টিএ খালেকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান
Published: 24th, January 2025 GMT
খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অপসারিত মেয়র নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আবদুল খালেকের অনিয়ম ও দুর্নীতি উদঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) থেকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে। তালুকদার খালেক, তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার ও সহযোগীদের তথ্য চেয়ে কেসিসি, আয়কর বিভাগসহ বিভিন্ন সংস্থায় চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় খুলনার উপ-পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ জানিয়েছেন, গত ২৪ ডিসেম্বর তালুকদার আবদুল খালেকের দুর্নীতি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গত ২১ জানুয়ারি দুদকের খুলনার উপ-পরিচালক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুদক। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করেছে দুদক।
তিনি বলেন, “প্রধান কার্যালয় থেকে বৃহস্পতিবার চিঠি পেয়েছি এবং বৃহস্পতিবারই অনুসন্ধান শুরু করেছি। সাবেক মেয়রের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য তার সহযোগীদের তথ্যও প্রয়োজন। এজন্য তার ব্যবসায়ীক অংশীদার হিসেবে পরিচিত ঠিকাদারদের তথ্য চেয়ে কেসিসিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া মেয়র হয়ে রামপাল-মোংলার জন্য কেসিসির গাড়ি ব্যবহার, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি খুঁজে বের করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”
আবদুল ওয়াদুদ জানান, বৃহস্পতিবার তালুকদার খালেক ও তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারের আয়কর রিটার্ন, কর নির্ধারণী আদেশসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রে ছাপালিপি চেয়ে খুলনা কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার সার্কেল-০৩ এর কাছে চিঠি দেন অনুসন্ধান টিমের প্রধান আবদুল ওয়াদুদ। পাশাপাশি কেসিসির প্রশাসকের কাছে চিঠি দিয়ে মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, তাজুল এন্টারপ্রাইজ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদারি কাজের যাবতীয় তথ্য, এইচ এম সেলিমের প্রতিটি কাজ ও পরিশোধিত বিলের পরিমাণ, খালিশপুর ১৮ নম্বর রোড উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজের দরপত্র সংক্রান্ত সব রেকর্ড এবং মেয়র হিসেবে দায়িত্বকালীন সময়ে গাড়ির লগ বই চাওয়া হয়েছে।
দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা রকিবুল ইসলাম বলেন, “নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে।”
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্টের পর থেকে তালুকদার আবদুল খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ এক ডজন মামলা হয়েছে নগরী ও জেলার বিভিন্ন থানায়।
ঢাকা/নুরুজ্জামান/এস
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংস্কার যেভাবে হলে ভালো হয়
অন্তর্বর্তী সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড’ (এনবিআর) এবং ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’ (আইআরডি)-এর বিলুপ্তি ঘোষণা করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি নতুন বিভাগ– ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ এবং ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ গঠনের প্রস্তাব করেছে। তবে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিপুল প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে সরকার গত ২২ মে পুরো সংস্কার প্রস্তাবটি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। সরকার অংশীজনের সঙ্গে আরও আলোচনা করে তা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে।
দেশের মোট রাজস্বের ৯১ ভাগই কর-রাজস্ব, যার প্রায় পুরোটাই আদায় করে এনবিআর। সে কারণে এনবিআরের সংস্কার এত গুরুত্বপূর্ণ।
পৃথিবীর বহু দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্বনীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৃথক সংস্থার হাতে আছে; উভয়ের মধ্যে একটি বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ থাকে। রাজস্বসংক্রান্ত আইন যেমন– শুল্ক আইন, আয়কর আইন তেমনি অর্থ আইন সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান যেমন– আয়কর ও শুল্কবিধি, সময়ে সময়ে জারিকৃত স্ট্যাটিউটরি রেগুলেশনস অর্ডার (এসআরও) এবং বিভিন্ন ধরনের করের হার নির্ধারণ রাজস্বনীতির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, এসব কর আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায় করা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার অংশ। প্রায় সব দেশেই রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্বটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে এবং এই নীতি বাস্তবায়ন বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি পালন করে সেই মন্ত্রণালয়েরই অধীন কোনো কার্যনির্বাহী বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা (স্ট্যাটিউটরি বডি)। এটি লোক প্রশাসনের মৌলিক নীতি-ব্যবস্থাপনা বিভাজনের স্বীকৃত পন্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা সব সেক্টরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে কর বা রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব (অন্তত তাত্ত্বিকভাবে) পালন করে আসছিল অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ ‘অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ’, যদিও বাস্তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারাই খসড়া আইন, বিধিবিধান, এসআরও এবং কর প্রস্তাব তৈরি করে তা আইআরডিতে প্রেরণ করে থাকে। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ রাজস্বনীতির প্রয়োগ এবং রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডই পালন করে আসছে। রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনো বিভাজন বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ নেই– সেটি বলা যায় না।
এদিক থেকে করনীতি ও কর ব্যবস্থাপনার বিভাজন বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সংস্কার বা অনন্য বিষয় নয়। নতুন প্রস্তাবে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বর্তমানের সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ‘এনবিআর’-এর স্থলে প্রস্তাবিত ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’কে (যা অর্থ মন্ত্রণালয়েরই একটি অংশ) দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত ‘সোনার পাথর বাটি’ বলে মনে হয়। কারণ মন্ত্রণালয়ের তো নীতিনির্ধারণের কাজই করার কথা। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকে না। এটি থাকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন এক বা একাধিক কার্যনির্বাহী সংস্থা যেমন– সরকারি বিভাগ/অধিদপ্তর বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার হাতে। প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়ন করা হলে রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার মধ্যে যেমন সমন্বয় কঠিন হয়ে পড়বে (কারণ কেউ কারও অধীন মেনে নেবে না), তেমনি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব আদায় আরও জটিল হয়ে পড়বে। কারণ এতে ব্যবস্থাপনার মধ্যে অতিরিক্ত আরও একটি স্তর বাড়বে, শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান এবং মাঠ পর্যায়ের ইউনিটগুলোর বর্তমান সহজ আন্তঃসংযোগ কঠিন হয়ে পড়বে এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ভাবধারার উদ্ভব ঘটবে। তবে ‘রাজস্বনীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’র সংস্কারগুলো নিম্নরূপ হতে পারে বলে আমি মনে করি:
এক. রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটির স্থলে দুটি বোর্ড গঠন: বর্তমানের একটি রাজস্ব বোর্ডের স্থলে দুটি রাজস্ব বোর্ড বা সংস্থা গঠন করা যায়-(ক) একটি প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) জন্য, (খ) অপরটি পরোক্ষ করের (শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি) জন্য, ভারতে যেমন আছে। অনেকেই মনে করেন, দুটি বোর্ডের মধ্যে আয় বাড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে এবং কর ব্যবস্থাপনা অধিকতর লক্ষ্যভিত্তিক হবে। অন্যদিকে এনবিআরে আগে থেকেই উক্ত দুই দিকেই পর্যাপ্ত এবং সমসংখ্যক সদস্য থাকায় দুটি বোর্ড গঠিত হলে কোনো ব্যয় বাড়বে না। ভারতের মতো এই সংস্থা দুটির প্রধান হবেন যথাক্রমে বিসিএস আয়কর এবং বিসিএস শুল্ক ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতম কর্মকর্তা এবং তাদের সরকারের একজন সচিবের পদমর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। বোর্ডের অন্য সদস্যরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট ক্যাডার হতে নিয়োগ পাবেন।
দুই. এনবিআরে বেসরকারি খাত থেকে
অ-নির্বাহী সদস্য নিয়োগ বা পরামর্শ কমিটি গঠন : এনবিআরের স্থলে যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের জন্য দুটি পৃথক বোর্ড গঠন করা হয়, তবে কর্ম-সম্পাদনে সাফল্য, দক্ষতা, করদাতাদের সেবা প্রদান, কর্ম-কৌশল এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে বোর্ডকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের বোর্ডের অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে তাদের নিয়ে বোর্ডের পরামর্শ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে করনীতি প্রণয়ন এবং কোনো ব্যক্তি-বিশেষ বা প্রতিষ্ঠানের কর নির্ধারণ বিষয়ে অ-নির্বাহী সদস্যদের অথবা পরামর্শ কমিটির সদস্যদের পরামর্শ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা থাকবে না।
সিঙ্গাপুরের ‘ইনল্যান্ড রেভিনিউ অথরিটি অব সিঙ্গাপুর’-এর উপদেষ্টা বোর্ডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি রয়েছেন। ‘সিঙ্গাপুর কাস্টমস’-এর পরামর্শক কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পোর্ট অথরিটি, এয়ারলাইনস, লজিস্টিকস কোম্পানি এবং ফ্রেইট অ্যাসোসিয়েশন প্রতিনিধিরা উপদেষ্টা পরিষদে অ-নির্বাহী সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যে এইচএমআরসি পরিচালনার জন্যও একটি বোর্ড রয়েছে এবং এতে বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকজন পেশাজীবী অ-নির্বাহী পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। বোর্ডের অ-নির্বাহী পরিচালক পদে কর, অ্যাকাউন্ট্যান্সি, তথ্যপ্রযুক্তি, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাজীবী এবং বেসরকারি খাতের নির্বাহীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতের পরিচালকদের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা এবং পেশাদার ব্যাকগ্রাউন্ড বোর্ডের পরামর্শের জন্য একটি বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং তাতে বোর্ডের কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কর্ম-কৌশল নির্ধারণে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায়।
তিন. ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ কীভাবে গঠিত হওয়া উচিত: ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’ মূলত কাস্টমস ও আয়কর এবং অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য ক্যাডার সদস্যদের দ্বারা গঠিত হওয়া উচিত। কারণ, এটি একটি অত্যন্ত বিশেষায়িত কাজ, অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর মতো নয়। সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পক্ষে রাজস্বনীতি কার্যক্রম কার্যকরভাবে পরিচালনা করা সহজ হবে না, কারণ এটির জন্য প্রয়োজন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা। তবে সেই সঙ্গে বাজার থেকে অর্থনীতিবিদ ও অন্য পেশাজীবীদেরও ‘রাজস্বনীতি বিভাগে’ আনতে হবে। এই জনবল নীতির পাশাপাশি, ‘রাজস্বনীতি বিভাগ’কে পরিকল্পনা কমিশনের মতো একটি বিশেষ স্বাধীন সংস্থার আদলে পরিচালিত হতে হবে এবং এর গঠন কাঠামো ফ্ল্যাট বা সমতল হতে হবে, যেখানে একাধিক সদস্য সমান পদমর্যাদা ও অবস্থানে থাকবেন। এটি যেন সচিব, অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব ইত্যাদির মতো আমলাতান্ত্রিক ও পদসোপান-ভিত্তিক (হায়ারার্কিকেল) কাঠামোতে পরিণত না হয়।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
firozlxp@gmail.com