বাংলাদেশের ইতিহাস–পাঠের ক্ষেত্রে হরহামেশা যে গলদ চোখে পড়ে, তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোর নিরিখে চিহ্নিত করা সম্ভব। ইতিহাসকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির নিরিখে না দেখে কেবলই তা রাষ্ট্রীয় কিংবা নির্ধারিত ক্ষমতাকাঠামোর বিবেচনায় দেখার ঐতিহাসিক প্রবণতার কারণে অনেক সময় বৃহৎ জনসমাজ বিবেচনার বাইরে রয়ে যায়। সাংস্কৃতিক রাজনীতি যেসব বিষয় নিয়ে তার আলোচনা জারি রাখে তার মধ্যে অন্যতম সংস্কৃতি ও ক্ষমতা-সম্পর্ক। বাংলাদেশ-পাঠের ক্ষেত্রে রাফাত আলম এই দুই বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর জোর দিয়েছেন।
এই গ্রন্থে ইতিহাসের যে ধারণা বা তত্ত্ব ব্যবহৃত হয়েছে, তা প্রথাগত কাঠামোবাদী ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে আলাদা তা বলা যায়। এখানে লেখক ঐতিহাসিক সমালোচনামূলক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই পদ্ধতি রাফাত আলম এই গ্রন্থে কীভাবে কার্যকর রেখেছেন? শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গে লেখা প্রবন্ধটির দিকে নজর দিলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নির্দলীয় ইতিহাস-নির্মাণ বিবেচনায় না রেখে প্রায়ই তাঁকে দলীয় বিচার-বিবেচনায় বিচার করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের যাত্রা শুরু করেছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের ভেতর দিয়ে, তা অনেকেই চেপে যেতে চান। কিন্তু এই যে পাকিস্তান-আন্দোলন এবং তার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্ক চেপে যাওয়া—একার্থে তা তাঁর সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাসকে এড়িয়ে একটি স্বার্থসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ করা, যা সুবিধাবাদী ধারণার ভেতরেই প্রোথিত থাকে। এই গ্রন্থের “শেখ মুজিবের ‘পাকিস্তান-আন্দোলন’ পাঠ: আত্মজীবনীর দর্পণে” শীর্ষক প্রথম প্রবন্ধে জীবনী-সাহিত্যের পটভূমিকায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক কর্মতত্পরতার বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম: ‘মুনীর চৌধুরীর গল্পসাহিত্য: নবোদ্ভিন্ন বাঙালির জীবনভাষ্য’। প্রবন্ধটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মুনীর চৌধুরীর গল্প নিয়ে। কিন্তু এই প্রবন্ধের বিষয় কেবল গল্প নয়, বরং গল্পের সীমানা পেরিয়ে ঢাকায় নতুন রাষ্ট্র নির্মাণ-সময় আর সেই সময়ে যাপিত মানুষজনের কাছে নিয়ে যায়।
এই প্রবন্ধগ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ অ্যাকাডেমিক সংগঠক মুহম্মদ আবদুল হাই: ‘পাকিস্তান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’। যে কেউ আবদুল হাই সম্পর্কে জানতে গেলে এই সত্য খুঁজে পাবেন যে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম দিকে তীব্রভাবে পাকিস্তানপন্থী ছিলেন। রাফাত আলম প্রবন্ধটিতে আবদুল হাইয়ের এই চিন্তা-ধারণা আর কর্মপরিসরের সক্রিয়তা বিষয়েই আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।
গ্রন্থটির প্রতিটি প্রবন্ধে লেখকের এই দৃষ্টিভঙ্গি সক্রিয় থেকেছে। ইতিহাসের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার বিবেচনায় ‘বাংলাদেশ-পাঠ’ বিষয়টি তাই ভিন্ন মাত্রা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। পাঠক গ্রন্থ পাঠের পর এই সত্য নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারবেন।
বাংলাদেশ পাঠ: সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার অনুষঙ্গে
রাফাত আলম
প্রকাশক: ইউপিএল
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: আল নোমান;
পৃষ্ঠা: ১৫৪; মূল্য: ৬০০ টাকা
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন র জন ত ক প রবন ধ গ রন থ জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
পাঠক বাড়াতে বহুমুখী উদ্যোগ নিন
পাবনা শহরের আবদুল হামিদ সড়কে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ১৩৫ বছরের প্রাচীন অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি। ১৮৯০ সালে মাত্র দুটি কক্ষ নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই জ্ঞানতীর্থ আজ বিশাল সাদা চারতলা ভবনে বিস্তৃত। ৩৮ হাজার বইয়ের বিশাল সংগ্রহ নিয়ে এটি নিঃসন্দেহে জ্ঞানের এক অমূল্য ভান্ডার। দুঃখজনক হচ্ছে, এই লাইব্রেরিতে সেই অর্থে তেমন কোনো পাঠক নেই।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, লাইব্রেরিটিতে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষার অসংখ্য পুরোনো বই, কিংবদন্তি লেখকদের দুর্লভ বই ও তালপাতায় হাতে লেখা অসংখ্য পাণ্ডুলিপি সযত্নে সংরক্ষিত আছে। আছে নতুন বইও। দারুণ ব্যাপার হচ্ছে, শিশুতোষ বই দিয়ে সাজানো শিশুদের জন্য আলাদা পাঠকক্ষও রয়েছে। বলা যায়, আধুনিক ভবনে এমন সমৃদ্ধ লাইব্রেরি দেশে কমই আছে। তবে লাইব্রেরিটির মহাসচিব, প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল মতীন খান হতাশা নিয়ে বললেন, ‘দিন দিন পাঠক কমে যাচ্ছে। শিক্ষক-গবেষকেরা আসেন না বললেই চলে। পেশাজীবীদেরও দেখা পাওয়া যায় না। তরুণদের মধ্যে যাঁরা আসেন, তাঁরা চাকরির প্রস্তুতির বই পড়েন।’
পাঠক কমে যাওয়ার এই প্রবণতা শুধু অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির নয়, এই প্রবণতা এখন বিশ্বজুড়ে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটে তরুণ প্রজন্মের পাঠাভ্যাস আমূল পাল্টে গেছে। দীর্ঘ প্রবন্ধ বা গবেষণামূলক বইয়ের বদলে তারা দ্রুত তথ্য এবং বিনোদনের দিকে ঝুঁকছে। আর এ দেশে গ্রন্থাগার এখন অনেকের কাছে ‘নলেজ হাব’-এর চেয়ে ‘চাকরি প্রস্তুতির কেন্দ্র’ হয়ে উঠেছে।
পাবনার এ লাইব্রেরির অমূল্য সংগ্রহগুলোকে কেবল সংরক্ষণ করাই যথেষ্ট নয়, এগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার চ্যালেঞ্জও নিতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ। স্যামসন এইচ চৌধুরীর মতো শিল্পপতিরা অতীতে নতুন ভবন নির্মাণে সহযোগিতা করলেও, এই বিশাল সংগ্রহের রক্ষণাবেক্ষণ, ডিজিটালাইজেশন এবং পাঠোদ্ধারের মতো বিশেষজ্ঞ কাজের জন্য নিয়মিত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। সরকারের বার্ষিক ৫০ হাজার টাকার অনুদান, যার অর্ধেক বই কেনায় যায়, তা গ্রন্থাগারের মাসিক ১ দশমিক ৫ লাখ টাকার খরচের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
পাঠক বৃদ্ধির জন্য চাকরি প্রস্তুতি বাদেও সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও বিতর্ক নিয়ে কর্মশালা এবং সেমিনারের আয়োজন করে তরুণদের আকৃষ্ট করতে হবে। স্থানীয় স্কুল-কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বছরজুড়ে কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্য জ্ঞানচর্চার প্রতি আগ্রহও তৈরি হবে। লাইব্রেরিকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম উৎসাহিত করতে হবে। আশা করি, লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে।