কোন ভুলে যুক্তরাষ্ট্রের দাবানল এমন ভয়াবহ হলো
Published: 12th, January 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও এর আশপাশে যে বড় বড় দাবানল জ্বলছে, তা ভয়াবহ। কিন্তু এটা নতুন কিছু নয়। এ এলাকায় আগুনের এমন ভয়ংকর ইতিহাস বহুদিনের। গরম, খরা আর বাতাসের কারণে এই অঞ্চলে আগুন লাগার ঝুঁকি সব সময়ই বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে। এ কারণে আগুন এখন আগের চেয়ে আরও বড় আকারে ছড়াচ্ছে।
এ এলাকা অনেক আগে থেকেই দাবানলপ্রবণ। মানুষ যখন প্রাকৃতিক পরিবেশ, যেমন পাহাড়ি এলাকা, গুল্মভূমি, বন বা উপকূলীয় ঢালের আশপাশে বাড়ি তৈরি করে, তখন আগুনের আশঙ্কা থেকেই যায়। আর এই আগুন দমনের চেষ্টা করলে অনেক সময় জমে থাকা শুকনা গাছপালা আর ঝোপঝাড় পরে আরও বড় আগুনের কারণ হয়।
গত মাসেই ফ্র্যাঙ্কলিন ফায়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় মালিবুতে ৪ হাজার একর পুড়িয়ে দেয়। এর আগে ২০০৯ সালের স্টেশন ফায়ার ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৭৭ একর এলাকায় আগুন ছড়ায়। ২০১৮ সালের উলসি ফায়ার ৯৬ হাজার ৯৪৯ একর পুড়িয়ে ১ হাজার ৬৪৩টি বাড়িঘর ধ্বংস করে। আবার ১৯৭০ সালের মালিবু ফায়ার টানা ছয় মাসের খরার পর ৩১ হাজার একর এলাকা পুড়িয়ে দেয় এবং ১০ জনের প্রাণহানি ঘটায়।
মালিবু এমন এক জায়গা, যেখানে বারবার দাবানলের ঘটনা ঘটে। মাইক ডেভিস তাঁর ১৯৯৮ সালের একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মালিবু উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বেশি আগুনপ্রবণ এলাকা। এখানে প্রতি দুই-আড়াই বছরে বড় ধরনের আগুন লাগে, আর সান্তা মনিকা পর্বতশ্রেণি গত শতাব্দীতে তিনবার পুরোপুরি পুড়েছে। মালিবু বারবার জ্বলবেই, এটাই এর বাস্তবতা।
চলমান দাবানলে আমার পরিচিত অনেকেই তাঁদের বাড়িঘর হারিয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি ফিরে পাবেন কি না, তা জানেন না। এক বন্ধু লিখেছেন, ‘বন্ধুদের বাড়ি পুড়ে গেছে। বাচ্চাদের স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। দোকানপাট শেষ। হাঁটার জায়গাগুলোও নেই। আমরা এখন যেকোনো সময় সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
লস অ্যাঞ্জেলেসে এ সময় আগুন লাগার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত ক্যালিফোর্নিয়ার হাওয়া সমুদ্র থেকে আসে। তবে শরতে মরুভূমি থেকে তপ্ত বাতাস আসে, যাকে ‘সান্তা আনা বাতাস’ বলা হয়। এই বাতাস খুবই শক্তিশালী হয়।
১৯৯১ সালে এমন বাতাসের কারণে ওকল্যান্ডে আগুন লেগে দুই দিনে ৩ হাজার বাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালে সান্তা আনা বাতাসের গতি ঘণ্টায় রেকর্ড ১৬৭ মাইল ছুঁয়েছিল। এবারের বাতাসের এত বেগ ছিল না, কিন্তু তা–ও ঘণ্টায় ১০০ মাইল পর্যন্ত গিয়েছিল। এ বাতাস আগুনকে আরও তীব্র করে তোলে।
ভয়াবহ আগুন যেমন সবকিছু ধ্বংস করে, আগুন থেকে বাঁচতে যা করণীয়, তা ভুলে যাওয়াও তা–ই করে। স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। ভুলে গেলে বিপদ আবার ফিরে আসতে পারে, আর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলভাবে দাবি করেছেন, জো বাইডেন আর গ্যাভিন নিউসম আগুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আমরা যদি অতীতের ঘটনা ঠিকমতো মনে রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারব।ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়াবহ শরৎকালীন আগুন ২০১৭ সাল থেকে নতুন এক যুগের আগমনের ইঙ্গিত দেয়। এটি আগের মতো নয়, বরং আরও বিধ্বংসী। যেমন কয়েক মাস আগে হারিকেন হেলেন পশ্চিম নর্থ ক্যারোলাইনার ভেতরে কয়েক শ মাইল ভেতর পর্যন্ত আঘাত হেনেছিল। বিজ্ঞানীরা, আগুনবিশেষজ্ঞ ও জলবায়ু সাংবাদিকেরা আগেই সতর্ক করেছিলেন। এ এলাকা আগে থেকেই আগুনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তার ওপর প্রাকৃতিকভাবে আগুন লাগার চক্র বন্ধ করায় আগুন এখন পুনরায় ধ্বংস ডেকে আনে।
এ কথা বলার মানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দোষ দেওয়া নয়। যাঁরা তাঁদের বাড়ি হারিয়েছেন বা বাড়িঘর সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের কোনো দোষ নেই। আসল দোষ সেসব প্রতিষ্ঠানের, যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করতে দিয়েছে এবং আগুন মোকাবিলার পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করেনি।
লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি কাউন্সিলের এক সদস্য বলেছেন, পানি সরবরাহব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ যথেষ্ট হয়নি। এমনকি অগ্নিনির্বাপণের গাড়িগুলোও সঠিক মেরামতির অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ১৭ ডিসেম্বর শহরের ফায়ার চিফ অভিযোগ করেন, কর্মিসংকট ও বাজেট কাটছাঁটের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং সেগুলো মোকাবিলা করতে তাদের সক্ষমতা কমে গেছে।
আগে যেখানে মানুষ বাড়ি বানিয়েছে, সেখানে আগুন দমন করা হয়েছে। বন্য এলাকায় বন বিভাগ বা অন্যান্য সংস্থা বিংশ শতাব্দীতে আগুন দমন করেছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল, স্থানীয় আদিবাসীরা এবং প্রকৃতি নিজেই নিয়মিত এই জায়গাগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিত। সেই আগুন দমন করার ফলে জ্বালানি পদার্থ জমা হয়, যা একসময় বড় ধরনের ধ্বংস ডেকে আনে। তারা ভুলে গিয়েছিল, প্রকৃতির জন্য আগুন স্বাভাবিক।
ভয়াবহ আগুন যেমন সবকিছু ধ্বংস করে, আগুন থেকে বাঁচতে যা করণীয়, তা ভুলে যাওয়াও তা–ই করে। স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
ভুলে গেলে বিপদ আবার ফিরে আসতে পারে, আর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলভাবে দাবি করেছেন, জো বাইডেন আর গ্যাভিন নিউসম আগুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আমরা যদি অতীতের ঘটনা ঠিকমতো মনে রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারব।
বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই বলেছিলেন, পৃথিবী আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাঁরা শুধু সতর্ক করেননি, বরং বলেছিলেন কীভাবে এই বিপদ কমানো যায়। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা তাদের কথা শুনব কি না।
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ভবিষ্যৎ বদলে দিচ্ছে। আমরা জানি কী করতে হবে এই বিপদ কমানোর জন্য। কিন্তু শুধু নিজের মতো প্রস্তুতি নিলেই হবে না। সবাইকে মিলে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। এই আগুন আমাদের শেখায়, ভুলে যাওয়ার ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে।
রেবেকা সলনিট গার্ডিয়ান ইউএসের একজন কলামলেখক।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় ওই চারজনের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবের শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বহিষ্কৃত সদস্যরা হলেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ কবির হোসেন, রফিকুল ইসলাম রফিক ও তরফদার আবদুল মুকিত। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ গফুর বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ সমিতির নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে নন। বৃহস্পতিবার ওই চার সদস্যকে বহিষ্কারের বিষয়টি নোটিশ দিয়ে জানানো হবে।’
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ কবির হোসেনের (জনি) কাছে ৩৫ লাখ টাকায় শহরের বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকায় জমি বিক্রি করেন ইমরান হাসান। জমি রেজিস্ট্রির আগে সব টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও সৈয়দ কবির হোসেন ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বাকি ২৫ লাখ টাকা না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকেন। পরে তিনি আরও ১৭ লাখ টাকা দেন। বাকি ৮ লাখ টাকা চাইলে হুমকি দিতে থাকেন কবির হোসেন। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ইমরান হাসান আইনজীবী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে কবির হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কবির হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
এ বিষয়ে আইনজীবী কবির হোসেন বলেন, ‘বহিষ্কারের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে যে বিষয়ে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে অভিযুক্ত আমি নই। তারপরও আইনজীবী সমিতি আমার অভিভাবক; তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
অন্যদিকে অভয়নগরের নওয়াপাড়ার জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশন পাওনা টাকা আদায়ে আবদুর রাজ্জাককে মামলার আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আটটি চেকের মামলা পরিচালনা করেন। এসব মামলার রায় ও আপিল বাদীর অনুকূলে যাওয়ার পর আটটি চেকের ৪১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নেন আবদুর রাজ্জাক। এ টাকা জয়েন্ট ট্রেডিং কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে তিনি ঘোরাতে থাকেন। চলতি বছরের ৪ জুন তিনি ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন। চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় নগদায়ন করা যায়নি। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওহাব গত ২৮ জুলাই আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে যশোর আইনজীবী সমিতি বরাবর অভিযোগ করেন।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় যশোর আইনজীবী সমিতি। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আবদুর রাজ্জাককে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম রফিক তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ ও মামলা করতে টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে মামলা না করায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আইনজীবী তরফদার আবদুল মুকিতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।