রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বাহিনীর সংস্কার কঠিন
Published: 28th, January 2025 GMT
বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি বৃথা যেতে পারে। এসব বাহিনীর দ্রুত সংস্কার করা না গেলে পরের সরকারের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শঙ্কা থেকেই যাবে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলের সাড়ে ১৫ বছর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনীতিতে জড়িয়েছে, সেখান থেকে তাদের বের করে সংস্কার করা কঠিন হবে বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
গেল ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে ‘আফটার দ্য মনসুন রেভুলেশন: এ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন সুপারিশ তুলে ধরেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনটি আজ মঙ্গলবার প্রকাশ করতে যাচ্ছে এইচআরডব্লিউ। প্রতিবেদনে গণঅভ্যুত্থানের আগে-পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ভবিষ্যৎ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। কারণ হিসেবে বহু বছর ধরে র্যাব নির্যাতন করে আসছে– এমন তথ্য-উপাত্ত সংস্থাটির কাছে রয়েছে। দাতাদের অর্থায়নে বাহিনীটিকে মানবাধিকার প্রশিক্ষণ দিলেও উপকার দেখছে না সংস্থাটি। দাতাদের এ বাহিনীর পেছনে অর্থ খরচ করাকে ভুল বলছে এইচআরডব্লিউ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র আন্দোলনের সময় নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল। এ ধরনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সুপ্রতিষ্ঠিত অনুশীলন, যারা দীর্ঘ সময় ধরে দায়মুক্তির সংস্কৃতি উপভোগ করে আসছে। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতনের বিরোধী কমিটি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। পুলিশসহ বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়মুক্তি ও জবাবহীনতার বিষয়টিও প্রতিষ্ঠিত।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান, বহু থানা বন্ধ হয় এবং হামলার ভয়ে পুলিশ সদস্যরাও গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। যদিও মধ্য আগস্টের দিকে ৬৩৯ থানার মধ্যে ৬২৮টি আবার কার্যক্রম শুরু করে। এখন নিরাপত্তা খাতের সংস্কার এবং একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এবং সংস্কারের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। আর গুমের বিষয়টি তদন্তে কমিশনও গঠন করেছে। এ ছাড়া অন্য খাতের সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশের সংস্কার নিয়ে আলাদা কমিশন গঠন করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য আগে যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিল, তা যাতে ফিরে না আসে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে এইচআরডব্লিউর এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন সমকালকে বলেন, হাসিনার আমলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যেভাবে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে তাদের সংস্কার করা কঠিন হবে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনী সংস্কারে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কারে সরকারি আইনজীবী ও বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং নির্যাতনমূলক অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার নিশ্চিতে দাতা দেশগুলোর উচিত বিনিয়োগ করা। আর পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে যাতে এসব সংস্কার বদলে দিতে না পারে, সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি প্রস্তাবনা নেওয়া, যাতে তারা সংস্কার বাস্তবায়নে সহযোগিতার পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
এইচআরডব্লিউর জ্যেষ্ঠ গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, প্রতিবেদন তৈরির সময় আমরা অনেক পুলিশ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তারা বলেছেন, কীভাবে তাদের পুলিশে ভর্তি এবং পদোন্নতির সময় রাজনৈতিক নেতাদের ঘুষ দিতে হতো। পুলিশ সদস্যদের সাধারণ নাগরিককে নিপীড়ন করার জন্য পুরস্কৃত করা হতো। পুরো পুলিশ বাহিনী সম্পূর্ণভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। আর দীর্ঘ দিন ধরে চলা এসব অনিয়মের কারণে জুলাই-আগস্টের সহিংসতা হয়েছে। কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে জবাবদিহি করত এবং বোঝানো হয়েছিল নিপীড়ন চালানো তাদের কর্তব্য। জুলাই-আগস্টের মতো ঘটনা পুলিশ আগেও করেছে, এটি তাদের জন্য নতুন নয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সংস্কার পদক্ষেপ নেওয়ায় কিছু অগ্রগতি আছে। তবে কাঠামোগত সংস্কার জরুরি, তা না হলে পুলিশ আগের রূপে ফিরবে। ইতোমধ্যে কিছু আলামত দেখা গেছে। ৫ আগস্টের পর মামলার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গণগ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এতে ১০০ আওয়ামী লীগ নেতা এবং ২০০ থেকে ৩০০ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ যে কোনো মানুষকে হয়রানি করতে পারবে। কিছু অভিযোগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিজেরা জানেন না কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, এটি সঠিক বিচার পাওয়ার উপায় নয়। বর্তমান ড.
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিতর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সম্প্রতি উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের বিবৃতি দেখেছি। যেখানে আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধের বিষয়টি তোলা হয়েছে, এটি বেশ উদ্বেগের। কারণ বাংলাদেশিরা হয়তো আরেকটি নির্বাচন পেতে যাচ্ছে, যেখানে তারা পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিতে পারবে না।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বদলে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে– জানতে চাইলে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, সঠিক উপায়ে তদন্ত করে অভিযোগ গঠন করে বিচার করা।
প্রতিবেদনে টেকসই সংস্কারে সুপারিশের মধ্যে আরও বলা হয়েছে, গণগ্রেপ্তার ও অজ্ঞাতনামা মামলা বন্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। আটক ব্যক্তিকে যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারকের সামনে হাজির করা যায়। আটকে রাখার স্থান যাতে পরিদর্শন করা যায়। সেই সঙ্গে রিমান্ডের প্রচলনে নিষেধাজ্ঞা আনতে হবে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই সাংবাদিককে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অতীতের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী রিমান্ডে নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতন করে থাকে। এ ছাড়া যেসব আইন জবাবদিহির পথে বাধা, সেসব আইনকে সংশোধন বা বাতিল করার পরামর্শ অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়েছে এইচআরডব্লিউ।
কাঠামোগত সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীন করতে হবে। এদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। তাদের পদোন্নতি থেকে শুরু করে নিয়োগে যাতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থাকে।
কাঠামোগত সংস্কার করা হলে র্যাবকে কেন বিলুপ্ত করতে হবে? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, র্যাবকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। র্যাবকে সংস্কার করা সম্ভব নয় বলে এ বাহিনীকে আমরা আলাদা করে দেখছি। র্যাবকে যে কাঠামো ও ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে, তাতে সমস্যা আছে। সরকার যে কোনো কাজেই এ বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে, সেটা যত নিপীড়নমূলকই হোক না কেন।
প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরও (আইসিটি) সমালোচনা করা হয়েছে। অতীতে এটিকে ব্যবহার করে অস্বচ্ছ বিচার করা হয়েছে। আইসিটি আইনে এখনও অনেক ধারাই আন্তর্জাতিক মানের নয়। এখানে মৃত্যুদণ্ডের মতো বিধান রয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় এমন ধারা রয়েছে। যেমন অভিযুক্ত ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বিচার করা। নভেম্বর পর্যন্ত এ আদালতে শেখ হাসিনাসহ ৮০ জনকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
যারা অনুপস্থিত, তাদের বিচার কীভাবে করা যাবে– জানতে চাইলে এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, উপস্থিতি নিশ্চিত করে বিচার করতে হবে। কারণ অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, আইসিটি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে শেখ হাসিনাকে ফেরানো সহজ হবে না। বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করার পাশাপাশি আইসিটি আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করলে শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চাপ দেওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ঠ ম গত স স ক র স স ক র কর ন শ চ ত কর ব চ র কর র র জন য আগস ট র সরক র র ক ত কর আইস ট আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
পূজাকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলায় বাহিনী তৎপর : ডিসি
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, আইনসৃঙ্খলা স্বাভাবিক রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজাকে ঘিরে সকল ধর্মমত, সকল সম্প্রদায় তারা একত্রিত হয়েছে।
সকলেই সার্বিক সহয়তা করছে যাতে করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজা উৎসব সুন্দর ভাবে পজলন করতে পারে। পূজাকে ঘিরে একটি গোষ্ঠি চাইবে পূজা উৎসব নষ্ট করে দেয়ার জন্য।
সে জন্য আমাদের তৎপরতা রয়েছে। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তার পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশবাহিহনী সবাই কাজ করছে যাতে করে সুন্দর ভাবে পূজা উৎসব শেষ করতে পারি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ৫নং ঘাটে দূর্গা পূজার প্রতিমা বিসর্জনের স্থান পরিদর্শনকালে তিনি এ নির্দেশনা দেন।
দূর্গা পূজা বিজয়া দশমী শেষে প্রতিমা বিসর্জনের সময় যেকোনো অপ্রীতিকর দূর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুন্দর ভাবে প্রতিমা বিসর্জনের স্থান নিরাপদ রাখতে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, নারায়ণগঞ্জের ২২৩টি পূজা মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে পূজা উদযাপনে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বর্তমানে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে।
এসময় তিনি প্রতিটি মণ্ডপে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে পূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথ সহযোগিতার নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, সকলে মিলে সব উৎসব উদযাপন করাই বাংলার ঐতিহ্য ও গৌরব।
এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।