়ে যায়। কারণ আমাদের কথ্যসাহিত্যে কিন্তু লাইসেন্স সবার আছে। কখন গল্প শেষ করবেন তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। 

আমার দিদা একসময় বলতেন―যারে, আর ভাল্লাগছে না। বললাম কী জন্য? বলেন যে, এই রাজকন্যার কথা বলতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমরা হয়তো বলতাম, কি দিদা, তুমি একসময় খুব সুন্দরী ছিলে তাই না? বলেন, ছিলাম তো রে। একসময় আমাদের বলতেন, তোরা গল্পটা শেষ কর। এই স্বাধীনতাও দিতেন। তো একজন বলছে যে, রাজকন্যা খুব আনন্দের সঙ্গে থাকল। আমি বললাম, দিদা, রাজকন্যা কিন্তু ঘোড়া থেকে পড়ে মরে গেল। সবাই খুব চিৎকার করছে―এটা কী করলি তুই? তিনি বললেন, আরে মরে তো। রাজকন্যারা সবসময় বেঁচে থাকে? আমার দিদা বলতেন, ওই, অতঃপর, তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো―এগুলিতে বিশ্বাস করিস না। নিজের জীবনের কাহিনি মিলিয়ে বলতেন। সেই জন্য আমার সাহিত্যপাঠ সত্যিকারার্থে এত গঠনমূলক হয়েছে, কারণ আমি আমার গ্রামের সাহিত্য থেকে যা পেয়েছি এবং অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্য থেকে যা পেয়েছি তার মধ্যে বড় কোনো ফারাক দেখতে পাইনি।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তো বলেছেন, তিনি একটা গল্পও নিজস্ব লিখেননি, সংবাদপত্র থেকে নিয়েছেন, প্রচলিত গল্প থেকে নিয়েছেন। এখান থেকে ওখান থেকে এক টুকরা। আমি দেখলাম আমার অনেক গল্প অনেক সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক গল্পের জোগান দিয়েছে। আমি একটা গল্পের সঙ্গে জুড়ে আরেকটা গল্প লিখেছি। কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি আমার। আমি মনে করি কথ্যসাহিত্যের একটা ক্ষমতা আছে, যেটা আমরা কবিতায় দিতে পারিনি। কারণ মেজাজ-মর্জিতে ওই তিরিশের অনুকরণ করে আমরা সবাই অনেক দূর চলে গেছি। যারা জীবনানন্দ দাশকে গ্রহণ করতে চেষ্টা করেছেন তারা অনেকটা প্রকৃতিকে ধরে রাখতে পেরেছেন, মেজাজ ধরে রাখতে পেরেছেন। অর্থাৎ আমাদের সেই আধুনিকতাকে আমি ‘আধুনিকতা’ বলব যে, সমকালের দিকে তাকিয়ে আমার অতীতটাকে নিয়ে সাজাব এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব। সমকালকে আমি ধারণ করব কিন্তু আমার নিজের শর্তে আমার সংস্কৃৃতি আমার স্থানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। এর বাইরে গেলে আমি বড় আধুনিক হতে পারব না।

প্রশ্ন: লেখক হওয়ার জন্য বোহেমিয়ান জীবন আসলে কতটা জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কোনো এজামশন নিয়ে সাহিত্য করতে আসা উচিত না যে, আমাকে সাহিত্যের জন্য এ কাপড় পড়তে হবে, ঝোলা নিয়ে ঘুরতে হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, তা কিন্তু না।

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত নিবন্ধ