হাতছাড়া হচ্ছে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বাজার
Published: 16th, January 2025 GMT
দুই বছর আগে হঠাৎ সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন ফোরাম থেকে ফের রপ্তানির সুপারিশ এলেও তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। এতে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিতে পড়েছে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। হাতছাড়া হচ্ছে রপ্তানি বাজার। বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ।
জানা গেছে, রপ্তানি নীতিতে সব ধরনের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকায় রয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে স্থানীয় উৎপাদন ও চাহিদা পর্যালোচনার ভিত্তিতে বরাবরই সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়ে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের জুলাইয়ে ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় স্থানীয় চালের মজুত বিবেচনায় সুগন্ধিসহ সব ধরনের চাল রপ্তানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। ওই বছরের ২৯ জুন সুগন্ধি চাল রপ্তানি সাময়িক স্থগিত করা হয়। রপ্তানিকারকদের অনুরোধে ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই আবার সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে আগে অনুমোদন পাওয়া ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার ২৪৪ টন সুগন্ধি চাল ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে রপ্তানি করার অনুমতি দেওয়া হয়। তিন মাস না যেতেই আবারও কৃষি মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর দেশের সার্বিক খাদ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বন্ধ করে। চাল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালসহ খাদ্য পণ্যবাহী ট্রাক ও কনটেইনার বন্দর থেকে ফেরত আনতে হয়। এতে বিপুল পরিমাণ বাণিজ্যিক ক্ষতি হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সুগন্ধি চাল রপ্তানি অনুমোদন দেওয়া থাকলে এর আড়ালে সাধারণ চাল রপ্তানি হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। তাই দেশে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মজুত বাড়ানোর লক্ষ্যেই সব ধরনের চাল রপ্তানি বন্ধ করা হয়। বন্ধ করার পর কয়েক দফা তা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এক সময় সুগন্ধি চালের অবদান ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ থাকায় ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছায়। কিন্তু সুগন্ধি চাল রপ্তানিতে বাধা পড়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৮৪৩ মিলিয়নে। কমার ধারাবাহিকতা পরের অর্থবছরেও বজায় থাকে।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে এক সভায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে জানানো হয়, প্রায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার টন সুগন্ধি চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৭ হাজার টন চাল রপ্তানি হয়, যা উৎপাদিত মোট সুগন্ধি চালের ১ শতাংশের কম। সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি প্রদান করা হলে খাদ্য নিরাপত্তায় ঘাটতি হবে না। গত ২০ অক্টোবর ট্যারিফ কমিশনে আরেক বৈঠকে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসে। এর পর তিন মাস পার হলেও রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়নি।
স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো.
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল সমকালকে বলেন, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের সুগন্ধি চালের ভালো বাজার তৈরি হয়। রপ্তানি হলে চাল উৎপাদন করে কৃষকদের আরও বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে এ চাল রপ্তানি বন্ধ থাকায় ভারত এবং পাকিস্তান এ বাজার দখলে নিয়ে নিচ্ছে। সার্বিক বিবেচনায় সুগন্ধি চাল রপ্তানির স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা উচিত।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সবজির দামে স্বস্তি, মজুরি বৃদ্ধির হার এখনো কম
দেশে অবশেষে মূল্যস্ফীতির হার কমতে শুরু করেছে। এটি নিয়ে এত দিন মানুষের মধ্যে যে হাঁসফাঁস ভাব ছিল, সেই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলছে। বিশেষ করে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবজির দাম কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে স্বস্তি এসেছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমে আসায় মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। কেননা দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের দৈনন্দিন ব্যয়ের বড় অংশ যায় খাদ্য কেনায়। কিন্তু সংকটের জায়গা হলো, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের মজুরি বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির হার কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির ব্যবধান কমে এসেছে, তাতেও মানুষের জীবনে স্বস্তি এসেছে।
গত জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়েছে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, গত জুন মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ। জুনসহ টানা চার মাস দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ইনফ্লেশন ডায়নামিকস ইন বাংলাদেশ: এপ্রিল-জুন ২০২৫’ (বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির গতি-প্রকৃতি: এপ্রিল-জুন ২০২৫) শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ তথা শেষ প্রান্তিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যপণ্যের গড় অবদান কিছুটা কমেছে। খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের অবদান বেড়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য ও জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের গড় ভূমিকা ছিল ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ; যা আগের প্রান্তিকে ছিল ৪৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় ভূমিকা কমেছে। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা এর আগের প্রান্তিকে ছিল ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে তৃতীয় ও চতুর্থ উভয় প্রান্তিকেই সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানি পণ্যের গড় ভূমিকা ছিল ৯ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে সবজির দাম কমায় তা খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই প্রান্তিকে সামগ্রিক খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবজির ভূমিকা ছিল মাত্র ৪ দশমিক ১ শতাংশ, যদিও আগের (তৃতীয়) প্রান্তিকে সবজির ভূমিকা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে শস্যজাতীয় খাদ্য। চতুর্থ প্রান্তিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে শস্যজাতীয় খাদ্যের ভূমিকা ছিল ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ, যা গত কয়েক প্রান্তিকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমিষজাতীয় খাদ্যের ভূমিকা ছিল ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ। বাস্তবতা হলো, আমিষের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য হলেও চতুর্থ প্রান্তিকে আমিষের দাম কমে যাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে আমিষের ভূমিকা কমেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
খাদ্যপণ্যের মধ্যে সোনালি মুরগি, মাঝারি মানের চাল, সয়াবিন তেল ও মসুর ডালের দাম চতুর্থ প্রান্তিকের মাঝামাঝি সময়ে কমলেও শেষ দিকে আবার বেড়ে যায়। বিশেষ করে জুন মাসে সোনালি মুরগির দাম অনেকটা বেড়ে যায়। যদিও এপ্রিল ও মে মাসে সোনালি মুরগির দাম রেকর্ড পরিমাণে কমে যায়। এ ছাড়া আলু, কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজের দাম এই প্রান্তিকে অনেকটা স্থিতিশীল ছিল।
খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে কাপড় ও জুতার দাম। অর্থাৎ এই সময় এ দুটি পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে এই দুটি পণ্যের ভূমিকা ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। জ্বালানির ভূমিকা ছিল ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এ ছাড়া স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও অন্যান্য পণ্যের ভূমিকা ছিল স্থিতিশীল।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌসুমি কারণ ও সরবরাহ ঠিক থাকার কারণে বাজারে সবজির দাম কমেছে। আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, সরবরাহ ঠিক থাকলে বাজারে কারসাজির সুযোগ কম থাকে। সেটা হয়তো কিছুটা হয়েছে। তবে বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। বন্যার সম্ভাবনা থেকেই যায়। ফলে এসব খেয়াল রেখে এবং কবে কখন কী সংকট হতে পারে, তা নিরূপণ করে নীতি নির্ধারণ করতে হবে।’
সামগ্রিকভাবে সেলিম রায়হান মনে করেন, কিছুটা স্বস্তি হয়তো এসেছে; কিন্তু এখনো সন্তুষ্ট হওয়ার অবকাশ নেই। এই ধারা টেকসই করতে নীতিগত সমন্বয় থাকতে হবে।
উদ্বেগের জায়গা মজুরিউদ্বেগের বিষয় হলো, তিন বছরের বেশি সময় ধরে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এই সময়ে ধারাবাহিকভাবে মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম ছিল। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে মজুরি বৃদ্ধির হারকে ছাড়িয়ে গেছে। ফলে ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রকৃত আয় কমেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে যখন মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করে, তখন থেকে এই ব্যবধান কমতে থাকে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিক এপ্রিল-জুনে মজুরি ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, বিশেষ করে জুন মাসে। এই ঘাটতি কমে আসার পেছনে মূল কারণ ছিল বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার কমে আসা। চতুর্থ প্রান্তিকে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল তুলনামূলক স্থিতিশীল—গড়ে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
ফলে পারিবারিক ক্রয়ক্ষমতা এখন কিছুটা বাড়ছে। মোমেন্টাম ইফেক্ট (ধরা যাক, মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি হঠাৎ বেড়ে যায়। সেই বাড়তি মূল্যস্ফীতির ধারা যদি এপ্রিলেও কিছুটা প্রভাব ফেলে, তবে তাকে মোমেন্টাম ইফেক্ট বলা হয়) বা গতিপ্রবাহের প্রভাবের কারণে মাঝেমধ্যে ওঠানামা দেখা গেলেও মজুরি বৃদ্ধির গতি পুরো প্রান্তিকজুড়েই তুলনামূলকভাবে মন্থর ছিল। এর অন্যতম কারণ হলো এত দিন মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে উচ্চ ব্যবধান ছিল। অর্থাৎ আগে এই ব্যবধান বেশি থাকায় পরবর্তীকালে কমলেও তার প্রভাব তেমন একটা দেখা যায় না। পুরো প্রান্তিকে এর প্রভাব ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে মজুরি বৃদ্ধিতে সামগ্রিকভাবে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা গেছে, যদিও প্রান্তিকের শেষ দিকে এসে তা সামান্য কমেছে। দেশের সব বিভাগেই আগের প্রান্তিকের তুলনায় সামান্য হারে মজুরি বেড়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে মজুরি বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মজুরি বৃদ্ধির গতি এখনো কম এবং তার ইতিবাচক প্রভাব তুলনামূলকভাবে সীমিত। এই প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখতে ধারাবাহিক নীতিগত তৎপরতা অপরিহার্য।