পূর্বের ভোগান্তি প্রতিস্থাপিত না হউক
Published: 27th, January 2025 GMT
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সংবাদ সম্মেলন করিয়া জানাইয়া দিলেন– রাজধানীর সাতটি কলেজ আর তাহাদের অধীনে থাকিতেছে না। বস্তুত দীর্ঘদিন ধরিয়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি হইতে বাহির হইবার অভিপ্রায়ে কলেজগুলির শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করিতেছিল, ঢাবি উপাচার্যের উক্ত ঘোষণা উহারই ফল। তবে সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দাবি উত্থাপন করিয়াছে, উপাচার্য সেই সম্পর্কে কিছু বলেন নাই। তিনি বলিয়াছেন, সাত কলেজের এই মুহূর্তের অগ্রাধিকার স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা, তাহাদের ‘স্বতন্ত্র পরিচয়’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি দেখভাল করিবে। উহার পরও উক্ত বিষয়ে ধোঁয়াশা রহিয়া গেল বলা যায়।
ঢাকার সাতটি কলেজকে ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত ছিল অপরিকল্পিত– উহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। আমরা দেখিয়াছি, কলেজগুলি ইতোপূর্বে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকিয়া সেশনজটসহ যেই সকল সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর সেই সকল সংকট তীব্রতর হইয়াছে। সময়ানুযায়ী পরীক্ষা না হওয়া কিংবা ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা যদ্রূপ রহিয়াছে, তদ্রূপ শিক্ষক সংকট, গবেষণাগার ও অবকাঠামোগত সমস্যাও কম নহে। এই সকল সংকট নিরসনের দাবিতে কয়েক বৎসর ধরিয়াই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করিতেছিল। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর কলেজগুলির শিক্ষার্থীরা তাহাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সোচ্চার দাবি উত্থাপন করিলে অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্যে কমিটিও গঠন করিয়ছিল।
রবিবার অবশ্য সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের দাবি ছিল ভিন্ন। ঐ দিন অপরাহ্ণে কলেজগুলির একটি প্রতিনিধি দল ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবির অগ্রগতি জানিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলে এক অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন ঘটে। তৎপ্রতিক্রিয়ায় সাত কলেজের শিক্ষার্থী এবং ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। কিন্তু ঢাবি উপাচার্যের সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে সামান্যও আলোকপাত করা হয় নাই। ফলে কলেজগুলির শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ সম্পূর্ণ প্রশমিত না হইলে বিস্ময়ের কিছু থাকিবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রধান করিয়া সাত কলেজ সমস্যার স্থায়ী সমাধানে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হইয়াছিল বিদায়ী বৎসরের শেষ সপ্তাহে। ইহার পূর্বে অক্টোবরে সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে ১৩ সদস্যের আরেক কমিটি গঠন করা হইয়াছিল। মূলত ইহাদের মতামত ও সংগৃহীত তথ্য পর্যালোচনা, তৎসহিত সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিলকরত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রূপান্তরের প্রক্রিয়া বিবেচনা করিতেই পূর্বোক্ত কমিটি গঠিত হয়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশেষজ্ঞ কমিটি সাত কলেজের শিক্ষার্থীর কল্যাণে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে। আমাদের মনে আছে, এক সময় কলেজগুলি মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই পরিচালিত হইত। পরবর্তী সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর চাপ হ্রাসকল্পে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিয়া কলেজগুলি তাহার অধীন করা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহিত অধিভুক্তির পূর্বে সাত কলেজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল। কমিটি বিবেচনার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই পূর্বের বিষয়াবলিও পর্যালোচনা করিবে। কিন্তু যেই সিদ্ধান্তই আসুক, সাত কলেজের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের ললাটে যেন পূর্বের ভোগান্তি প্রতিস্থাপিত না হয়। কলেজগুলির ভর্তি পরীক্ষা যদ্রূপ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লইতে হইবে, তদ্রূপ অন্যান্য শিক্ষা কার্যক্রমেও গতি আনয়ন করিতে হইবে। অন্যদিকে রবিবারের সংঘাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ রাকিবের আহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নূতন যে কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াছে উহাকে কেন্দ্র করিয়া পরিস্থিতি যেন পুনরায় উত্তপ্ত না হয়, সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সুবিবেচনা প্রত্যাশিত।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ত কল জ র শ ক ষ র থ ন কর য় পর ক ষ হইয় ছ সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
ভোগবাদী যুগে ইসলামে সুখের খোঁজ
আপনার বাড়িতে কি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্তূপ জমে আছে? জানেন কি, এর থেকে মুক্তির পথ আছে ইসলামের সরল জীবনধারায়? আধুনিক বিশ্বে ভোগবাদের তীব্র ঝড়ে আমরা প্রায়ই নিজেদের দেখি অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ঠাসা ঘরে।
নতুন ফ্যাশনের পোশাক, সর্বশেষ প্রযুক্তির গ্যাজেট বা মধ্যরাতে এক ক্লিকে কেনা অপ্রয়োজনীয় পণ্য—এসব আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইসলাম আমাদের ন্যূনতম একটি সরল জীবনধারার পথ দেখায়, যা পার্থিব লোভ থেকে মুক্ত করে আমাদের আল্লাহর পথে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করে।
আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো।সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০সংযম কেন জরুরিমিনিমালিজম বা ন্যূনতাবাদ এমন একটি জীবনধারা, যেখানে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর নির্ভর করব এবং অতিরিক্ত ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকব। ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ না হয়ে শুধু যেটুকু না হলেই জীবন চলে না, সেটুকু নিজের কাছে রাখব।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে আদম সন্তান, প্রত্যেক নামাজের সময় বেশভূষা সৌন্দর্য গ্রহণ করো, খাও এবং পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত: ৩১)।
এই আয়াত আমাদের জীবনে সংযম ও সরলতার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুনদুনিয়ার ভোগ–বিলাস নিয়ে সুরা তাকাসুরের সতর্কতা১০ এপ্রিল ২০২৩বিজ্ঞাপনের প্রলোভন আজকাল আমাদের অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার দিকে ঠেলে দেয়। প্রায়ই এমন জিনিস কিনে ফেলি, যেমন একটি ইউএসবি মগ হিটার বা জামাকাপড়, যা তারপর বছরের পর বছর অব্যবহৃত পড়ে থাকে।
বাড়িতে জমে থাকে প্যাকেট না খোলা গ্লাস–বক্স, অপঠিত বইয়ের স্তূপ। প্রশ্ন করে দেখি তো, আমাদের আসলেই কি এগুলো প্রয়োজন ছিল?
মহানবী (সা.)-এর সাদাসিধা জীবনমহানবীজি (সা.) এবং তাঁর সাহাবারা সরল জীবনযাপনের উজ্জ্বল উদাহরণ। হজরত আয়েশা (রা.)-কে নবীজি বলেছিলেন, ‘হে আয়েশা, তুমি যদি আমার সঙ্গে মিলিত হতে চাও, তবে এই দুনিয়া থেকে একজন পথিকের প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো সামান্য গ্রহণ করো। ধনীদের সঙ্গে মেলামেশা থেকে সাবধান থাকো এবং কোনো পোশাককে তখনই জীর্ণ হয়ে গেছে মনে করো, যখন তুমি তাতে প্যাঁচ লাগিয়েছ (মানে যখন পুরোনো হয়ে যাওয়ার কারণে পেঁচিয়ে যায়)।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৭,৮০০)।
এই হাদিসে নবীজি (সা.) স্পষ্টভাবে সরল জীবনযাপন এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।ইসলাম আমাদের শেখায় যে পার্থিব সম্পদ ক্ষণস্থায়ী এবং এটি আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। নবীজি (সা.) কখনো অপ্রয়োজনীয় সম্পদ সঞ্চয় করেননি এবং সব সময় দানশীলতার মাধ্যমে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করেছেন।
দানের সংস্কৃতিআজকের বিশ্বে ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে জটিল করে তুলেছে। ক্রেডিট কার্ড, সহজলভ্য ঋণ এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের ক্রমাগত কেনাকাটার দিকে প্রলুব্ধ করে। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যেমন আমাদের দাদা-দাদিরা, সীমিত সম্পদের মধ্যে সরল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভোগবাদী প্রবৃত্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুনখাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে ইসলামের নির্দেশনা০৯ জুন ২০২৫কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায়, প্রয়োজনের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয় করা লোভ ও কৃপণতার দিকে নিয়ে যায়, যা একজন মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।
ইসলাম আমাদের জীবনকে সরল করার পাশাপাশি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে উৎসাহিত করে। আমরা চাইলে মাসিক বাজেটের একটি অংশ দানের জন্য বরাদ্দ করতে পারি।
যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪বিয়ের মতো উৎসবে আমরা বিলাসবহুল আয়োজনের পরিবর্তে সরলতা বেছে নিতে পারি। উপহারের পরিবর্তে আমরা দাতব্য সংস্থায় দানের জন্য অনুরোধ করতে পারি। এমনকি আমাদের একটি অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বাতিল করে সেই অর্থ স্থানীয় মসজিদে দান করতে পারি।
নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদে সংযমী হয় এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৯৯৪)।
আমাদের ভালো কাজ এবং দানশীলতা পরকালে যেমন উপকারে আসবে, তেমনি সমাজের জন্যও হবে কল্যাণকর। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দানশীলতার দিকে মনোযোগ দিলে সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের জীবন উন্নত হবে।
ভোগবাদী জীবন মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং ন্যূনতম খরচের জীবনধারা মানুষকে তৃপ্তির জীবন উপহার দেয়। এটি একই সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেরও একটি পথ।
আমরা যদি আমাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আল্লাহর পথে ব্যয় করি, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। ন্যূনতমবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রকৃত সুখ পার্থিব সম্পদে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের প্রস্তুতিতে নিহিত।
আরও পড়ুনআধুনিক এই প্রবণতার শিকড় ইসলামে২০ মে ২০২৫