সরকারি চাকুরেরা আপাতত পাচ্ছেন না মহার্ঘ ভাতা
Published: 24th, January 2025 GMT
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আপাতত পাচ্ছেন না মহার্ঘ ভাতা। জানুয়ারি থেকেই এ ভাতা কার্যকরের যে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, অর্থনীতির বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতিতে সেখান থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। মহার্ঘ ভাতা বাস্তবায়ন হলে রাশ টানা যেত না মূল্যস্ফীতির, সমাজে দেখা দিত বৈষম্য– এমন শঙ্কায় সব মহল থেকে সরকারের এ উদ্যোগ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ পটভূমিতে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে মহার্ঘ ভাতা থেকে কিছুটা পিছিয়েছে সরকার। তবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিষয়টি বিবেচনা করা হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ঠিক রেখে মহার্ঘ ভাতার অর্থ সংস্থান করা সরকারের জন্য বেশ কঠিন। তবু অন্য খাত থেকে টাকা কাটছাঁট করে ভাতা দেওয়ার খসড়া চূড়ান্ত করেছিল অর্থ বিভাগ। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় বিষয়টিতে সায় না দিয়ে মহার্ঘ ভাতার নথি ফেরত পাঠিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আপাতত এ ভাতা দেওয়া সমীচীন হবে না। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি ফের বিবেচনা করা যেতে পারে।
সূত্র জানায়, সাড়ে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীকে মূল বেতনের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার খসড়া প্রস্তুত করেছিল অর্থ বিভাগ। তবে ইতোমধ্যে পাওয়া সরকারি চাকরিজীবীর বাড়তি ৫ শতাংশ বার্ষিক বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) বাদ দেওয়ার সুপারিশও করা হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে এটি বাস্তবায়নে এক অর্থবছরে বাড়তি খরচ হবে অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের খসড়া প্রস্তাবে ব্যয় কিছুটা কমাতে ১১তম থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও প্রথম থেকে দশম গ্রেডের কর্মচারীদের ১০ বা ১৫ শতাংশ হারে ভাতার বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম থেকে দশম গ্রেডে ১০ শতাংশ দেওয়া হলে পাঁচ হাজার কোটির কিছু বেশি টাকার প্রয়োজন ছিল। আর ১৫ শতাংশ দেওয়া হলে ব্যয় আরেকটু বেড়ে দাঁড়াত– প্রায় ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। অর্থ বিভাগ এ পরিমাণ টাকার সংস্থান করে সংশোধিত বাজেটে তা অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে।
তবে সরকার এ উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়। বিশ্লেষকরা বলছিলেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এর মধ্যে গত জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণ ব্যাপক কমেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আদায় হয়েছে।
তাই সরকারি আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যেই জনগণের পকেট থেকে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব তুলতে অর্থবছরের মাঝপথে শত পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। পরে অবশ্য জনরোষের শঙ্কা ও সমালোচনার মুখে কয়েকটি পণ্য ও সেবায় শুল্ক-কর পুনর্বিবেচনা করা হয়। মহার্ঘ ভাতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তীব্র সমালোচনা হয়। অনেকেই বলতে থাকেন, সরকারি চাকুরের মহার্ঘ ভাতার টাকা জোগাতেই শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এমন আলোচনা-সমালোচনার মুখে মহার্ঘ ভাতা থেকে আপাতত পিছু হটল সরকার।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করার কথা বলা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এখনই মহার্ঘ ভাতা দেওয়াটা যৌক্তিক সময় নয়।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড.
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এমন তো নয় যে সরকারি কর্মচারীরা খুব কম বেতনে চাকরি করছেন। ২০১৫ সালের পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীর বেতন বেসরকারি খাতের চেয়ে বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে। উপসচিব হলেই বিনা সুদে গাড়ির ঋণ এবং সেই গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে বাড়তি ৫০ হাজার করে টাকাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তার পরও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া থেকে সরে আসাটাই যৌক্তিক।
এই অর্থবছরের বাজেটের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ রয়েছে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈষম্যের শিকার হওয়া প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েক দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া প্রশাসনের পদবঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৫ কোটি টাকাও দেওয়া হয়। এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা যুক্ত হলে চলতি বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় বেশ খানিকটা বেড়ে যেত।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র আরও বলছে, মহার্ঘ ভাতার বাড়তি অর্থায়নের হিসাব করা হয়েছে চলতি বাজেটের বরাদ্দের ভিত্তিতে। তবে প্রতিবছর বাজেটে বেতন-ভাতা খাতে বরাদ্দ ৬ থেকে ৮ শতাংশ বাড়ে। সে হিসাবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ দাঁড়াতে পারে প্রায় সাড়ে ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে মহার্ঘ ভাতা বাবদ যোগ হতো আরও প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় হতো প্রায় সাড়ে ৯৬ হাজার কোটি টাকা।
সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর একটি নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করার কথা। সর্বশেষ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে অষ্টম বেতন কাঠামো কার্যকর হয়। সে সময় নতুন কাঠামোর সুপারিশ না করলেও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার প্রস্তাব ছিল বেতন কমিশনের। তবে ২০২৩ সালের জুলাইয়ের আগপর্যন্ত প্রতিবছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পেয়ে আসছিলেন। পরে বাড়তি মূল্যস্ফীতির কথা বলে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণাসহ বেশ কিছু দাবি জানিয়ে আসছিলেন সরকারি চাকরিজীবীরা। এ পরিস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে তা কার্যকর না হলেও বিশেষ সুবিধা হিসেবে বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি মূল বেতনের আরও ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হয়। ফলে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন।
এদিকে, মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আবারও মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত ১১ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর আওতাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা সংস্থানের বিষয় পর্যালোচনার জন্য কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ কর সরক র চ কর ইনক র ম ন ট পর স থ ত ত চ কর জ ব র সরক র র ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের পদাবনতি, দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে দুই শিক্ষকের পদাবনতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আলী রেজওয়ানকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে সহকারী অধ্যাপক এবং ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনকে সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পদে পদাবনতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের এমবিএ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী তাকভির আল মাহমুদ ও সাইদ উদ্দিন আহমেদকে মাদক সেবনের অভিযোগে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ এবং আবাসিক হলে অবস্থানের ওপরও এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হায়দার আলী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, গত সোমবার বেলা ১১টায় সিন্ডিকেট সভা শুরু হয়ে সন্ধ্যার পর শেষ হয়। সভায় অর্ধশতাধিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেসব লিখিত আকারে শিগগিরই প্রকাশ করা হবে।
সিন্ডিকেট সভার একাধিক সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ এবং বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় আলী রেজওয়ানকে।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। পরবর্তী সময় তদন্তের স্বার্থে ১ অক্টোবর তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁদের বিরুদ্ধে পদাবনতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে মাদক সেবনের সময় দুই শিক্ষার্থীসহ এক বহিরাগতকে আটক করে প্রক্টরিয়াল টিম। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুই শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার এবং এক বছরের জন্য ক্যাম্পাসে প্রবেশ ও হলে অবস্থানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হায়দার আলী বলেন, ‘সিন্ডিকেট সভায় সবার মতামতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু এই সিদ্ধান্ত নয়, আরও বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সবার সম্মতিক্রমেই। আমি আসলে একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না, কিছু চাপিয়েও দিতে পারি না। একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সব সিন্ডিকেট সদস্যদের মত থাকে এখানে।’