শুরুতেই বড় সাফল্য দুই কৃষি উদ্যোক্তার
Published: 14th, October 2025 GMT
কাঁচা আম শুকিয়ে শুকনা আম হিসেবে তা বিক্রি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই কৃষি উদ্যোক্তা। শুকনা আম বানানো এত কঠিন কী, আর তাতে লাভই–বা কত? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। শুরুতেই জানিয়ে দিই, শুকনা আমের বৈশ্বিক বাজার ২২৪ কোটি মার্কিন ডলারের। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১২২ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় সোয়া ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
শুকনা আমের বৈশ্বিক এই বাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে। অথচ দেশে প্রতিবছর আমের উৎপাদন ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন। যার প্রায় ৪০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এই নষ্ট হওয়া আম থেকে মজাদার শুকনা আম তৈরি করছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি উদ্যোক্তা মো.
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে, প্রতিবছর আমের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বৈশ্বিক বাজার ২৫ বিলিয়ন ডলার বা তিন লাখ কোটি টাকার সমান। শুকনা আম, আমের পাউডার, কসমেটিক পণ্যসহ নানা পণ্য তৈরি হচ্ছে আম থেকে। বিশ্বের শীর্ষ আম উৎপাদনকারী ১০টি দেশের মধ্যে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম অবস্থান বাংলাদেশের; কিন্তু আমজাত পণ্যের উৎপাদন নেই বললেই চলে। দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আমসত্ত্ব, বার বা কেচাপ তৈরি করে; কিন্তু শুকনা আম উৎপাদনে বড় কোনো শিল্প নেই।
শুরুটা যেভাবে
করপোরেট সংস্থার চাকরি ছেড়ে কৃষি উদ্যোক্তা হন মুনজের আলম। বছর পাঁচেক আগে শুরু করেছেন আম দিয়ে নানা পণ্য বানানো। আমের পাউডার দিয়ে শুরু। এ বছর শুকনা আম বানিয়েছেন ‘বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ’ ও ‘শুদ্ধ’ নামের প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মুনজের। জাপানের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা পেয়েছেন। এ বছর ৭০০ কেজি শুকনা আম বানিয়েছেন। প্রতি কেজির দাম অনলাইনে ২ হাজার ৪০০ টাকা। আর প্রতি কেজি আমের পাউডারের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা।
মুনজের আলম বলেন, ‘এ বছর যত শুকনা আম বানানো হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। এই শুকনা আম দেড় বছর পর্যন্ত ব্যবহারোপযোগী থাকবে। আগামী বছর অন্তত ২০ মেট্রিক টন শুকনা আম তৈরি করতে চাই। যার বেশির ভাগ যাবে দেশের বাইরে। আম ছাড়াও বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ শুকনা কাঁঠাল ও পেয়ারা বানিয়েছে। এসব পণ্যের ব্যবসাও ভালো চলছে। আগামী বছর কলা ও আনারস দিয়ে একই ধরনের পণ্য বানানো হবে।’
* এ বছর ৭০০ কেজি শুকনা আম তৈরি করেছেন উদ্যোক্তা মুনজের আলম, বিক্রিও হয়ে গেছে সব* আরেক উদ্যোক্তা ইসমাইল খান তৈরি করেছেন ৩০০ কেজি শুকনা আম, পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে
* প্রতিকেজি শুকনা আমের দাম ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৪০০ টাকা
শুকনা আম বানানো শিখতে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আরেক কৃষি উদ্যোক্তা ইসমাইল খান শামীম। সুইজারল্যান্ডের একটি সংস্থার সহায়তায় ছিল এ যাত্রা; কিন্তু থাইল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রযুক্তি ধার দিতে চায়নি। অগত্যা দেশে ফিরে নিজ উদ্যোগে এ বছর শুকনা আম বানিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন চার ঘণ্টা এই আম বানানোর কাজে ব্যয় করেছেন তিনি। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম কাটিমন আম দিয়ে শুকনা আম বানানোর চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু রং ভালো হয়নি। অতঃপর সাতক্ষীরার গোবিন্দভোগ আম দিয়ে চেষ্টা শুরু। সেটিও খুব ভালো হয়নি। অবশেষে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আশ্বিনা দিয়ে সফলতা পেয়েছেন এ বছর।
নওয়াবি ম্যাঙ্গো নামের প্রতিষ্ঠানের প্রধান ইসমাইল খান বলছিলেন, ‘৪০ বার ৪০ মণ আম দিয়ে শুকনা আম বানানোর চেষ্টা করেছি। অবশেষে সফল হয়েছি। স্বাদ ও রং অপূর্ব। এটা অনেক বিক্রিও হয়েছে। এক মণ কাঁচা–পাকা আমে চার কেজির মতো শুকনা আম হয়। কেজিপ্রতি শুকনা আম দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এবার ৩০০ কেজি শুকনা আম তৈরি করেছেন, তার পুরোটাই বিক্রি হয়ে গেছে। আগামী বছর ১৩ টন শুকনা আম করতে চান এই উদ্যোক্তা।
এ বছর যত শুকনা আম বানানো হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে। এই শুকনা আম দেড় বছর পর্যন্ত ব্যবহারোপযোগী থাকবে। আগামী বছর অন্তত ২০ মেট্রিক টন শুকনা আম তৈরি করতে চাই। মুনজের আলম, উদ্যোক্তা, বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগআমজাত পণ্য ও শুকনা আমের বাজার
এক্সপার্ট মার্কেট রিসার্চ, কগনিটিভ মার্কেট রিসার্চ ও গ্র্যান্ডভিউ রিসার্চ নামের তিনটি বৈশ্বিক বাজার গবেষণা ও পরামর্শক সংস্থার হিসাবে, সারা বিশ্বে গত বছর আমজাত পণ্যের বাজার ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার। এই বাজারের মধ্যে রয়েছে আমের জুস, শুকনা আম, আমের তৈরি পাউডার ইত্যাদি পণ্য। এর মধ্যে ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা শুকনা আমের। শুকনা আমের বৈশ্বিক এই বাজারে বাংলাদেশের কোনো অংশগ্রহণ নেই। অথচ প্রতিবছর ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব পণ্যের বৈশ্বিক বাজার।
কৃষি উদ্যোক্তা মুনজের আলম বলেন, ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের বাজার প্রায় সাত হাজার কোটি টাকার। আশপাশের অন্য জেলার আমও যদি প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তবে এই বাজারের পরিমাণ দাঁড়াবে ২২ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।’
দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর প্রায় শতকোটি টাকার আমের পাউডার আমদানি করে। এ কারণে মুনজের ও ইসমাইল দুজনই আমের পাউডার তৈরি শুরু করেছেন।
৪০ বার ৪০ মণ আম দিয়ে শুকনা আম বানানোর চেষ্টা করেছি। অবশেষে সফল হয়েছি। স্বাদ ও রং অপূর্ব। এটা অনেক বিক্রিও হয়েছে। এক মণ কাঁচা–পাকা আমে চার কেজির মতো শুকনা আম হয়। ইসমাইল খান, প্রতিষ্ঠাতা, নওয়াবি ম্যাঙ্গোআমের প্রক্রিয়াজাত শিল্প কত দূর
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রাজশাহী—এই তিন জেলায় দেশের বেশির ভাগ আম উৎপাদিত হয়; কিন্তু এসব আমের প্রক্রিয়াজাত করতে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান হয়নি আজও। বেসরকারিভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ম্যাঙ্গো বার ও জুস তৈরি করে। প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পুরো বাজারটিই এখন উন্মুক্ত আছে বলে মনে করেন কৃষি অধিদপ্তরের চাঁপাইনবাবগঞ্জের হর্টিকালচার বিভাগের উপপরিচালক এ কে এম মনজুরে মাওলা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুই কৃষি উদ্যোক্তা যেভাবে শুকনা আম ও পাউডার তৈরি করেছেন, তা একটি দৃষ্টান্ত। তাঁরা দেখিয়েছেন, এই বাজারের কী বিপুল সম্ভাবনা আছে; কিন্তু তাঁদের সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দরকার। সেগুলো এখনো অপ্রতুল।
এদিকে কৃষি অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে দেশের আমের বিদেশ যাত্রা শুরু হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত ২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি আম রপ্তানি হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘আম প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা আছে। আমরা ইতিমধ্যে দুটি প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনা করেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। প্রক্রিয়াজাত আমের দু-একটি আইটেম নিয়ে গবেষণার কাজ চলছে। সেগুলো সফলতা পেলে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ইনব বগঞ জ র প রক র য় জ ত আম ব ন ন র আম উৎপ দ উদ য ক ত এই ব জ র র ব যবস কর ছ ন আম র ব উদ য গ আম দ য় আম ত র র আম র এ বছর বছর প
এছাড়াও পড়ুন:
আসামে নিষিদ্ধ হলো বহুবিবাহ, আইন ভাঙলে ১০ বছরের জেল
বহুবিবাহ প্রতিরোধে আসামের বিধানসভায় বৃহস্পতিবার পাস হয়েছে ‘আসাম প্রোহিবিশন অফ পলিগ্যামি বিল, ২০২৫’। এই আইনের মাধ্যমে ভারতের এই রাজ্যে বহুবিবাহকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আইন ভাঙলে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও জরিমানার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
তবে তফসিলি জনজাতি (এসটি) এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত এলাকা যেমন বডোল্যান্ড টেরিটোরিয়াল রিজিয়ন, ডিমা হসাও, করবি আংলং ও পশ্চিম করবি আংলং এই আইনের আওতার বাইরে থাকবে।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা আইন পাশ হওয়ার পর বলেছেন, দিনটি ঐতিহাসিক। আসামের নারীদের সামাজিক ও পারিবারিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এই আইন চালু করা হল।
বৃহস্পতিবার আসা বিধানসভায় শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনেই বিলটি তোলা হয়। বিলটি পাশ হওয়ার আগে তুমুল বিতর্ক হয়। একাধিক মুসলিম বিধায়ক দাবি করেন, এর ফলে সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য, এই আইনে অনেক জটিলতা তৈরি হবে। কারণ মুসলিম পার্সোনাল ল রাজ্য আইনের ঊর্ধ্বে। রাজ্যের আইনে যা নিষিদ্ধ সেটাই কেন্দ্রীয় আইনে বৈধ। মামলা হলে আদালত রাজ্যের আইনকে গ্রাহ্য করবে না।
জবাবে আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি সরকারের মন্ত্রী ও বিধায়কেরা বিধানসভায় ঘোষণা করেন, যদি মুসলিম পার্সোনাল ল আসামের আইন বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বলবৎ করা হবে। তখন আর ব্যক্তিগত আইনের সুবিধা পাওয়া যাবে না।
মুখ্যমন্ত্রী চ্যালেঞ্জের সুরে বলেন, “বিরোধীরা আমাকে আটকাতে না পারলে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও বলবৎ হবে আসামে।”
প্রসঙ্গত বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে গত বছর অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ,গোয়া মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং আসামে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার ভাবনা আছে সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলোর।
এই বিলের আওতায় যারা অপরাধী বলে চিহ্নিত হবেন, তাদের জন্য কড়া শাস্তির বিধান বেঁধে দিয়েছে হিমন্তের সরকার। পাশ হওয়া বিল অনুযায়ী, কেউ যদি একটি বিবাহ থাকা সত্ত্বেও আরো একটি বিয়ে করেন, তা হলে তার সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আর কেউ যদি তার দ্বিতীয় বিয়ে লুকানোর চেষ্টা করেন, তাহলে সেই অভিযুক্তের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। পাশাপাশি, এই গোটা বিবাহ প্রক্রিয়ায় জড়িত কাজি, পুরোহিত, গ্রামপ্রধান, পিতামাতা কিংবা আইনি পরামর্শদাতা, যারা সেই বহুবিবাহে উৎসাহ জোগাবেন, তাদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
এদিন বিল পাশের পর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, “বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহ মুসলিম সমাজের মেয়েদের জন্য অভিশাপের সমান। দেশের নাগরিক হিসাবে তারাও মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার পেয়েছেন। কিন্তু এই রীতি তাদের সেই মর্যাদা ও অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।”
সুচরিতা/শাহেদ