Samakal:
2025-06-16@17:10:24 GMT

কালোবাজারির থাবা

Published: 29th, January 2025 GMT

কালোবাজারির থাবা

বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক বাজারে বিক্রয় হইবার বিষয়টি উদ্বেগজনক। সমস্যা এতই ব্যাপক যে, বুধবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সত্ত্বেও বাজারে পুস্তক মিলিতেছে।

বস্তুত প্রায় প্রতি বৎসরই কালোবাজারে বিনামূল্যের পুস্তক বিক্রয় হইয়া থাকে। কিন্তু চলতি বৎসর অধিক হারে বিক্রয়ের কারণ হইল, শিক্ষার্থীদের বিপুলাংশের এখনও পাঠ্যপুস্তক হস্তগত হয় নাই। এই সুযোগে এক শ্রেণির কালোবাজারি স্বল্প বিনিযোগে অতি মুনাফার আশায় বেআইনিভাবে স্বীয় উদ্যোগে মুদ্রণ করিয়া পাঠ্যপুস্তক বিক্রয় করিতেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানও এহেন অপকর্মে লিপ্ত। উপরন্তু, অনেক অসাধু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও অতিরিক্ত চাহিদা প্রদর্শনপূর্বক সংগৃহীত পাঠ্যপুস্তক কালোবাজারিদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছেন বলিয়া অভিযোগ উত্থাপিত হইয়াছে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা প্রতি বৎসর বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরকারের তরফ হইতে পাইবার বিষয়টি একদিকে যদ্রূপ স্বস্তিদায়ক, তদ্রূপ শিক্ষার্থীদের জন্যও উদ্দীপকরূপে কার্যকর। তদুপরি, ইতোপূর্বে শিক্ষার্থীরা সাধারণত বৎসরের প্রথম দিবস বা মাসের প্রথমার্ধেই পাঠ্যপুস্তক হস্তগত করিতে  পারিত। এইবার উহা সম্ভব হয় নাই বলিয়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক প্রকার ব্যাকুলতার উদ্ভব হইয়াছে। ইহার সুযোগ লইতেছেন মুনাফালোভী পুস্তক ব্যবসায়ীগণ। ইহা সত্য, গত বৎসর জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বেকার শিক্ষাক্রম বাতিল এবং নূতন করিয়া পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন হেতু পুস্তক মুদ্রণে বিলম্ব ঘটিয়াছে। তবে এই বিষয়ে এনসিটিবির পক্ষ হইতে পরিষ্কার অগ্রিম ঘোষণা থাকিলে হয়তো এহেন পরিস্থিতি পরিহার করা সম্ভব হইত।

এনসিটিবি জানাইয়াছে, বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ নাই। বিষয়টি খতাইয়া দেখিতে এনসিটিবি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করিয়াছে। আমরা প্রত্যাশা করি, তাহারা প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করিতে সক্ষম হইবে। তবে কালোবাজারি বন্ধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জরুরি। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাইয়া কিছু পাঠ্যপুস্তক উদ্ধার করিলেও উহা হয়তো হিমশৈলের চূড়ামাত্র। সরকারের বিনামূল্যের পুস্তক যেহেতু কিন্ডারগার্টেনগুলি সহজে পায় না; অতিরিক্ত চাহিদার পুস্তক তাহাদের দেওয়া হয়। সেই কারণেই বিনামূল্যের পুস্তক বিক্রয় বন্ধে কেবল বাজারে অভিযান চালাইলেই হইবে না, বরং শিক্ষা প্রশাসনের কাহারা এই কালোবাজারির সহিত সংযুক্ত, তাহাদেরও চিহ্নিত করিতে হইবে। একই সঙ্গে যেই সকল মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান ইহার সহিত সংশ্লিষ্ট, তাহাদের স্বরূপও উন্মোচন করিতে হইবে।
সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিভিন্ন শ্রেণির এক প্রস্থ পুস্তক বাজারে পাঁচ হইতে ছয় সহস্র টাকায় বিক্রয় হইতেছে। যেইখানে শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যেই সরকারিভাবে এই পুস্তক লাভ করিবার কথা, সেইখানে এইরূপ অবৈধ বাণিজ্যে কেবল শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে না; একই সঙ্গে সরকারে শুভ উদ্যোগেও কালো ছায়া পড়িতেছে। কালোবাজারিতে পুস্তক বিক্রয় বন্ধে তজ্জন্য অভিভাবকদের সচেতনতাও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এই ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করিতে পারেন। বিশেষ করিয়া সকল পাঠ্যপুস্তক ইতোমধ্যে যেহেতু এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া হইয়াছে, সেইখান হইতে ডাউনলোড করিয়াও শিক্ষকরা পাঠদান করিতে পারেন। বাকি পাঠ্যপুস্তক যাহাতে দ্রুত সকল শিক্ষার্থীর নিকট পৌঁছানো যায় তজ্জন্য শিক্ষা প্রশাসনকে অধিক তৎপর হইতে হইবে। আমরা বিশ্বাস করি, সবাই আন্তরিক হইলে এতদিনে সকল পুস্তক পৌঁছানো কঠিন বিষয় ছিল না।

আগামী শিক্ষাবর্ষেও যাহাতে পাঠ্যপুস্তকের এহেন কালোবাজারি না হয়, তজ্জন্য এখন হইতেই তৎপরতার সূচনা আবশ্যক। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, সংশোধনসহ সকল কার্য জুনের মধ্যেই সম্পাদন করা চাই, যাহাতে পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া মুদ্রিত পুস্তক ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছানো সম্ভব হয়।

একই সঙ্গে আমরা ইহাও মনে করি, প্রতি বৎসর পুস্তক মুদ্রণ ও বিতরণের কর্মযজ্ঞ হ্রাসকল্পে পুস্তকের মান ও মুদ্রণ উন্নততর করা যাইতে পারে, যাহাতে দুই-তিন বৎসর একই পুস্তক বিতরণ সম্ভব হয়। ইহাতে অর্থেরও যথেষ্ট সাশ্রয় করা সম্ভব হইবে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এনস ট ব ন কর ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জীবনের অপচয় রোধ জরুরি

দেশে পানিতে ডুবিয়া শিশুর প্রাণহানির যেই চিত্র শনিবার সমকালের এক প্রতিবেদনে উঠিয়া আসিয়াছে, উহা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ঈদুল আজহার ছুটি আরম্ভ হইবার পূর্বের ১০ দিবসেই বিভিন্ন স্থানে ১৫ জন পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছে, যাহাদের মধ্যে ১৩ জন ছিল শিশু। উপরন্তু, ঈদুল ফিতরের পূর্বাপর ১২ ছুটিতে মোট ৪৯ জন অনুরূপভাবে প্রাণ হারাইয়াছে, যথায় শিশুর সংখ্যা ৪৭। এদিকে ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ঈদুল ফিতরে ৫৮ জন ও ঈদুল আজহায় ৬৫ শিশু পানিতে ডুবিয়া প্রাণ হারাইয়াছিল। এই ধারণা অমূলক নহে যে ঈদের ছুটিতে শহরবাসী অনেকে ছুটিয়া যায় গ্রামাঞ্চলে, যেইখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ শিশুদের আকৃষ্ট করিয়া থাকে। তাহারা পানির আশপাশে খেলার বিপদ সম্পর্কে সচেতন থাকে না, জানে না খাল-বিল, ডোবা-পুকুর কতটা বিপজ্জনক পরিণতি ডাকিয়া আনিতে পারে। গ্রামের বিস্তৃত ও অপেক্ষাকৃত নির্জন পরিবেশে শিশুদের তদারকির অভাবও প্রকট। অভিভাবকগণ সাধারণত গৃহকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তেমন নজর থাকে না শিশুর গতিবিধির উপর। এই সকল কিছু মিলাইয়া সংশ্লিষ্ট শিশুর জন্য সৃষ্টি হয় মৃত্যুফাঁদ। দুর্ভাগ্যজনক হইল, এই সকল বিয়োগান্তক ঘটনার কারণে গ্রামের মুক্ত পরিবেশে অনেক পরিবারে ছুটির উচ্ছ্বাস নিমেষে মাটি হইয়া যাইবার পরও জনচেতনতা পরিলক্ষিত হইতেছে না। ফলস্বরূপ, এহেন হৃদয়বিদারক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়াই চলিয়াছে।

প্রতিটি শিশুর প্রাণই মূল্যবান। একটি জীবন অকালে ঝরিয়া যাইবার অর্থ একটি সম্ভাবনার অপমৃত্যু, একটি ভবিষ্যতের হারাইয়া যাওয়া। এই ক্ষতি শুধু সংশ্লিষ্ট পরিবারের নহে, সম্পূর্ণ সমাজের এবং রাষ্ট্রের। অথচ এহেন মৃত্যু রোধে রাষ্ট্রীয়ভাবেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নহে। প্রতিবেদনমতে, ২০১১ সালের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে পানিতে ডুবিয়া শিশুমৃত্যুর ঘটনাকে জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে চিহ্নিত করিবার পর ২০২২ সালে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৮ সহস্র কমিউনিটিবেজড চাইল্ড কেয়ার সেন্টার স্থাপনের ঘোষণা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল এক হইতে পাঁচ বৎসর বয়সী শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ ও সাঁতার শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি। বাস্তবে কয়েকটি প্রশিক্ষণ ব্যতীত কিছুই হয় নাই। ২০১৫ সালে স্কুল-কলেজে সাঁতার শিখাইবার নির্দেশনা প্রদান করা হইলেও তাহা এখনও উপেক্ষিত। জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা নির্ধারিত থাকিলেও বাস্তবায়নের চিত্র প্রায় শূন্য। এই অবস্থায় দ্য সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এবং আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় ধরা পড়িয়াছে, দেশে প্রতিবৎসর প্রায় ১৪ সহস্র শিশু পানিতে ডুবিয়া মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৪০টি শিশু প্রাণ হারায়। তাদের ৭৫ শতাংশের বয়স পাঁচ বৎসরের নিচে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে পানিতে ডুবিয়া প্রতিবৎসর আহত হয় অন্তত এক লক্ষ শিশু। ইহাদের মধ্যে প্রায় ১৩ সহস্র পঙ্গু হইয়া যায়। পরিণামে ঐ শিশুরা পরিবারের পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজের বোঝা হইয়া দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, দেশে অপঘাতজনিত শিশুমৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ পানিতে ডুবিয়া যাওয়া। এমনকি নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ায় যত শিশু মৃত্যুবরণ করে, ততোধিক শিশু মারা যায় পানিতে ডুবিয়া। এতদসত্ত্বেও এই প্রাণহানি লইয়া কোনো তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থা নাই, অতএব সরকারি কোনো তথ্যভান্ডারও গড়িয়া উঠে নাই। অথচ ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে তথ্যাদি নথিভুক্তি শুরু হইলে বৎসরান্তে ইহার অন্তত হিসাব মিলিত। বিলম্বে হইলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বোধোদয় ঘটুক, ইহাই আমাদের প্রত্যাশা। এই বিষয়ে প্রয়োজনে ইউনিসেফের ন্যায় সংস্থাসমূহকেও কাজে লাগানো যায় বলিয়া আমরা মনে করি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জীবনের অপচয় রোধ জরুরি