সরকারের সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র প্রকল্প বিজিডি ই-গভ সার্ট। অথচ সাইবার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়ার এ সময়ে পরামর্শকনির্ভর প্রকল্পটিতে তিন মাস ধরে বেতন হচ্ছে না। অর্থছাড় না হওয়ায় সাইবার নিরাপত্তাঝুঁকি নজরদারিতে ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও টুলসের লাইসেন্সও নবায়ন করা যায়নি। ফলে ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ।

তিন মাস ধরে বেতন না হওয়ায় সৃষ্ট অনিশ্চয়তা আর স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হওয়ায় পরামর্শকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। তাই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। প্রকল্প পরিচালক অবশ্য আশা করেছেন, শিগগিরই অর্থছাড় হবে।

২০১৫ সালে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটি) লেভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পের একটি অংশ হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্টের যাত্রা শুরু। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর থেকে এটি বাড়তি পরিসরে কাজ শুরু করে।

২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) একটি স্বতন্ত্র প্রকল্প হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্ট কাজ শুরু করে। এর মেয়াদ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হয়। তখন এক বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। প্রকল্পে মোট বরাদ্দ ছিল ১৬৭ কোটি টাকার বেশি।

বাড়তি মেয়াদ গত জুনে শেষ হয়ে যায়। এর দুই মাস পর আগস্টে প্রকল্পটির মেয়াদ আবার দুই বছর বাড়ানো হয়। তবে অর্থ বরাদ্দ হয়নি।

সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজের জন্য এই প্রকল্পে লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ও টুলস ব্যবহার করা হয়। প্রকল্পসূত্রে জানা যায়, সফটওয়্যার ও টুলের অনেকগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না করায় তাদের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

প্রকল্পটিতে অন্তত ৩৫ জন পরামর্শক কাজ করছেন। সর্বশেষ জুন মাসের বেতন তাঁরা পেয়েছিলেন। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসের বেতন হয়নি।

জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মো.

হোসেন বিন আমিন প্রথম আলোকে বলেন, অর্থবছর শুরুর পরে মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে টাকা ছাড়ে দেরি হচ্ছে। তিনি আশা করছেন, দ্রুতই তাঁরা অর্থ পেয়ে যাবেন।

ব্যাহত হচ্ছে প্রকল্পের কাজ

বিসিসি গত ৩ জুলাই একটি অফিস আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, প্রকল্পের কাজ চলমান রাখার জন্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব ২৫ জুন সরকারের অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানে অনুমোদনের পর যাবে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রাখার জন্য পরামর্শকদের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে সেই অফিস আদেশে। সম্প্রতি এক বছরের জন্য চুক্তি করে পরামর্শকদের স্বাক্ষরও নেওয়া হয়েছে।

এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। সামনে নির্বাচন, নানা ধরনের সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রকল্প হোক বা এজেন্সির ইউনিট হিসেবে হোক, একে বিশেষভাবে দেখে সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।

সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত কাজের জন্য এ প্রকল্পে লাইসেন্সসহ বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার ও টুলস ব্যবহার করা হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, সফটওয়্যার ও টুলের অনেকগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। লাইসেন্স নবায়ন না করায় তাদের কাজও ব্যাহত হচ্ছে।

এই প্রকল্পের অন্যতম কাজ হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় আইটি নিরীক্ষা ও ভিএপিটি (ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড পেনিট্রেশন টেস্টিং)। সূত্র জানায়, বর্তমানে তাদের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তাতে এখন কোনো সংস্থা অডিট বা ভিএপিটি চাইলে আগামী ছয় মাসেও তা করা সম্ভব নয়।

অবহেলায় সাইবার নিরাপত্তা

বাতিল হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইন এবং সর্বশেষ পাস হওয়া সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ—সব কটিতেই একটি জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম (এনসার্ট) গঠনের কথা বলা আছে। কিন্তু এই এনসার্ট আর আলাদা করে গঠিত হয়নি। অথচ রিজার্ভ চুরির মতো বড় সাইবার হামলার ভুক্তভোগী বাংলাদেশ।

বিজিডি ই-গভ সার্টকেই বিগত সরকার ২০২০ সালে এক আদেশে এনসার্ট হিসেবে ঘোষণা করে। সে আদেশে বলা হয়, এনসার্ট গঠিত না হওয়া পর্যন্ত বিজিডি ই-গভ সার্ট নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ কাজ করবে। বর্তমানেও তারা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করছে।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছর আইসিটি বিভাগ সব প্রকল্প মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দেয়। তাতে বিজিডি ই-গভ সার্টের কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের ই-গভর্নমেন্ট অবকাঠামো, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জাতীয় ডেটা সেন্টারে রক্ষিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভান্ডারকে সাইবার আক্রমণ থেকে রক্ষা করা; সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর (সিআইআই) সুরক্ষাসহ, চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইবার স্পেসের নিরীক্ষা করা এবং সরকারি দপ্তরে সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ প্রকল্প থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত ৬১৮টি প্রতিবেদন, ৩২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভিএপিটি সম্পন্ন হয়েছে, সিআইআইগুলো নিয়ে ৩১০টি প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন ফরেনসিক আলামতও বিশ্লেষণ করেছে। এই প্রকল্প সেবা দিয়ে আয়ও করে থাকে। তারা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি আয় করেছে।

আরও পড়ুনডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: সাইবার নিরাপত্তায় গুরুত্ব কম০৭ এপ্রিল ২০২৩

সরকারি প্রতিবেদনে এই প্রকল্পের মূল্যায়নে বিভিন্ন খাতে সাশ্রয়ের কথা বলা হয়। পাশাপাশি প্রকল্পের কাজ অত্যন্ত বিশেষায়িত ও অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে বলা হয়, বিসিসিকে পুনর্গঠন করে প্রকল্পের কার্যক্রম ও জনবল বিসিসির রাজস্ব খাতে নেওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পের কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী এটিকে প্রকল্প আকারে না রেখে সংস্থায় অঙ্গীভূত হওয়া জরুরি বলেও উল্লেখ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ শফিউল আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটি করে সার্ট গঠনের কথা ছিল, যাদের কেন্দ্রীয়ভাবে এনসার্ট সমন্বয় করবে। কিন্তু এত বছরেও তা হয়নি। বর্তমান যে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি আছে, তার একটি ইউনিট হিসেবে বিজিডি ই-গভ সার্টকে যুক্ত করে জনবল, আর্থিক বিষয় সমাধান করা যেত।

আরও পড়ুনফাঁস হয়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত তথ্য০৯ জুলাই ২০২৩

সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে। ওই আইনের ৫ ধারার বিধান অনুসারে একই বছরের ৫ ডিসেম্বর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি’ গঠন করে। পরবর্তী সময়ে আইনটি যতবার পরিবর্তন করা হয়েছে, সেই আইনের অধীন এর নাম পরিবর্তিত হয়েছে। তবে সংস্থাটির অন্যতম কাজ সাইবার সুরক্ষা হলেও আদতে এর সে ধরনের কোনো কাঠামো ও জনবল নেই। তাদের সাইবার সুরক্ষার কাজটিই মূলত বিজিডি ই-গভ সার্ট প্রকল্পটি করে আসছে।

প্রকল্পের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অধ্যাপক শফিউল আলম বলেন, এই প্রকল্পের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় জড়িত। সামনে নির্বাচন, নানা ধরনের সাইবার ঝুঁকির আশঙ্কা থাকবে। তাই এর গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রকল্প হোক বা এজেন্সির ইউনিট হিসেব হোক, একে বিশেষভাবে দেখে সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, এ ধরনের কাজ সব সময় পরামর্শকনির্ভর থাকাও ঠিক নয়। তাঁদের বেতনকাঠামো বিবেচনায় নিয়ে সরকারের সক্ষমতা বাড়িয়ে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সফটওয় য র ও ট ল প রকল প র ক জ এই প রকল প র ধরন র স সরক র র এনস র ট র জন য শ ষ হয়

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কি অবহেলায় ধ্বংস হবে

খামার ব্যবসায় এখন আগ্রহী হচ্ছেন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা। তাঁদের সাফল্যে বড় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি মুরগি প্রজনন খামার। কিন্তু রাজবাড়ীতে এমন একটি প্রতিষ্ঠান অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা ও পরিকল্পনাহীনতার কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।

 প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় তিন একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত রাজবাড়ীর সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার একসময় এ অঞ্চলের ডিম, মাংস উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। অথচ এখন তা জরাজীর্ণ অবকাঠামো, জনবলসংকট ও আমলাতান্ত্রিক উদাসীনতায় কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ১৪ জনের জায়গায় কাজ করেন মাত্র ৫ জন। এ অবস্থায় কোনো সরকারি স্থাপনা টিকে থাকতে পারে না। দুঃখজনক হলো, এই বিপর্যয়ের দায় কেউ নিচ্ছে না, বরং বছরের পর বছর সমস্যা দেখেও চোখ বন্ধ করে আছে কর্তৃপক্ষ।

১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে বন্ধ হয়েছে হ্যাচারি সেবা। এর পর থেকে খামারটি শুধু নামেই ‘প্রজনন’ খামার। কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, জেনারেটর, পানির পাম্প থেকে শুরু করে গাড়ি—সবকিছু অব্যবস্থাপনায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে। শেডগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম, কর্মচারীদের আবাসিক ভবন বসবাসের অনুপযোগী, পানির ট্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি পরিত্যক্ত ঘরগুলো এখন মাদকসেবীদের আড্ডাস্থল।

এদিকে বাজারের তুলনায় কম দামে মুরগির বাচ্চা পাওয়ায় সাধারণ মানুষ এখানে ভিড় করেন। কিন্তু খামারের উৎপাদন সামান্য হওয়ায় অধিকাংশই খালি হাতে ফিরে যান। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও নিয়মিত বাচ্চা সরবরাহ নিশ্চিত না করলে এই খামার কখনোই পুনরুজ্জীবিত হবে না। অথচ বছরের পর বছর শূন্য পদ পূরণের আবেদন ধুলায় পড়েই থাকে। বরাদ্দ না থাকায় জরাজীর্ণ শেডগুলো সংস্কারও করা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলো শুধু একের পর এক আশ্বাস দিয়ে দায় সারছে। এমনটা চলতে পারে না। জরুরি ভিত্তিতে এই খামারের পূর্ণ সংস্কার, জনবল নিয়োগ, হ্যাচারি আবার চালু এবং নষ্ট যন্ত্রপাতি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। রাজবাড়ীর এই গুরুত্বপূর্ণ খামারকে অব্যবস্থাপনার বেদিতে বলি দেওয়া আর চলতে পারে না। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে খামারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে আর বেশি সময় লাগবে না।

রাজবাড়ীর এই খামার শুধু মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের কেন্দ্রই নয়, স্থানীয় বাজারে মুরগির সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, দরিদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সাশ্রয়ী দামে মুরগির বাচ্চা দেওয়া, যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি—সবকিছুতেই এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সঠিকভাবে চালু হলে এটি জেলার প্রাণিসম্পদ খাতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলো আর দেরি না করে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেবে। যথাযথ সংস্কার, জনবল নিয়োগ ও হ্যাচারি চালুর মাধ্যমে এই খামারকে আবারও লাভজনক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সরকারি প্রতিষ্ঠানটি কি অবহেলায় ধ্বংস হবে