রাত সাড়ে ১২টা। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেবল দূর থেকে ভেসে আসছে নদীর কলকল ধ্বনি। এর মধ্যেই বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গায় দুটি প্লাস্টিকের ঝুড়ি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সেলিম হাওলাদার। বন থেকে আনা হরিণের মাংস পলিথিনে মুড়িয়ে রাখছিলেন। আত্মীয়দের কাছে হরিণের মাংস ভোরের আগেই পৌঁছে দিতে হবে—এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেল সবকিছু।

সেলিমের দরজায় তখন কড়া নাড়ে নৌবাহিনী ও পুলিশের যৌথ দল। হতভম্ব সেলিমের হাতে তখনো মাংসবোঝাই প্লাস্টিকের ঝুড়ি। পালানোরও সময় মিলল না। নিজ বাড়ির সামনেই ৪৪ কেজি হরিণের মাংসসহ ধরা পড়েন তিনি।

গতকাল বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খুলনার কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আজ শুক্রবার সকালে কয়রায় নিয়োজিত নৌবাহিনীর কন্টিনজেন্ট কমান্ডার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে সুন্দরবন-সংলগ্ন ওই গ্রামে অভিযান চালিয়ে হরিণের মাংসসহ সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে কয়রা থানার পুলিশও অংশ নেয়। পরে জব্দ করা মাংস ও আটক ব্যক্তিকে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কয়রা থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

আরও পড়ুনসুন্দরবনে কোস্টগার্ডের অভিযানে দস্যুদের কবল থেকে ৪ জেলে উদ্ধার০৩ অক্টোবর ২০২৫

সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লোকালয়ের পাশের একটি সরু নদী পেরোলেই শুরু হয় গভীর জঙ্গল। এ সুযোগে পেশাদার হরিণশিকারিরা রাতের আঁধারে সুন্দরবনে ঢুকে হরিণের চলাচলের পথে দড়ির ফাঁদ পেতে রাখেন। পরে প্রাণীগুলো সেই ফাঁদে আটকে যায়। এরপর বনের ভেতরেই জবাই করে মাংস ভাগ করে নেওয়া হয়। আগেই যেসব বাড়ি থেকে আগাম টাকা নেওয়া থাকে, সেসব বাড়িতে গোপনে পৌঁছে যায় মাংস।

আরও পড়ুনসুন্দরবনে কেওড়ার মৌসুমে বানরের হৃষ্টপুষ্ট চেহারা০২ অক্টোবর ২০২৫

একই কথা জানান কয়রা থানার উপপরিদর্শক তারেক মাহমুদ। তিনি বলেন, এলাকাটিতে বন্য প্রাণী শিকারসহ নানা বন-অপরাধ বেশি হয়। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মধ্যরাতে সেখানে গিয়ে সেলিমকে হাতেনাতে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিম হাওলাদার জানান, তাঁর কয়েকজন আত্মীয় হরিণের মাংস খেতে চেয়েছিলেন। তাই শিকারিদের কাছ থেকে সেই মাংস কেনেন।

কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে শিগগিরই আদালতে সোপর্দ করা হবে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী উদ্ধার করা হরিণের মাংস বিনষ্ট করা হবে। এ ধরনের অপরাধ দমনে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুনলোকালয়ের প্লাস্টিক বর্জ্য সুন্দরবনে, যায় মাছের পেটেও২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনে হরিণ শিকার রোধে টানা অভিযান, তিন দিনে সাড়ে ৯ হাজার ফুট ফাঁদ উদ্ধার

মোংলার সুন্দরবনসংলগ্ন পশুর নদের তীরের কানাইনগর এলাকা। চারদিকে নোনা হাওয়া আর নদীর গন্ধে ভরা নীরবতা। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে সেই নীরবতা ভাঙে কোস্ট গার্ড ও পুলিশের যৌথ অভিযানে।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় একটি ঝুপড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ কেজি হরিণের মাংস, দুটি মাথা, আটটি পা ও আড়াই হাজার মিটার লম্বা ফাঁদ। ঘটনাস্থল থেকেই একজন শিকারিকে আটক করা হয়।

সুন্দরবনের বিভিন্ন টহলফাঁড়ি এলাকায় টানা অভিযান চলছে। গত তিন দিনে উদ্ধার করা হয়েছে ৯ হাজার ৪১০ ফুট ফাঁদ।

এ বিষয়ে কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম–উল–হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আটক শিকারির সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে সুন্দরবনের বন্য প্রাণী শিকারের নানা আলামত। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান চলবে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বুধবার বন বিভাগের চরপুটিয়া টহলফাঁড়ির বনরক্ষীদের টহলে গহিন জঙ্গলের চরের খাল এলাকা থেকে উদ্ধার হয় ৮০০ ফুট লম্বা হরিণ শিকারের পেতে রাখা ফাঁদ। একই দিনে হুলার ভারানী ও সূর্যমুখী খালসংলগ্ন বনাঞ্চলে হেঁটে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় আরও ১৩৫ ফুট লম্বা ফাঁদ।

এর আগের দিন মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চরপুটিয়া ফাঁড়ির টহলে উদ্ধার হয় আরও দুটি ফাঁদ—একটি ৫০০ ফুট লম্বা, আরেকটি বস্তায় ভরা অবস্থায়। একই দিনে শেলার চর এলাকার ভাঙ্গার খাল থেকে উদ্ধার করা হয় ৩০০ ফুট লম্বা ফাঁদ।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের খালে নৌকায় ‘হিমায়িত’ ৪৮ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার১৪ অক্টোবর ২০২৫

সোমবার শেলার চর টহলফাঁড়ির বনরক্ষীরা আদানি–গুড়গুড়ি বনাঞ্চলে টহলের সময় কেওড়া ও গরানগাছের মাঝখানে মালা ফাঁদ দেখতে পান। প্রায় ২০০ ফুট লম্বা এসব ফাঁদ জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। একই দিনে জোংড়া টহলফাঁড়ির বনাঞ্চল থেকে উদ্ধার হয় আরও ২৫০ ফুট ফাঁদ। তার আগের দিন ২৩ নভেম্বর মুচিরদোয়ানি খালের পাশের বনাঞ্চল থেকে ১৫০ মিটার ফাঁদ উদ্ধার করে বন বিভাগ।

স্থানীয় গ্রামবাসী ও শিকারি হিসেবে পূর্বে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনের যেখানে কেওড়াগাছ বেশি, সেসব এলাকায় হরিণ চলাচল তুলনামূলক বেশি। শিকারিরা দড়ি দিয়ে ‘ডোয়া’ নামে লম্বা ফাঁদ তৈরি করে হরিণের চলার পথে রাখে। এতে চলাফেরার সময় হরিণ আটকা পড়ে। ‘ছিটকে ফাঁদ’ নামে আরেক ধরনের ফাঁদে ধরা পড়ে হরিণ। শিকারিরা সাধারণত দড়ির বোঝা নিয়ে বনে ঢোকে এবং ভেতরেই ফাঁদ তৈরি করে। পরে এসব ফাঁদ বস্তায় ভরে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়, বারবার ব্যবহারের জন্য।

আরও পড়ুনসুন্দরবনে ফাঁদে আটকে ছটফট করছিল প্রাণীটি১৯ অক্টোবর ২০২৫

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এখন ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’ পদ্ধতিতে সারিবদ্ধভাবে বনের ভেতর হেঁটে টহল দেওয়া হয়, যাতে চিরুনির মতো অগ্রসর হয়ে ফাঁদ দ্রুত শনাক্ত করা যায়। বাঘ–কুমিরের ঝুঁকি থাকলেও নিয়মিত কাউন্ট ও কথা বলতে বলতে বনের ভেতর দিয়ে এগোলে নিরাপত্তা থাকে। তিনি বলেন, ‘হরিণকে বাঁচাতেই হবে, না হলে বাঘও বাঁচবে না। হেঁটে টহল দেওয়ায় অনেক ফাঁদ আগেই শনাক্ত হচ্ছে, এতে বহু হরিণ রক্ষা পাচ্ছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৮ বস্তা শামুক-ঝিনুক উদ্ধার
  • সুন্দরবনে হরিণ শিকার রোধে টানা অভিযান, তিন দিনে সাড়ে ৯ হাজার ফুট ফাঁদ উদ্ধার