নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কমিটির তৎপরতার খবরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষোভ
Published: 8th, October 2025 GMT
নিষিদ্ধ সংগঠনের কাজ চালানোর কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা তাদের কমিটি সম্প্রসারিত করেছে। এই খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনা, অন্যান্য সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রতিক্রিয়া। সমালোচনার মুখে প্রশাসন বলছে, এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ দিলে তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনটির কমিটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগেই ছিল। গত ২৮ সেপ্টেম্বর সেই কমিটি বর্ধিত করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, ২০১ সদস্যের বর্ধিত কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। পদপ্রাপ্ত নেতাদের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দাপ্তরিক প্যাডে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি প্রকাশ করা হয়নি।
২০২২ সালের ১ জানুয়ারি ইব্রাহিম ফরাজিকে সভাপতি এবং এস এম আকতার হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ সদস্যের একটি আংশিক কমিটি অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে সম্প্রতি ক্যাম্পাসের বাইরে মিছিল করতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের। তা করতে গিয়ে অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
এখন কমিটি বর্ধিত করার খবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, যে সংগঠন নিষিদ্ধ, তাদের কমিটি কীভাবে হয়? এটি প্রশাসনের ব্যর্থতা ছাড়া কিছু নয়। যেখানে জুলাই আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে বিচার হওয়ার কথা, সেখানে তাদের নতুন কমিটি হচ্ছে!
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান হিমেল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত ১৭ বছর ধরে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী কায়দায় রাজনীতি করে ছাত্রদলসহ সব সক্রিয় ছাত্রসংগঠনকে ক্যাম্পাসের বাইরে রেখেছে। এখন তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রোষানলে পড়ে গুপ্ত রাজনীতি শুরু করেছে। নিষিদ্ধ এই ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা বাংলাদেশের সব ক্যাম্পাসের সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। ক্যাম্পাসে সুস্থ ধারার গণতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি ধ্বংসকারী এই সংগঠনের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে অবস্থান নেবে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি এ কে এম রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগ যেভাবে ক্যাম্পাসে দমন–পীড়ন চালিয়েছে এবং জুলাই আন্দোলনে আমাদের ওপর ন্যক্কারজনক হামলা করেছে, সেই অনুযায়ী তাদেরকে এখনো বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বারবার বলেছি, আপনারা ছাত্রলীগের যেসব নেতা–কর্মী অপরাধে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। কিন্তু তারা দায়সারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ছাত্রলীগের অনেকেই এখনো অনলাইনে সক্রিয় রয়েছে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি রিয়াজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফেসবুক ও কিছু সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে জানতে পেরেছি ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করেছে। ছাত্রলীগ একটি নিষিদ্ধ ও সন্ত্রাসী সংগঠন। যারা জুলাই গণ–অভ্যুত্থানসহ গত ১৭ বছর ধরে ছাত্ররাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস, দমন-পীড়ন ও নিপীড়নের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা যদি আবার সুযোগ পায়, তবে আগের মতো হত্যা, গুম, খুন ও সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু করবে। তাই তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। এখানে কোনো ধরনের শিথিলতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই।’
এদিকে কমিটি প্রকাশের পর অনলাইনে সরব হয়ে উঠেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। তাতে বলা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কোনো তোয়াক্কা তাঁরা করছেন না।
সভাপতি ইব্রাহিম ফরাজি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ছাত্রলীগ করার কারণে যদি বহিষ্কার করা হয়, তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বলে দিও, সভাপতি হিসেবে প্রথম বহিষ্কার যাতে আমাকে করা হয়!!!’ সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরুল কায়েস শিশির ফেসবুকে লেখেন, ‘এই পরিচয় জগন্নাথ ছাত্রলীগের প্রত্যেক নেতা–কর্মীর রক্ত দিয়ে কেনা। কেউ অস্বীকার করবে না। তোমাদের মব বাহিনী জীবন নিয়ে নিচ্ছে তাতে কেউ শঙ্কিত না আর বহিষ্কার। আর এত টেনশন কেন ক্যাম্পাসে তো এমনিতেই যাইতে দাও না।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি কামরুল হোসাইন এক বার্তায় প্রথম আলোকে জানান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যেকোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত নিলে, তাদের এই দায়ভার বহন করতে হবে।
কামরুল হোসাইন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৬ বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বর্তমান কর্তাব্যক্তিরা বিন্দুমাত্র নিগ্রহ কিংবা কটূ বাক্যের শিকার হয়নি, এখন তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে চাইলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও সেই দায়ভার বহন করতে হবে।’
ছাত্রলীগের সক্রিয় হয়ে ওঠা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক তাজাম্মুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু দেখা যায়নি। তারপরও কেউ যদি অভিযোগ দেয়, সেটা প্রমাণিত হওয়ার পর, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছে, এটা আমরা শুনেছি। তবে এখনো কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখিনি। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ দিলে তবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত ৪২১ শিক্ষার্থীর তালিকা দিয়ে তাঁদের বিচারের দাবি গত ২০ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জানিয়েছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি প্রশাসন। এতে ছাত্রলীগ কমিটি সক্রিয় করতে উৎসাহিত হচ্ছে বলে ছাত্রদলের অভিযোগ।
এ নিয়ে উপাচার্য বলেন, জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ততার অভিযোগ নিয়ে প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা যখন তথ্য উপস্থাপন করবেন, তখনই বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। ছাত্রদল যে তালিকা দিয়েছে, তা–ও কমিটির তত্ত্বাবধানে আছে। যাচাই-বাছাই করার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক সন ত র স ছ ত রদল ব যবস থ প রক শ র কম ট ফ সব ক র জন ত স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
মেঘে ঢাকা কেওক্রাডং পাহাড়ের টানে
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ১৭২ ফুট উঁচু কেওক্রাডং পাহাড়। সেখানে সারা দিন চলে মেঘের খেলা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলে গেছে রুমা-বগা লেক-ধুপানিছড়া সড়ক। সেনাবাহিনীর নির্মাণ করা এই সড়ক দেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ি সড়ক। শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো কোথাও উঁচু পাহাড়ি ঢাল, কোথাও খাদের দিকে নেমে গেছে সড়কটি।
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় কেওক্রাডংয়ের এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখার সুযোগ মিলছে পর্যটকদের। সেই সঙ্গে হাসি ফুটেছে লালা বমের মতো পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত উদ্যোক্তাদের মুখে। কেওক্রাডং পাহাড়চূড়ায় লালা বমের অবকাশযাপন কেন্দ্র প্রায় তিন বছর পর আবার পর্যটকে মুখর হয়ে উঠেছে। তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর যেন আর এমন ক্ষতি না করেন। এখন থেকে যেন আর পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা না আসে। যাতে তিন বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারি।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে লালা বমের সঙ্গে কেওক্রাডং পাহাড়চূড়ায় তাঁর অবকাশযাপন কেন্দ্রে বসে কথা হচ্ছিল। এর আগের দিন বুধবার থেকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কেওক্রাডং পাহাড়চূড়ায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরপরই বগা লেক হয়ে কেওক্রাডং পাহাড়ে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেছেন দল বেঁধে।
রুমা থানার পুলিশের হিসাবমতে, বুধ ও বৃহস্পতিবার কিছু স্থানীয় লোকসহ আড়াই হাজারের বেশি পর্যটক কেওক্রাডং পাহাড়ে গেছেন। সব ঠিকঠাক থাকলে মৌসুমে প্রতিদিন হাজারের বেশি পর্যটক আসবেন বলে মনে করছে পুলিশ। বগা লেক ও কেওক্রাডংয়ের পর্যটনশিল্পও দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।
পর্যটকেরা আসায় লালা বমের মতো দার্জিলিংপাড়া, বগা লেকের পর্যটননির্ভর বম জনগোষ্ঠীর সবাই আনন্দিত। বগা লেকের ব্যবসায়ী আমং বম বললেন, পর্যটনের ওপর নির্ভর করে বগা লেক পাড়া গড়ে উঠেছে। প্রায় তিন বছর ধরে পর্যটক আসা বন্ধ থাকায় তাঁরা খুবই সংকটে পড়েছেন। গত ৬ জুন বগা লেকে পর্যটন খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পর্যটকেরা শুধু বগা লেক ঘুরতে আসেন না, একই সঙ্গে কেওক্রাডং পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্যও উপভোগ করতে চান। এ জন্য কেওক্রাডং খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শত শত পর্যটক আসতে শুরু করেছেন। এতে কটেজ, রিসোর্টে কোনো কক্ষ খালি নেই। খাবারের দোকান, বাগানের ফল, কোমরতাঁতের কাপড় বিক্রি হচ্ছে। টাকা কিছুটা হলেও হাতে আসছে। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সময় লাগবে।
লালকিম বমের তিনটি অবকাশযাপন কেন্দ্রে ভালো পর্যটক আসছে। ১ থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত সব কটি কক্ষ আগাম বুক হয়ে গেছে। লালকিম বমও বললেন, দীর্ঘদিন পর্যটক না আসায় রিসোর্টের কাপড়চোপড়, বালিশ, দরজা-জানালা সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। সেগুলো জোগাড় করতে বহু ধারদেনা হয়েছে। পর্যটক আসতে থাকলে ঘুরে দাঁড়াতে আরও কয়েক মাস লাগবে।
তবে কেওক্রাডং পাহাড়চূড়ার পাশের দার্জিলিংপাড়ার অবস্থা এখনো পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) তৎপরতায় ৩০ পরিবারের পাড়ার অধিকাংশ বাসিন্দা পালিয়ে ছিলেন। পাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) লাল লমসাং বম জানালেন, কেএনএফের তৎপরতা না থাকায় ২২টি পরিবার বাড়িঘরে ফিরেছে। এখনো আটটি পরিবার পাড়ায় ফিরতে পারেনি। তাদের পাড়ায় পর্যটকদের থাকার কটেজ ও হোমেস্টে ব্যবস্থা চালু করতে আরও কিছু সময় লাগবে। তবে দ্রুত চালু করার চেষ্টা করছেন বলে জানালেন কার্বারি।
রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচির দুর্গম এলাকায় কেএনএফ নামে নতুন একটি সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতায় ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে কেওক্রাডং পাহাড়ে প্রশাসন পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ১ অক্টোবর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পাহাড়