আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা পালন করছেন প্রবারণা পূর্ণিমা। এ উপলক্ষে পটুয়াখালী জেলার রাখাইন পাড়াগুলোতে বিরাজ করছে উৎসব মুখর পরিবেশ।
এদিকে, আজ সন্ধ্যায় আকাশে উড়ানো হবে নানা রঙের হাজারো ফানুস। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তিন মাসের বর্ষাবাস সমাপনীতে প্রবারণা পূর্ণিমা উদযাপন করেন বৌদ্ধরা।
আরো পড়ুন:
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে হিন্দু মহাজোট নেতৃবৃন্দের শুভেচ্ছা বিনিময়
‘বাংলাদেশে সম্প্রীতিই আসল’
সোমবার (৬ অক্টোবর) সকালে বুদ্ধপূজা, সংঘদান, পিণ্ডদান, অষ্টপরিষ্কার দান, পঞ্চশীল প্রার্থনা, শীল গ্রহণ ও প্রদীপপূজার মধ্য দিয়ে দিনটির সূচনা করা হয়। এসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুসহ রাখাইন নর-নারীরা বুদ্ধকে ফুল, বাতি ও অন্যান্য সামগ্রী নিবেদন করেন। দিনভর নানা ধর্মীয় আচার আনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ উৎসব চলবে। প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে এক মাস প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে শুরু হবে কঠিন চীবরদান উৎসব।
মহিপুরের নয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা উথাচু বলেন, “আমাদের এখানে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। আমরা যারা রয়েছি, তারা সকাল থেকে পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা উৎসব পালন করছি। নিজেকে আত্মশুদ্ধি করার জন্য এবং সব অসৎ কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেছি।”
একই এলাকার বাসিন্দা মামাসে বলেন, “আজ আমাদের জন্য এক আনন্দের দিন। নিজেদের পবিত্র রাখতে সবাই বিহারে গিয়ে আমরা পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণের পর বুদ্ধপূজা করেছি। যাতে আমাদের আগামী দিনগুলো ভালো কাটে।”
কুয়াকাটা শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ইন্দ্র বংশ ভিক্ষু বলেন, “দিনভর ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা এ দিনটি উদযাপন করব। সকালে বৌদ্ধ ধর্মালম্বী নর-নারীরা বিহারে এসে বুদ্ধের কাছ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করেছেন। আমরা বৈশ্বিক শান্তি কামনায় বুদ্ধের কাছে বিশেষ প্রার্থনা করেছি। সন্ধ্যায় বুদ্ধকে স্মরণে আকাশে ফানুস উড়ানো হবে।”
ঢাকা/ইমরান/মাসুদ
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মারমা ও রাখাইনদের রথটানা উৎসব আজ, প্রবারণা পূর্ণিমায় এটি কীভাবে এল
আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হয় প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রবারণায় মাঙ্গলিক রথটানা উৎসবে মেতে ওঠেন মারমা ও রাখাইন তরুণ-তরুণীরা। মারমা ভাষায় এই উৎসবকে বলা হয় ‘রাথাঃ পোয়ে’। অনেকে আবার বলেন ‘সাংফোওয়া হ্নাং’। বাংলায় একে বলা যায় ‘শারদীয় উৎসব’।
প্রবারণায় হাজারো তরুণ-তরুণী নেচে–গেয়ে ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করে এই রথটানা উৎসব। ‘ছংরাসি ওয়াগ্যোয়াই হ্লা, রাথাঃ পোয়ে লাগাইত মে’ (শরৎ ঋতু এসেছে, আশ্বিনে চলো রথটানা উৎসবে) গান গেয়ে রথ টানেন তরুণ-তরুণীরা।
বান্দরবানে এবার প্রবারণা ও রথটানা উৎসব শুরু হবে আজ রোববার। তিন দিনের উৎসবের জন্য পক্ষকালব্যাপী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। জেলা শহরের উজানিপাড়া মাঠে রাজহংসীর আদলে দৃষ্টিনন্দন রথ তৈরি করছেন কারুশিল্পীরা। গাছ, বাঁশ, বেত ও নানা উপকরণে বিশাল রথ তৈরি শুরু হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে।
সাতজন শিল্পী রাজহংসীর আদলে রথটি তৈরি করেছেন। দলের প্রধান ক্য অং সিং মারমা জানান, রথে কাগজের বিহার বসানো হয়, কারুকাজ করতে হয় বুদ্ধমূর্তির আসনটিতে। এমনভাবে রথ তৈরি করা হয়, যাতে এর সামনে এলেই উপাসকদের ধর্মীয় শ্রদ্ধা ও ভক্তি বোধ জাগ্রত হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন ও মঙ্গল কামনায় মোমবাতি প্রজ্বালনের বাতিঘরও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে স্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে। তারপর রথে চাকা ও রশি সংযোজন এবং নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য বাঁশের ভেলা তৈরি করতে হয়। মঙ্গল রথের পাশাপাশি কুশপুত্তলিকার মতো ফুকসুমা নামে অশুভ দেবতার প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়ে থাকে। ফুকসুমা আনার কারণ হচ্ছে, মাঙ্গলিক কাজ অশুভ বা মারেরা (শত্রু) ভন্ডুল করার চেষ্টা করে, যদিও শেষ পর্যন্ত শুভ কাজেরই জয় হয়।
প্রবারণার এই রথটানা উৎসব কখন থেকে, কীভাবে এল জানতে চাওয়া হয় লেখক ও গবেষক মংক্য শোয়েনু নেভী মারমার কাছে। তিনি জানান, বোমাং রাজপরিবার ও তাঁদের অনুসারীরা ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরের গোড়াপত্তন করেন। বোমাং রাজা সাকহ্না ঞো চৌধুরীর আমলে ১৮৯৪ সালে বান্দরবানে স্থায়ীভাবে রাজবিহার স্থাপিত হয়েছে। তখন থেকে প্রবারণায় রথটানা উৎসব হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রায় ১৩১ বছর ধরে রথটানা উৎসব হয়ে আসছে বান্দরবানে।প্রবারণার এই রথটানা উৎসব কখন থেকে, কীভাবে এল জানতে চাওয়া হয় লেখক ও গবেষক মংক্য শোয়েনু নেভী মারমার কাছে। তিনি জানান, বোমাং রাজপরিবার ও তাদের অনুসারীরা ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরের গোড়াপত্তন করে। বোমাং রাজা সাকহ্না ঞো চৌধুরীর আমলে ১৮৯৪ সালে বান্দরবানে স্থায়ীভাবে রাজবিহার স্থাপিত হয়েছে। তখন থেকে প্রবারণায় রথটানা উৎসব হয়ে আসছে। অর্থাৎ প্রায় ১৩১ বছর ধরে রথটানা উৎসব হয়ে আসছে বান্দরবানে।
আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে অশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস ভিক্ষুরা ‘বর্ষাবাস’ পালন করেন। এ সময় ভিক্ষুরা জরুরি কোনো কাজ ছাড়া বৌদ্ধবিহারের বাইরে যান না। বর্ষাবাসের সমাপনী অনুষ্ঠানকে বলা হয় প্রবারণা উৎসব। মারমা ভাষায় একে বলে ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে।
মংক্য শোয়েনু নেভী মারমা বলেন, প্রবারণা বা ওয়াগ্যোয়াই উৎসবের একটি ঐতিহ্য হলো রথপূজার উৎসব। তবে এই রথপূজা উৎসব শুধু প্রবারণায় করতে হবে, এমন নয়। এটি মূলত বৃষ্টির দেবতা ও জলবুদ্ধ হিসেবে পরিচিত অর্হৎ (নির্বাণপ্রাপ্ত ধ্যানী) উপগুপ্তের উদ্দেশে বর্ষা শেষে শরৎকালে করা হয়। মারমা লোকসমাজের বিশ্বাস, উপগুপ্ত অর্হৎ ঝড়, বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন করেন।
মারমা লোকসমাজের উপাখ্যান অনুযায়ী, হাইসাওয়াদি (হংসবতী রাজ্য, বর্তমান মিয়ানমার) রাজ্যে কোনো এককালে পাহাড় কেটে, বনজঙ্গল উজাড় করে চৈত্য বা জাদি নির্মাণ করা হয়েছিল। এ কারণে দেবতা রুষ্ট হওয়ায় ঝড়–বৃষ্টি–বন্যায় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। হাইসাওয়াদিরাজ তখন স্বপ্নে দেখেন একমাত্র জলবুদ্ধ উপগুপ্ত এটির প্রশমন করতে পারবেন। কারণ, তিনি মৎস্যকন্যার সন্তান এবং জলে তাঁর অধিষ্ঠান। রথ টেনে অর্হৎ উপগুপ্তকে পূজা করে হাইসাওয়াদি রাজ্যে আবার সুখ ও শান্তি ফিরে আসে। তখন থেকে অর্হৎ উপগুপ্তের উদ্দেশে ঝড়, বৃষ্টি ও খরা-বন্যার বিপর্যয় প্রশমনের কামনায় রথটানা উৎসব ও জলে রথকে উৎসর্গ করে ভাসিয়ে দেওয়া ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। হংসবতী রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে রাজহংসীর আদলে রথ তৈরি করা হয়।