চাউলের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিভিন্ন পদক্ষেপ সত্ত্বেও এই প্রধান খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যথেষ্ট উদ্বেগজনক সংবাদ। গত কয়েক মাসব্যাপী চাউলের বাজার তপ্ত। ভোক্তা অধিকার লইয়া কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং সচেতন মহলের অব্যাহত দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে শুল্ক হ্রাস, আমদানিসহ বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু সকলই গরল ভেল। শুক্রবার সমকাল যদ্রূপ জানাইয়াছে, আমদানির খবরে মাঝে দুই-এক টাকা হ্রাস পাইলেও পুনরায় মূল্য বৃদ্ধি পাইয়াছে সকল প্রকার চাউলের। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে মানভেদে বিভিন্ন প্রকার চাউলের মূল্য কেজিতে ২ হইতে ১০ টাকা অবধি বৃদ্ধি পাইয়াছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার সরেজমিন পরিদর্শনের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, ভোক্তা পর্যায়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয় প্রতি কেজি সরু বা মিনিকেট চাউল মানভেদে ৭৮ হইতে ৮২ টাকা, নাজিরশাইল মানভেদে ৮০ হইতে ৯০ টাকায় বিক্রয় হইতেছে। অথচ মাসখানেক পূর্বেও মিনিকেট ৬৮ হইতে ৮০ এবং নাজিরশাইল ৮০ হইতে ৮৫ টাকা দরে বিক্রয় হইয়াছে। এমনকি সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যবহৃত মাঝারি বা ব্রি-২৮ ও পাইজাম জাতের চাউলের কেজি এখন ৬০ হইতে ৬৬ টাকা। নিম্ন আয়ের মানুষ যেই মোটা বা গুটি স্বর্ণা জাতের চাউলের ভোক্তা, তজ্জন্য ক্রেতাকে কেজিতে গুনিতে হইতেছে ৫৪ হইতে ৫৮ টাকা। অথচ এক মাস পূর্বে মাঝারি মানের চাউলের কেজি ছিল ৫৮ হইতে ৬৪ টাকা এবং মোটা চাউল কেজিপ্রতি ৫২ হইতে ৫৫ টাকায় বিক্রয় হইয়াছিল। অধিকতর শঙ্কার বিষয়, চাউল ব্যবসায়ীদের অভিমত, আগামী দিনগুলিতে মূল্য আরও বৃদ্ধি পাইতে পারে।
বিগত বৎসরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দফায় দফায় সংঘটিত বন্যায় চাউলের দ্বিতীয় প্রধান উৎস আমন ধানের ফলন বেশ ক্ষতিগ্রস্ত, উহা আমরা জানি। ইহার নেতিবাচক প্রভাবে চাউলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু বিষয়টা ‘বাবু অপেক্ষা পারিষদদল তাহার শত গুণ’ বলিতেছে কিনা– উহাও ভাবিতব্য। কতিপয় ব্যবসায়ীর অসহযোগিতা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার উদাসীনতায় গত বৎসর সরকার প্রত্যাশানুযায়ী ধান-চাউল সংগ্রহে ব্যর্থ হইয়াছিল, উহা আমরা জানি। সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুত যথেষ্ট না থাকিবার অর্থ বেসরকারি চাউল ব্যবসায়ীদের কারসাজির সমূহ সুযোগ মিলিয়া যাওয়া– তাহাও কাহারও অজ্ঞাত নহে। যাহা দুঃখজনক, বর্তমান সরকারও পূর্বসূরিদের ন্যায় এই বিষয়ে যথেষ্ট নজরদারি নিশ্চিত করিতে ব্যর্থ হইয়াছে।
বেসরকারি চাউলকল মালিকগণ কতটা ক্ষমতাবান, তাহা সর্বজনবিদিত। ক্ষুদ্র ও মধ্যমানের ব্যবসায়ীদের উপর ক্ষণে ক্ষণে ব্যাঘ্রের ন্যায় ঝাঁপাইয়া পড়া জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাউলকল মালিকদিগের সম্মুখে কতটা বিড়াল বনিয়া যায়, তাহাও আমরা জানি। এমনকি ইহাদের বিরুদ্ধে দেশে মজুতদারি বন্ধে ২০১২ সালে প্রণীত প্রতিযোগিতা আইনও অদ্যাবধি প্রয়োগ হয় নাই। তবে আশার দিক, সরকার আমদানির মাধ্যমে নিজস্ব চাউলের মজুত বৃদ্ধি, তৎসহিত বেসরকারি পর্যায়েও উহা আমদানিতে উৎসাহ প্রদান করিতেছে, যাহা না হইলে হয়তো চাউলের মূল্য আক্ষরিক অর্থেই গগনচুম্বী হইত।
বিশেষজ্ঞদের ন্যায় আমরাও তাই মনে করি, যেই কোনো মূল্যে চাউলের আমদানি চালাইয়া যাইতে হইবে অন্তত আসন্ন মৌসুমে বোরো ধান উঠা অবধি। শুধু উহাই নহে, ইতোমধ্যে অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করিয়া দেওয়া টিসিবির বিশেষ কার্ডধারীদের মধ্যে তো বটেই, ওএমএস তথা ওপেন মার্কেট সেল কর্মসূচির আওতায় ভর্তুকি মূল্যে চাউল বিক্রয় কার্যক্রমও পুনরায় শুরু করিতে হইবে, যাহা সমগ্র দেশেই চলিবে। মনে রাখিতে হইবে, বিভিন্ন কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হইবার ফলে বিশেষত সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের আয়-রোজগার ইতোমধ্যে হ্রাস পাইয়াছে, যাহাদের পক্ষে প্রতিদিনের ক্ষুন্নিবৃত্তিই অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। অন্তত একটু সুলভে চাউল পাইলে সমাজের এই সকল অংশের মানুষ কোনোক্রমে জীবন নির্বাহ করিতে পারিবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব সরক র ব যবস য় আমদ ন হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ
আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।
নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।
আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরিমিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।
এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?
মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবনমহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।
এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।
দানের সংস্কৃতিআজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।
ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।
যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।
আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।
ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।
আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।
আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫