যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও এর আশপাশে যে বড় বড় দাবানল জ্বলছে, তা ভয়াবহ। কিন্তু এটা নতুন কিছু নয়। এ এলাকায় আগুনের এমন ভয়ংকর ইতিহাস বহুদিনের। গরম, খরা আর বাতাসের কারণে এই অঞ্চলে আগুন লাগার ঝুঁকি সব সময়ই বেশি।  জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে। এ কারণে আগুন এখন আগের চেয়ে আরও বড় আকারে ছড়াচ্ছে।

এ এলাকা অনেক আগে থেকেই দাবানলপ্রবণ। মানুষ যখন প্রাকৃতিক পরিবেশ, যেমন পাহাড়ি এলাকা, গুল্মভূমি, বন বা উপকূলীয় ঢালের আশপাশে বাড়ি তৈরি করে, তখন আগুনের আশঙ্কা থেকেই যায়। আর এই আগুন দমনের চেষ্টা করলে অনেক সময় জমে থাকা শুকনা গাছপালা আর ঝোপঝাড় পরে আরও বড় আগুনের কারণ হয়।

গত মাসেই ফ্র্যাঙ্কলিন ফায়ার মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় মালিবুতে ৪ হাজার একর পুড়িয়ে দেয়। এর আগে ২০০৯ সালের স্টেশন ফায়ার ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৭৭ একর এলাকায় আগুন ছড়ায়। ২০১৮ সালের উলসি ফায়ার ৯৬ হাজার ৯৪৯ একর পুড়িয়ে ১ হাজার ৬৪৩টি বাড়িঘর ধ্বংস করে। আবার ১৯৭০ সালের মালিবু ফায়ার টানা ছয় মাসের খরার পর ৩১ হাজার একর এলাকা পুড়িয়ে দেয় এবং ১০ জনের প্রাণহানি ঘটায়।

মালিবু এমন এক জায়গা, যেখানে বারবার দাবানলের ঘটনা ঘটে। মাইক ডেভিস তাঁর ১৯৯৮ সালের একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, মালিবু উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে বেশি আগুনপ্রবণ এলাকা। এখানে প্রতি দুই-আড়াই বছরে বড় ধরনের আগুন লাগে, আর সান্তা মনিকা পর্বতশ্রেণি গত শতাব্দীতে তিনবার পুরোপুরি পুড়েছে। মালিবু বারবার জ্বলবেই, এটাই এর বাস্তবতা।

চলমান দাবানলে আমার পরিচিত অনেকেই তাঁদের বাড়িঘর হারিয়েছেন। কেউ কেউ বাড়ি ফিরে পাবেন কি না, তা জানেন না। এক বন্ধু লিখেছেন, ‘বন্ধুদের বাড়ি পুড়ে গেছে। বাচ্চাদের স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে। দোকানপাট শেষ। হাঁটার জায়গাগুলোও নেই। আমরা এখন যেকোনো সময় সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।’

লস অ্যাঞ্জেলেসে এ সময় আগুন লাগার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণত ক্যালিফোর্নিয়ার হাওয়া সমুদ্র থেকে আসে। তবে শরতে মরুভূমি থেকে তপ্ত বাতাস আসে, যাকে ‘সান্তা আনা বাতাস’ বলা হয়। এই বাতাস খুবই শক্তিশালী হয়।

১৯৯১ সালে এমন বাতাসের কারণে ওকল্যান্ডে আগুন লেগে দুই দিনে ৩ হাজার বাড়ি পুড়ে গিয়েছিল। ২০১১ সালে সান্তা আনা বাতাসের গতি ঘণ্টায় রেকর্ড ১৬৭ মাইল ছুঁয়েছিল। এবারের বাতাসের এত বেগ ছিল না, কিন্তু তা–ও ঘণ্টায় ১০০ মাইল পর্যন্ত গিয়েছিল। এ বাতাস আগুনকে আরও তীব্র করে তোলে।

ভয়াবহ আগুন যেমন সবকিছু ধ্বংস করে, আগুন থেকে বাঁচতে যা করণীয়, তা ভুলে যাওয়াও তা–ই করে। স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। ভুলে গেলে বিপদ আবার ফিরে আসতে পারে, আর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলভাবে দাবি করেছেন, জো বাইডেন আর গ্যাভিন নিউসম আগুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আমরা যদি অতীতের ঘটনা ঠিকমতো মনে রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারব।

ক্যালিফোর্নিয়ার ভয়াবহ শরৎকালীন আগুন ২০১৭ সাল থেকে নতুন এক যুগের আগমনের ইঙ্গিত দেয়। এটি আগের মতো নয়, বরং আরও বিধ্বংসী। যেমন কয়েক মাস আগে হারিকেন হেলেন পশ্চিম নর্থ ক্যারোলাইনার ভেতরে কয়েক শ মাইল ভেতর পর্যন্ত আঘাত হেনেছিল। বিজ্ঞানীরা, আগুনবিশেষজ্ঞ ও জলবায়ু সাংবাদিকেরা আগেই সতর্ক করেছিলেন। এ এলাকা আগে থেকেই আগুনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তার ওপর প্রাকৃতিকভাবে আগুন লাগার চক্র বন্ধ করায় আগুন এখন পুনরায় ধ্বংস ডেকে আনে।

এ কথা বলার মানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দোষ দেওয়া নয়। যাঁরা তাঁদের বাড়ি হারিয়েছেন বা বাড়িঘর সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের কোনো দোষ নেই। আসল দোষ সেসব প্রতিষ্ঠানের, যারা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বাড়িঘর নির্মাণ করতে দিয়েছে এবং আগুন মোকাবিলার পর্যাপ্ত অবকাঠামো তৈরি করেনি।

লস অ্যাঞ্জেলেস সিটি কাউন্সিলের এক সদস্য বলেছেন, পানি সরবরাহব্যবস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ যথেষ্ট হয়নি। এমনকি অগ্নিনির্বাপণের গাড়িগুলোও সঠিক মেরামতির অভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ১৭ ডিসেম্বর শহরের ফায়ার চিফ অভিযোগ করেন, কর্মিসংকট ও বাজেট কাটছাঁটের কারণে বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং সেগুলো মোকাবিলা করতে তাদের সক্ষমতা কমে গেছে।

আগে যেখানে মানুষ বাড়ি বানিয়েছে, সেখানে আগুন দমন করা হয়েছে। বন্য এলাকায় বন বিভাগ বা অন্যান্য সংস্থা বিংশ শতাব্দীতে আগুন দমন করেছিল। তারা ভুলে গিয়েছিল, স্থানীয় আদিবাসীরা এবং প্রকৃতি নিজেই নিয়মিত এই জায়গাগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিত। সেই আগুন দমন করার ফলে জ্বালানি পদার্থ জমা হয়, যা একসময় বড় ধরনের ধ্বংস ডেকে আনে। তারা ভুলে গিয়েছিল, প্রকৃতির জন্য আগুন স্বাভাবিক।

ভয়াবহ আগুন যেমন সবকিছু ধ্বংস করে, আগুন থেকে বাঁচতে যা করণীয়, তা ভুলে যাওয়াও তা–ই করে। স্মৃতি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।

ভুলে গেলে বিপদ আবার ফিরে আসতে পারে, আর মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়তে পারে। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুলভাবে দাবি করেছেন, জো বাইডেন আর গ্যাভিন নিউসম আগুনের জন্য দায়ী। কিন্তু আমরা যদি অতীতের ঘটনা ঠিকমতো মনে রাখি, তাহলে ভবিষ্যতের জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারব।

বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই বলেছিলেন, পৃথিবী আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তাঁরা শুধু সতর্ক করেননি, বরং বলেছিলেন কীভাবে এই বিপদ কমানো যায়। এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা তাদের কথা শুনব কি না।

জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ভবিষ্যৎ বদলে দিচ্ছে। আমরা জানি কী করতে হবে এই বিপদ কমানোর জন্য। কিন্তু শুধু নিজের মতো প্রস্তুতি নিলেই হবে না। সবাইকে মিলে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। এই আগুন আমাদের শেখায়, ভুলে যাওয়ার ফল কতটা ভয়ংকর হতে পারে।

রেবেকা সলনিট গার্ডিয়ান ইউএসের একজন কলামলেখক।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ছেলে প্রবাসে যাবে, কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শিল্পী বেগম (৪০) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। রবিবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় উপজেলার মনিয়ন্ধ ইউনিয়নের উত্তর পাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহত শিল্পী বেগম ওই গ্রামে বাসিন্দা ইরাক প্রবাসী জলফু মিয়ার স্ত্রী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শিল্পী বেগমের ছেলে ওয়াসিম প্রবাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এজন্য তার মা বাড়িতে বৈদ্যুতিক ইস্ত্রি দিয়ে ছেলের কাপড় ইস্ত্রি করছিলেন। এসময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে তিনি গুরুতর আহত হন। পরিবারের সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আরো পড়ুন:

কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত মসজিদ কমিটির সভাপতির মৃত্যু 

পরকীয়ার জেরে স্বামী-স্ত্রীর বিষপান, মারা গেলেন স্বামী

আখাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ছমিউদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

ঢাকা/মনিরুজ্জামান/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ