ফেসবুকে হাজারো ছবির মধ্যে একটি ছবি চোখ কেড়ে নেয়। পিকআপভর্তি নকশিকাঁথা। এর ওপর বসে আছেন এক তরুণী। তাঁর নাম মাধবী। এসএমই মেলা শেষ করে ফেরার পথে কাঁথা ও অন্যান্য পণ্য ট্রাকে তোলার লোক পাননি। তাই মাধবী নিজেই পণ্য তোলেন। নারী হিসেবে আমার গর্ববোধ তো অবশ্যই; কিছুটা কৌতূহলও জাগল। ‘মাধবী মার্ট’ নামে তাঁর একটি শোরুম রয়েছে। উত্তরা উত্তর মেট্রো স্টেশনের কাছে।
মেট্রোতে করে একদিন মাধবী মার্টের শোরুমে হাজির হলাম। সেখানে সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। শোরুমে এমন পণ্য দেখতে পেলাম, যা আগে কখনও দেখিনি। আমি জানতাম, বাংলাদেশের অনুমোদিত জিআই পণ্যের সংখ্যা ৩১টি। মাধবী মার্টে গিয়ে মনে হলো, পুরো বাংলাদেশটাই জিআই পণ্যে ভরপুর। যেমন– মানিকগঞ্জের ঘিওরের বেত দিয়ে তৈরি ঝুড়ি, আয়নার ফ্রেম, বাটি ও থালা, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের বাঁশের পণ্য, নীলফামারীর হোগলাপাতা ও কচুরিপানার পণ্য, টেকনাফের সুপারির খোল দিয়ে তৈরি ওয়ানটাইম থালা-বাসন, কেরানীগঞ্জের মাটির পণ্য, নারায়ণগঞ্জের জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, সিলেটের কমলগঞ্জের মণিপুরি শাড়ি। সব থেকে অবাক হলাম নারকেলের শলার ঝাড়ু দেখে। এটা ভীষণ নান্দনিক। মাধবী বলেন, ‘‘নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায় আমার বাড়ি। আমার চাচা এই শলার ঝাড়ু তৈরি করেন। একদিন আমাকে বলেন, দেখ তো মাধবী, এটি বিক্রি করা যায় কিনা? আমি দেখেই বলি, বিক্রি করা যাবে না আবার। এটি দৌড়াবে। সেই থেকে শুরু নারকেলের শলার ঝাড়ু বিক্রি। যেদিন মাধবী মার্টের পেজে নারকেলের শলার ঝাঁড়ু বিক্রির ভিডিও দিলাম, সেদিন আমার ফেসবুকে ভালোমন্দ মন্তব্যের ঝড় ওঠে। কেউ আমাকে ‘ঝাড়ুওয়ালি’ উপাধি দেন। কেউ বলেছেন ‘ফাতরা মহিলা’, কেউ বলেছেন ‘বেটির মাথায় সমস্যা আছে’, আবার এর বিপরীতে কেউ কেউ ইতিবাচক মন্তব্যও করেছেন।’’ শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মাধবী মার্টের স্বত্বাধিকারী।
চোখে একরাশ আলোর ঝলক নিয়ে মাধবী বলেন, ‘আমার ব্যবসার মূলধন আমার গ্রাহক। আমি ব্যবসা শুরু করেছি ২০১৭ সালে, জামালপুরের নকশিকাঁথা এবং সালোয়ার-কামিজ দিয়ে। তখন আমার কোনো শোরুম ও মূলধন ছিল না। সম্বল ছিল একটা বাইসাইকেল আর রুমমেট সানজিদা ইভা আপুর দেওয়া ১০ হাজার টাকা। আমার গণ্ডির মধ্যে যে কয়জন মানুষ ছিলেন তাদের কাছে সাইকেল চালিয়ে যেতাম ব্যাগে নকশিকাঁথা বা থ্রিপিস নিয়ে। যেহেতু আমার কোনো দোকান ভাড়া নেই। আমি একটু কম দামে পণ্য দিতাম। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে বেশ ভালো সাড়া পেলাম। ২০১৯ সালে ফার্মগেটে জেনেটিক মার্কেটে একটি দোকান নিলাম। হঠাৎ করে ব্যবসা খারাপ চলায় দোকানের তিন মাসের ভাড়া দিতে পারিনি। পরে দোকানের মালিক দোকানে তালা দিয়ে দেন। আমি অনেক অনুরোধ করলেও তিনি দোকানের তালা খুলে দেননি। আমাকে বিপদে পড়তে দেখে তিনি আমাকে বাজে প্রস্তাব দেন। আমি মাথা নতো করিনি। মার্কেটের দোকান মালিক সমিতিকে লিখিত বিচার দিলাম। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কেটের সবার সামনে তিনি আমার কাছে ক্ষমা চান। তিনি তা ভুলে যাননি। ২০২০ সালে একদিন রাস্তায় পেয়ে আমার সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন। আমার ওড়না টেনে ধরেন। এ ঘটনার পর আমি মামলা করি। কোনো অপরাধ না করেও চারদিকের মানুষের কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম। মা-বাবাও আমাকে ভুল বুঝলেন।’
নিজের সংগ্রামের কথা বলে চলেন মাধবী– “ব্যবসা নেই। হাতে টাকা নেই। পরিবার বা বন্ধু-বান্ধবও পাশে নেই। আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হয়েছে, প্রজাপতি বেঁচে থাকে মাত্র ২৮ ঘণ্টা। এরই মধ্যে সে চমৎকার পাখা মেলে দুনিয়াকে জানান দিয়ে যায়। আমার মনে হলো– একটাই তো জীবন। এখানে মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। তখন শূন্য হাতে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যাই। উদ্দেশ্য– মানুষকে ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন করা। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যান্সার নিয়ে স্কুল বা উঠানে বসে নারীদের সচেতন করতাম। এ কাজ করতে গিয়ে সচেতনতা তো হয়েছেই। আমি পুরো বাংলাদেশের কোথায় কী বিখ্যাত, তা কাছ থেকে দেখেছি এবং কিছু ভালো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে তারা আমার ব্যবসায় সাহায্য করেন। ২০২১ সালে আইপিডিসি ফাইন্যান্স এবং ডেইলি স্টারের উদ্যাগে ‘অদম্য সাহসী নারী’ হিসেবে নির্বাচিত হই। সেখানে ২ লাখ টাকা পুরস্কার পাই। সেটি দিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করি। শোরুম নিলাম। জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার বাউশি বাজারে নকশিকাঁথা উৎপাদন কেন্দ্রে একটি কারখানা খুলি।”
মাধবী মার্ট এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। মাধবী বলেন, ‘আমি চাই আমার বাংলাদেশ পুরো পৃথিবীর ঘরে ঘরে থাকুক। দু’এক বছর ধরে আমরা পোস্ট অফিসের মাধ্যমে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে পণ্য পাঠাচ্ছি।’
এ নারী উদ্যোক্তার কথা শুনে শুধু এটাই মনে হচ্ছিল– নারীকে সাহসী হতে হবে। এভাবেই এগিয়ে আসতে হবে। অধিকার বুঝে নিয়ে অংশগ্রহণ করতে হবে। নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজারে নারীর অংশীদারিত্ব সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আরও পদক্ষেপ এবং এর তদারকি জরুরি। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দরকার বলে মনে করেন মাধবী। v
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
দুই সপ্তাহের মধ্যে তেহরানে সুপেয় পানি ফুরিয়ে যেতে পারে
তীব্র খরার কবলে পড়েছে ইরানের রাজধানী তেহরান। সেখানে বাসিন্দাদের সুপেয় পানির প্রধান উৎসটি দুই সপ্তাহের মধ্যে শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম আইআরএনএ গতকাল রোববার এ খবর জানিয়েছে।
তেহরানে পানি সরবরাহ কোম্পানির পরিচালক বেহজাদ পারসার বরাত দিয়ে আইআরএনএর খবরে বলা হয়, তেহরানে খাবার পানি সরবরাহের পাঁচটি উৎসের একটি আমির কবির বাঁধ। সেটিতে এখন মাত্র ১ কোটি ৪০ লাখ ঘনমিটার পানি আছে। এটি জলাধারটির মোট ধারণক্ষমতার মাত্র ৮ শতাংশ।
বেহজাদ পারসা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই পরিমাণ পানি দিয়ে মাত্র দুই সপ্তাহ তেহরানের খাবার পানির চাহিদা মেটানো যাবে।
ইরানি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তেহরানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ ঘনমিটার পানির প্রয়োজন পড়ে।কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র খরার মোকাবিলা করছে ইরান। গত মাসে স্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, তেহরান প্রদেশে এবার বৃষ্টির যে মাত্রা, তেমনটা গত এক শতাব্দীতে খুব একটা দেখা যায়নি।
এক কোটির বেশি মানুষের নগর তেহরান তুষারাচ্ছন্ন আলবোর্জ পর্বতমালার দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত। এই পর্বতমালার সর্বোচ্চ উচ্চতা ৫ হাজার ৬০০ মিটার (১৮ হাজার ৩৭০ ফুট) পর্যন্ত। এই পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন নদীগুলো বহু জলাধারে পানির জোগান দেয়।
বেহজাদ পারসা বলেন, এক বছর আগেও আমির কবির বাঁধে ৮ কোটি ৬০ লাখ ঘনমিটার পানি ছিল। কিন্তু তেহরান অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় শতভাগ হ্রাস পেয়েছে।
তেহরানে পানি সরবরাহ করা বাকি জলাধারগুলোর বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি এই কর্মকর্তা।
ইরানি সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তেহরানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ ঘনমিটার পানির প্রয়োজন পড়ে।
এক বছর আগেও আমির কবির বাঁধে ৮ কোটি ৬০ লাখ ঘনমিটার পানি ছিল। কিন্তু তেহরান অঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় শতভাগ হ্রাস পেয়েছে।বেহজাদ পারসা, তেহরানে পানি সরবরাহ কোম্পানির পরিচালকপানি সাশ্রয়ের পদক্ষেপ হিসেবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তেহরানের বেশ কয়েকটি এলাকায় বারবার সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর চলতি গ্রীষ্মে ঘন ঘন পানি সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে।
জুলাই ও আগস্টে পানি ও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য দুই দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। ইরানে সে সময় তাপপ্রবাহের মধ্যে প্রতিদিন একাধিকবার লোডশেডিং হয়েছে।
ওই দুই মাসে তেহরানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে গেছে, কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) ছুঁয়ে গিয়েছিল।
জুলাই ও আগস্ট মাসে তেহরানে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ফারেনহাইট) ছাড়িয়ে গেছে, কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২২ ফারেনহাইট) ছুঁয়ে ছিল।ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘আজ যেভাবে আলোচনা হয়েছে, পানিসংকট পরিস্থিতি তার চেয়েও গুরুতর।’
ইরানজুড়ে পানিসংকট একটি বড় সমস্যা, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণের শুষ্ক প্রদেশগুলোতে। ভূগর্ভস্থ সম্পদ ব্যবহারে অব্যবস্থাপনা ও সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহারকে পানি ঘাটতির জন্য দায়ী করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে ভূমিকা রাখছে।
আরও পড়ুনপ্রচণ্ড গরমে পানির ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ইরানিদের কম পানি ব্যবহারের আহ্বান২০ জুলাই ২০২৫