আইসিটি আইন সংশোধন: অভিযুক্ত সবাই কি দোষী বলেই সাব্যস্ত হবেন
Published: 9th, October 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩–কে সময়োপযোগী করে তোলার লক্ষ্যে এর বেশ কিছু ধারা ইতিমধ্যে সংশোধিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ অক্টোবর আইনটির ধারা ২০-বি এর পর নতুন একটি ধারা ২০-সি সংযোজন করে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
নতুন এই ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল হলেই তিনি আর জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমনকি তিনি কোনো সরকারি চাকরিও করতে পারবেন না।
এতে আরও বলা হয়, উপরিউক্ত উপধারা (১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কোনো ব্যক্তি অব্যাহতি বা খালাসপ্রাপ্ত হলে ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই ধারা প্রযোজ্য হবে না।
আরও পড়ুনআইসিটি আইন: আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি এসেছে, আরও পরিবর্তন প্রয়োজন১২ ডিসেম্বর ২০২৪গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় আমাদের সামনে এসেছে একই সময়ে। আর তা হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ বিচারের জন্য আনুষ্ঠানিক তদন্তও শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ইতিমধ্যে একজন কর্মকর্তাকে এ অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অন্য দলের নাম এলে তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
১৯৭৩ সালের আইনের সংশোধন ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর ঘটনা দুটির আইনি ও রাজনৈতিক তাৎপর্য আলোচনার দাবি রাখে।
একটি আইনকে সময়োপযোগী করার জন্য তা সংশোধন করা আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে। তবে নতুন সংশোধনটির যে অংশটুকু নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন, তা হলো ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল’ হলেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ‘স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে’ অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া ও সরকারি চাকরি করতে না দেওয়ার শাস্তি দেওয়া।
আসুন দেখি রায় ও সাজা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ১৯৭৩ সালের আইনটিতে কী বলা আছে। ধারা ২০(১)-এ কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ বা নির্দোষতার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে তার ভিত্তির কারণ উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া ধারা ২০(২)-এ কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর, ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড বা অপরাধের গুরুত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য কোনো শাস্তি দেবে, যা ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়সংগত এবং যথাযথ বলে মনে হয়। অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেই কেবল তাঁকে শাস্তি দেওয়া যাবে।
শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ প্রমাণের সপক্ষে কারণও উল্লেখ করতে হবে। নতুন সংশোধিত ২০সি ধারাটি যৌক্তিকভাবেই উপরিউক্ত ২০(১) ও ২০(২) ধারা দুটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, নতুন ধারাটিতে অভিযোগ প্রমাণের আগেই শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
স্ব-আইনের অন্যান্য ধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি সংশোধিত নতুন ধারাটি আইনের নির্দিষ্ট একটি মৌলিক নীতির পরিপন্থীও বটে, যা প্রিজামশন অব ইনোসেন্স বা ‘নির্দোষতার অনুমান’ হিসেবেই পরিচিত। এই আইনি নীতি অনুসারে, যেকোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ‘সন্দেহাতীত’ভাবে অভিযোগ প্রমাণ করা না গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তি এমনকি খালাসও পেতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বা রোম সংবিধির ধারা ৬৬-তেও এই নীতি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যাপারেও তদন্ত হওয়ার আভাস দিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই যদি এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়ে থাকে, তবে আইনি জগতের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও জনগণের কাঠগড়ায় ঠিকই দাঁড় করাবে।এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির (আইসিসিপিআর) ধারা ১৪(২) এবং মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) ধারা ১১(১) অনুযায়ী নির্দোষতার অনুমান একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তি অনুমোদন করেছে এবং ইউডিএইচআরের নীতিগুলোর প্রতিও প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেছে। এই নীতি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের (আইএইচএল) একটি মূল নীতি হিসেবে উল্লেখিত আছে। তাই আইনিভাবে ও নীতিগতভাবে নির্দোষতার অনুমানের ধারাগুলো মেনে চলা বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক বলা যায়।
আমরা যদি বাংলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকাই, সেখানে নতুন দণ্ড প্রবর্তনের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘.
অথচ ১৯৭৩ সালের আইনের নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে প্রতীয়মান হচ্ছে যে অভিযোগ দাখিল হলেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন ও শাস্তি পাবেন; কিন্তু বিচারকাজ শেষে যদি প্রমাণিত হয় যে কোনো একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ, যাঁকে ইতিমধ্যে ধারা ২০-সির মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী হবে বলে মনে করি। নাকি এখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে অভিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তি দোষী বলেই সাব্যস্ত হবেন? তাহলে সেটি হবে মিসক্যারেজ অব জাস্টিস বা বিচারিক ভুলের অনুপম উদাহরণ।
১৯৭৩-এর আইনের ধারার এই সংশোধনীর একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই যে এই নতুন ধারার সংযোজন করা হয়েছে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে রাজনৈতিক কারণে আইনকে ব্যবহারের উদাহরণ এই প্রথম নয়। আগের বিভিন্ন সরকারের আমলেও আইনের রাজনীতিকরণের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ। তাহলে অভ্যুত্থানের ‘নতুন বন্দোবস্তের’ চেতনা কি এক বছরেই হারিয়ে গেল? বাংলাদেশের মানুষ কি এবারও এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পেল না?
পরিশেষে বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই আইন সংশোধনের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের আনুষ্ঠানিক তদন্তের শুরু কাকতালীয় কোনো সিদ্ধান্ত কি না, ভেবে দেখা দরকার।
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ব্যাপারেও তদন্ত হওয়ার আভাস দিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই যদি এই উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়ে থাকে, তবে আইনি জগতের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও জনগণের কাঠগড়ায় ঠিকই দাঁড় করাবে।
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ব চনক র জন ত ক অপর ধ র অন ম ন র র জন র জন য হওয় র আইন র র আইন তদন ত সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে নির্বাচনের অযোগ্য হবেন: চিফ প্রসিকিউটর
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হলে সেই ব্যক্তি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমন ব্যক্তি সরকারি চাকরিও করতে পারবেন না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ আনা সংশোধনে এসব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আজ মঙ্গলবার দুপুরে এ তথ্য জানান।
আরও পড়ুনমানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিচার শুরু ০৩ আগস্ট ২০২৫ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিংয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ আরেকটি সংশোধন আনা হয়েছে। এই সংশোধনীর মূল বিষয় হলো, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল হয়, তাহলে তিনি বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হবেন না। অর্থাৎ, তিনি জাতীয় নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। একইভাবে সেই ব্যক্তি কোনো সরকারি চাকরি করতে পারবেন না।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু, তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ: চিফ প্রসিকিউটর১ ঘণ্টা আগে