বেতন হয় না তিন মাস, ব্যাহত সাইবার নিরাপত্তার কাজ
Published: 8th, October 2025 GMT
সরকারের সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র প্রকল্প বিজিডি ই-গভ সার্ট। অথচ সাইবার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার এ সময়ে পরামর্শকনির্ভর প্রকল্পটিতে তিন মাস ধরে বেতন হচ্ছে না। অর্থছাড় না হওয়ায় সাইবার নিরাপত্তাঝুঁকি নজরদারিতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও টুলসের লাইসেন্সও নবায়ন করা যায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ।
তিন মাস ধরে বেতন না হওয়ায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তা আর স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হওয়ায় পরামর্শকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রকল্প পরিচালক অবশ্য আশা করেছেন, শিগগিরই অর্থছাড় হবে।
২০১৫ সালে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের একটি অংশ হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্টের যাত্রা শুরু। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর থেকে এটি বাড়তি পরিসরে কাজ শুরু করে।
২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) একটি স্বতন্ত্র প্রকল্প হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্ট কাজ শুরু করে। এর মেয়াদ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয়। তখন এক বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ১৬৭ কোটি টাকার বেশি।
বাড়তি মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়ে যায়। এর দুই মাস পর আগস্টে প্রকল্পটির মেয়াদ আবার দুই বছর বাড়ানো হয়। তবে অর্থ বরাদ্দ হয়নি।
সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজের জন্য এই প্রকল্পে লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ও টুলস ব্যবহার করা হয়। প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, সফটওয়্যার ও টুলের অনেকগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না করায় তাদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।প্রকল্পটিতে অন্তত ৩৫ জন পরামর্শক কাজ করছেন। সর্বশেষ জুন মাসের বেতন তাঁরা পেয়েছিলেন। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের বেতন হয়নি।
জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মো.
বিসিসি গত ৩ জুলাই একটি অফিস আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, প্রকল্পের কাজ চলমান রাখার জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব ২৫ জুন সরকারের অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানে অনুমোদনের পর যাবে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য পরামর্শকদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে সেই অফিস আদেশে। সম্প্রতি এক বছরের জন্য চুক্তি করে পরামর্শকদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। সামনে নির্বাচন, নানা ধরনের সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রকল্প হোক বা এজেন্সির ইউনিট হিসেবে হোক, একে বিশেষভাবে দেখে সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজের জন্য এ প্রকল্পে লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ও টুলস ব্যবহার করা হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সফটওয়্যার ও টুলের অনেকগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না করায় তাদের কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
এই প্রকল্পের অন্যতম কাজ হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় আইটি নিরীক্ষা ও ভিএপিটি (ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড পেনিট্রেশন টেস্টিং)। সূত্র জানায়, বর্তমানে তাদের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তাতে এখন কোনো সংস্থা অডিট বা ভিএপিটি চাইলে আগামী ছয় মাসেও তা করা সম্ভব নয়।
অবহেলায় সাইবার নিরাপত্তাবাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং সর্বশেষ পাস হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ—সব কটিতেই একটি জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (এনসার্ট) গঠনের কথা বলা আছে। কিন্তু এই এনসার্ট আর আলাদা করে গঠিত হয়নি। অথচ রিজার্ভ চুরির মতো বড় সাইবার হামলার ভুক্তভোগী বাংলাদেশ।
বিজিডি ই-গভ সার্টকেই বিগত সরকার ২০২০ সালে এক আদেশে এনসার্ট হিসেবে ঘোষণা করে। সে আদেশে বলা হয়, এনসার্ট গঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিজিডি ই-গভ সার্ট নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ কাজ করবে। বর্তমানেও তারা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছর আইসিটি বিভাগ সব প্রকল্প মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দেয়। তাতে বিজিডি ই-গভ সার্টের কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের ই-গভর্নমেন্ট অবকাঠামো, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জাতীয় ডেটা সেন্টারে রক্ষিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভান্ডারকে সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা; সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর (সিআইআই) সুরক্ষাসহ, চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইবার স্পেসের নিরীক্ষা করা এবং সরকারি দপ্তরে সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ প্রকল্প থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত ৬১৮টি প্রতিবেদন, ৩২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিএপিটি সম্পন্ন হয়েছে, সিআইআইগুলো নিয়ে ৩১০টি প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন ফরেনসিক আলামতও বিশ্লেষণ করেছে। এই প্রকল্প সেবা দিয়ে আয়ও করে থাকে। তারা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি আয় করেছে।
আরও পড়ুনডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: সাইবার নিরাপত্তায় গুরুত্ব কম০৭ এপ্রিল ২০২৩সরকারি প্রতিবেদনে এই প্রকল্পের মূল্যায়নে বিভিন্ন খাতে সাশ্রয়ের কথা বলা হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ অত্যন্ত বিশেষায়িত ও অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে বলা হয়, বিসিসিকে পুনর্গঠন করে প্রকল্পের কার্যক্রম ও জনবল বিসিসির রাজস্ব খাতে নেওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পের কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী এটিকে প্রকল্প আকারে না রেখে সংস্থায় অঙ্গীভূত হওয়া জরুরি বলেও উল্লেখ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ শফিউল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে সার্ট গঠনের কথা ছিল, যাদের কেন্দ্রীয়ভাবে এনসার্ট সমন্বয় করবে। কিন্তু এত বছরেও তা হয়নি। বর্তমান যে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি আছে, তার একটি ইউনিট হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্টকে যুক্ত করে জনবল, আর্থিক বিষয় সমাধান করা যেত।
আরও পড়ুনফাঁস হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য০৯ জুলাই ২০২৩সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে। ওই আইনের ৫ ধারার বিধান অনুসারে একই বছরের ৫ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি’ গঠন করে। পরবর্তী সময়ে আইনটি যতবার পরিবর্তন করা হয়েছে, সেই আইনের অধীন এর নাম পরিবর্তিত হয়েছে। তবে সংস্থাটির অন্যতম কাজ সাইবার সুরক্ষা হলেও আদতে এর সে ধরনের কোনো কাঠামো ও জনবল নেই। তাদের সাইবার সুরক্ষার কাজটিই মূলত বিজিডি ই-গভ সার্ট প্রকল্পটি করে আসছে।
প্রকল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অধ্যাপক শফিউল আলম বলেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। সামনে নির্বাচন, নানা ধরনের সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রকল্প হোক বা এজেন্সির ইউনিট হিসেব হোক, একে বিশেষভাবে দেখে সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, এ ধরনের কাজ সব সময় পরামর্শকনির্ভর থাকাও ঠিক নয়। তাঁদের বেতনকাঠামো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সক্ষমতা বাড়িয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সফটওয় য র ও ট ল প রকল প র ক জ এই প রকল প র ধরন র স সরক র র এনস র ট র জন য শ ষ হয়
এছাড়াও পড়ুন:
হাসপাতালটিতে দ্রুত সরঞ্জাম ও জনবল দিন
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এখন কার্যত নিজেই এক মুমূর্ষু রোগী। এই হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে ছুটে আসেন শত শত মানুষ। কিন্তু চিকিৎসক, নার্স, এমনকি ল্যাব সহকারীর অভাবে সেবা পাওয়া তাঁদের সবার ভাগ্যে জোটে না। সরকারি কাগজে এটি ৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বাস্তবে তা একটি বড় ভবনের ভেতরে থাকা ছোট্ট এক জরুরি বিভাগে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
এই হাসপাতালে ৩১ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ৮ জন। ২৯ নার্সের মধ্যে কর্মরত মাত্র ৫ জন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর অবস্থাও একই রকম; ৩৪ জনের স্থলে আছেন ৮ জন। ফলে অপারেশন থিয়েটার বন্ধ, সিজারিয়ান সেবা এক বছর ধরে বন্ধ, শিশু ও ডায়রিয়া ওয়ার্ড বন্ধ, ব্লাড ব্যাংক বন্ধ—অচলাবস্থার এই তালিকা দীর্ঘই হচ্ছে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে কোনো শয্যা ফাঁকা থাকে না। এক শয্যায় দুই থেকে তিনজন রোগী গাদাগাদি করে শুয়ে থাকতে বাধ্য হন।
এটি বাংলাদেশের প্রান্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে যে বিশাল ফাঁক, টেকনাফ তার নগ্ন উদাহরণ। ২০১১ সালে হাসপাতালটিকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বেড়েছে, রোগীর চাপ বেড়েছে, কিন্তু চিকিৎসক ও নার্সের সংখ্যা কমেছে।
দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক–সংকটের কারণে হাসপাতালটি এখন বেসরকারি ক্লিনিকগুলো দালাল চক্রের কবলে পড়েছে। রোগীরা সরকারি সেবা না পেয়ে বাধ্য হয়ে বেশি খরচে বেসরকারি ক্লিনিকে যাচ্ছেন। এটি শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, উপরন্তু মানবিক বিপর্যয়।
সরকার ২০২০ সালে এনজিওর সহযোগিতায় যখন ৯৩ জন অতিরিক্ত কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিল, তখনই প্রমাণিত হয়েছিল যে লোকবল ও ব্যবস্থাপনা থাকলে এ হাসপাতাল দক্ষভাবে চলতে পারে। কিন্তু সেই প্রকল্প শেষ হওয়ার পর সবকিছু আবার অচল হয়ে গেছে।
টেকনাফ একটি সীমান্ত উপজেলা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প, মাদক ও দারিদ্র্য—সব মিলিয়ে এখানে চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন আরও বেশি। এ অবস্থায় একটি সরকারি হাসপাতালের এমনভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া শুধু স্থানীয় লোকজনের নয়, বরং সমগ্র রাষ্ট্রের জন্যই লজ্জাজনক।
এ অবস্থায় এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এখানে দ্রুত চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ক কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে স্থায়ী নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী এনজিও বা চুক্তিভিত্তিক জনবল পুনর্বহাল করা যেতে পারে। দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য রোধে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়াতে হবে। হাসপাতালের অচল যন্ত্রপাতি চালু করতে প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেওয়া জরুরি। সিজারিয়ান ডেলিভারি আবার চালু করতে গাইনি ও অ্যানেসথেটিস্ট চিকিৎসক অবিলম্বে নিয়োগ দিতে হবে।
জনগণের চিকিৎসা কোনো দয়া নয়, এটি তাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার রক্ষায় টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে অবিলম্বে সচল করতে হবে।