বাংলাদেশের দক্ষিণের সবুজ বিস্ময় সুন্দরবন আবারও রোমাঞ্চ জাগিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে পূর্ব সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া ইকো পর্যটনকেন্দ্রের ফুট ট্রেইলে দেখা মিলেছে এক বিশালাকৃতির রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। পর্যটক ও বনরক্ষীরা হঠাৎই দেখতে পান, বনের পথের মাঝখানে শান্তভাবে রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে বাঘটি। যেন সে-ই এই বনের প্রকৃত অধিপতি।

অপ্রত্যাশিত এই দৃশ্য দেখে অনেকে থমকে যান, কেউবা মুঠোফোন হাতে মুহূর্তটি ধরে রাখেন। কয়েক সেকেন্ড পর বাঘটি মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকায়, আর বনপ্রহরীদের হাঁকডাকে ধীরে ধীরে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে যায়। মুহূর্তেই ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ২৯ সেকেন্ডের সেই ভিডিওটি এখন সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

এত কাছ থেকে বাঘ দেখা সত্যিই এক বিরল অভিজ্ঞতা। পর্যটকেরা তখন ট্রেইলে হাঁটছিলেন, হঠাৎ সামনে এই দৃশ্য! আমরা দ্রুত সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে দিই এবং বাঘটিকেও বনে ফিরিয়ে দিই। এত কাছে বাঘ দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এটা একই সঙ্গে ভীতিকর ও রোমাঞ্চকর।কে এম রমজান আলী, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র

হাড়বাড়িয়া ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম রমজান আলী বলেন, ‘এত কাছ থেকে বাঘ দেখা সত্যিই এক বিরল অভিজ্ঞতা। পর্যটকেরা তখন ট্রেইলে হাঁটছিলেন, হঠাৎ সামনে এই দৃশ্য! আমরা দ্রুত সবাইকে নিরাপদে সরিয়ে দিই এবং বাঘটিকেও বনে ফিরিয়ে দিই। এত কাছে বাঘ দেখার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন, এটা একই সঙ্গে ভীতিকর ও রোমাঞ্চকর।’

এর আগেও সুন্দরবনে পর্যটকেরা এমন ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। খুলনার কয়রা উপজেলার বন বিভাগের সহযোগী হিসেবে কর্মরত সাইফুল ইসলাম জানালেন, গত আগস্টে সুন্দরবনের শেখেরটেক ইকো ট্যুরিজম এলাকায় গিয়ে তিনি হঠাৎই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হন।

সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রধান বন সংরক্ষক আসবেন শুনে আমরা এক দিন আগে ট্রলার নিয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। সকালে ট্রলার থেকে নেমে কিছুটা হেঁটে সামনে যেতেই দেখি—ট্যুরিস্টদের বসার বেঞ্চের ওপর টান হয়ে শুয়ে আছে বিশাল এক বাঘ। মুহূর্তেই আমার রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে পিছিয়ে গিয়ে আবার ট্রলারে ফিরে আসি।’

এর আগে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বড় কটকা খালে বাঘ দেখেছিলেন পর্যটকবাহী জলযান ‘দি সেইল’–এর যাত্রীরা। বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন বড় কটকা খাল দিয়ে নৌযানটি চলার সময় হঠাৎ দেখা যায়—একটি বাঘ ধীরে ধীরে খাল পার হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বাঘটি নদী পার হয়ে বনের গভীরে মিলিয়ে যায়।

এরও আগে, ১৯ জানুয়ারি কটকা অভয়ারণ্য এলাকায় একসঙ্গে তিনটি বাঘ দেখতে পান পর্যটকেরা। তাঁদের চোখের সামনেই ঘটে এক বিরল দৃশ্য—দুটি বাঘ মিলে অপর একটি বাঘকে আক্রমণ করে নদীতে ফেলে দেয়। এমন অবিশ্বাস্য মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে অভিভূত হন উপস্থিত সবাই।

হাড়বাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন শতাধিক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে জানা ছিল, বনের এই অংশে বাঘের বিচরণ রয়েছে, কিন্তু এবার দেখা গেল সরাসরি ফুট ট্রেইলে। এটা নতুন অভিজ্ঞতা, এবং এর মানে হলো—বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।মো.

রেজাউল করিম চৌধুরী, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ

বাংলাদেশের সুন্দরবনকে বলা হয় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজ্য। একসময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপপ্রজাতি ছিল, কিন্তু এখন টিকে আছে মাত্র ছয়টি। তার মধ্যেও আকৃতি, সৌন্দর্য ও রহস্যে সুন্দরবনের বাঘ অনন্য। প্রাণিবিদদের মতে, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কাদা, নদী ও গাছঘেরা কঠিন পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই এদের দেহ তুলনামূলকভাবে ছোট, কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, শক্তি ও অভিযোজন ক্ষমতায় তারা অপরাজেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের সব উপপ্রজাতির তুলনায় সুন্দরবনের বাঘ আকারে সবচেয়ে ছোট। সুন্দরবন ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারে বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়। তবে পার্থক্য শুধু দেহের আকারে—আচরণ ও রঙে তারা প্রায় এক।’

এই বাঘের গায়ের রং সাধারণত হলুদ থেকে হালকা কমলা, গা জুড়ে গাঢ় খয়েরি বা কালো ডোরা। পেট সাদা, লেজে কালো আংটির মতো দাগ। প্রতিটি বাঘের ডোরার নকশা একেবারেই আলাদা—যেমন মানুষের আঙুলের ছাপ। দুর্দান্ত সাঁতারু এই বাঘ সহজেই এক কিলোমিটার নদী পেরিয়ে যেতে পারে। বাঘ বিশেষজ্ঞরা পায়ের ছাপ দেখে নির্ধারণ করতে পারেন, এটি পুরুষ বাঘের না স্ত্রী বাঘের।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বললেন, ‘হাড়বাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। প্রতিদিন শতাধিক দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন। আগে জানা ছিল, বনের এই অংশে বাঘের বিচরণ রয়েছে, কিন্তু এবার দেখা গেল সরাসরি ফুট ট্রেইলে। এটা নতুন অভিজ্ঞতা, এবং এর মানে হলো—বনে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।’

২০১৮ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪। সর্বশেষ ২০২৪ সালের হিসাবে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫–এ। অর্থাৎ ছয় বছরে বেড়েছে ১১টি বাঘ।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন র কর মকর ত পর যটক র এত ক ছ এক ব র

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনে হরিণ শিকার রোধে টানা অভিযান, তিন দিনে সাড়ে ৯ হাজার ফুট ফাঁদ উদ্ধার

মোংলার সুন্দরবনসংলগ্ন পশুর নদের তীরের কানাইনগর এলাকা। চারদিকে নোনা হাওয়া আর নদীর গন্ধে ভরা নীরবতা। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে সেই নীরবতা ভাঙে কোস্ট গার্ড ও পুলিশের যৌথ অভিযানে।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় একটি ঝুপড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় ৩২ কেজি হরিণের মাংস, দুটি মাথা, আটটি পা ও আড়াই হাজার মিটার লম্বা ফাঁদ। ঘটনাস্থল থেকেই একজন শিকারিকে আটক করা হয়।

সুন্দরবনের বিভিন্ন টহলফাঁড়ি এলাকায় টানা অভিযান চলছে। গত তিন দিনে উদ্ধার করা হয়েছে ৯ হাজার ৪১০ ফুট ফাঁদ।

এ বিষয়ে কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম–উল–হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আটক শিকারির সঙ্গে উদ্ধার হয়েছে সুন্দরবনের বন্য প্রাণী শিকারের নানা আলামত। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান চলবে।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বুধবার বন বিভাগের চরপুটিয়া টহলফাঁড়ির বনরক্ষীদের টহলে গহিন জঙ্গলের চরের খাল এলাকা থেকে উদ্ধার হয় ৮০০ ফুট লম্বা হরিণ শিকারের পেতে রাখা ফাঁদ। একই দিনে হুলার ভারানী ও সূর্যমুখী খালসংলগ্ন বনাঞ্চলে হেঁটে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করা হয় আরও ১৩৫ ফুট লম্বা ফাঁদ।

এর আগের দিন মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চরপুটিয়া ফাঁড়ির টহলে উদ্ধার হয় আরও দুটি ফাঁদ—একটি ৫০০ ফুট লম্বা, আরেকটি বস্তায় ভরা অবস্থায়। একই দিনে শেলার চর এলাকার ভাঙ্গার খাল থেকে উদ্ধার করা হয় ৩০০ ফুট লম্বা ফাঁদ।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের খালে নৌকায় ‘হিমায়িত’ ৪৮ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার১৪ অক্টোবর ২০২৫

সোমবার শেলার চর টহলফাঁড়ির বনরক্ষীরা আদানি–গুড়গুড়ি বনাঞ্চলে টহলের সময় কেওড়া ও গরানগাছের মাঝখানে মালা ফাঁদ দেখতে পান। প্রায় ২০০ ফুট লম্বা এসব ফাঁদ জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। একই দিনে জোংড়া টহলফাঁড়ির বনাঞ্চল থেকে উদ্ধার হয় আরও ২৫০ ফুট ফাঁদ। তার আগের দিন ২৩ নভেম্বর মুচিরদোয়ানি খালের পাশের বনাঞ্চল থেকে ১৫০ মিটার ফাঁদ উদ্ধার করে বন বিভাগ।

স্থানীয় গ্রামবাসী ও শিকারি হিসেবে পূর্বে দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনের যেখানে কেওড়াগাছ বেশি, সেসব এলাকায় হরিণ চলাচল তুলনামূলক বেশি। শিকারিরা দড়ি দিয়ে ‘ডোয়া’ নামে লম্বা ফাঁদ তৈরি করে হরিণের চলার পথে রাখে। এতে চলাফেরার সময় হরিণ আটকা পড়ে। ‘ছিটকে ফাঁদ’ নামে আরেক ধরনের ফাঁদে ধরা পড়ে হরিণ। শিকারিরা সাধারণত দড়ির বোঝা নিয়ে বনে ঢোকে এবং ভেতরেই ফাঁদ তৈরি করে। পরে এসব ফাঁদ বস্তায় ভরে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখা হয়, বারবার ব্যবহারের জন্য।

আরও পড়ুনসুন্দরবনে ফাঁদে আটকে ছটফট করছিল প্রাণীটি১৯ অক্টোবর ২০২৫

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, এখন ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’ পদ্ধতিতে সারিবদ্ধভাবে বনের ভেতর হেঁটে টহল দেওয়া হয়, যাতে চিরুনির মতো অগ্রসর হয়ে ফাঁদ দ্রুত শনাক্ত করা যায়। বাঘ–কুমিরের ঝুঁকি থাকলেও নিয়মিত কাউন্ট ও কথা বলতে বলতে বনের ভেতর দিয়ে এগোলে নিরাপত্তা থাকে। তিনি বলেন, ‘হরিণকে বাঁচাতেই হবে, না হলে বাঘও বাঁচবে না। হেঁটে টহল দেওয়ায় অনেক ফাঁদ আগেই শনাক্ত হচ্ছে, এতে বহু হরিণ রক্ষা পাচ্ছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৮ বস্তা শামুক-ঝিনুক উদ্ধার
  • সুন্দরবনে হরিণ শিকার রোধে টানা অভিযান, তিন দিনে সাড়ে ৯ হাজার ফুট ফাঁদ উদ্ধার