দুই সপ্তাহ ধরে দক্ষিণ লেবাননের মানুষ হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে তাঁদের ঘরবাড়ি ও জমিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কোনো পক্ষই ইসরায়েলকে দখল করা অঞ্চল থেকে সরাতে পারেনি। এরপর লেবাননের সাধারণ মানুষই এ উদ্যোগ নেন।

২৬ জানুয়ারি রোববার প্রথম ইসরায়েলি বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি চালায়। এতে অন্তত ২২ জন নিহত হন এবং ১২০ জনের বেশি আহত হন। কিন্তু জনগণের অটল সংকল্প ও আত্মত্যাগে ইসরায়েলি বাহিনী অধিকাংশ সীমান্তবর্তী গ্রাম থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়।

এই প্রতিরোধ করতে গিয়ে লেবাননের মানুষকে কঠিন মূল্য দিতে হয়েছে। তবে এটি আবারও প্রমাণ করেছে—ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের শক্তিই সবচেয়ে কার্যকর পথ।

নভেম্বরের শেষ দিকে শুরু হওয়া ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির সময় হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো হামলা চালায়নি এবং তাদের কোনো সামরিক উপস্থিতিও দেখা যায়নি। কিন্তু এর বিপরীতে ইসরায়েল লেবাননের সঙ্গে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি শত শতবার লঙ্ঘন করেছে। তারা লেবাননের আকাশে ড্রোন উড়িয়েছে, সাধারণ মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করেছে এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করেছে। এখনো তারা এসব অন্যায় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি করছে না।

ইসরায়েলের এই উসকানিমূলক আচরণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। লেবাননে মোতায়েন জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউনিফিল), যারা ইসরায়েলের হামলা থেকে লেবাননকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তারা বরং হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ইউনিফিল এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, যুদ্ধবিরতির সময় দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর এক শরও বেশি গোপন অস্ত্র কেন্দ্র পাওয়া গেছে।

এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে সাহায্য করা দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স ইসরায়েলকে তার জবাবদিহি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্রান্স অন্তত লেবাননের সার্বভৌমত্বের কথা বলেছে। যুক্তরাষ্ট্র তা–ও বলছে না। তারা উল্টো লেবাননের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। তারা ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি দখলদারির ভয় দেখিয়ে লেবাননে দ্রুত নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য চাপ দিয়েছে, যাতে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায়।

লেবানন সরকারের পক্ষ থেকে দখলদারি শেষ না করার ব্যর্থতা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরবে। তবে হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের প্রতিরোধহীনতা তার সক্ষমতার প্রতি আস্থা আরও কমিয়ে দেবে।

এই চাপের ফলে দ্রুত একজন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু নতুন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া এখনো থমকে আছে, কারণ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দল মন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। নতুন সরকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিষয়ে কী অবস্থান নেবে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব ১৭০১ কার্যকর হবে কি না, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত লেবানন ফোর্সেস দলের নেতারা দ্রুত জাতিসংঘের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের পক্ষপাতদুষ্ট মার্কিন ব্যাখ্যা মেনে নেয়। তারা চেয়েছিল শুধু লিতানি নদীর দক্ষিণেই নয়, বরং লেবাননজুড়ে হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্র করা হোক।

এদিকে হিজবুল্লাহ যখন লেবাননের সাবেক সেনাপ্রধানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়, তখন অনেকে মনে করতে থাকে, সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকি এ গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে ইসরায়েল ৬০ দিনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরও লেবানন দখল করে রাখতে চায়।

কিন্তু সপ্তাহান্তে পরিস্থিতি বদলে যায়। সাধারণ মানুষ হঠাৎ করে সংগঠিত হয়ে দক্ষিণ লেবাননে নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে শুরু করে। এটি ইসরায়েলের পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেয়।

লেবাননের সেনাবাহিনী (যাদের ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্ষাকর্তা হিসেবে মনে করা হতো) এবার সাধারণ মানুষের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। নিরস্ত্র নারী-পুরুষদের ইসরায়েলি ট্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার দৃশ্য অনেককে ২০০০ সালের মুক্তির সময়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

এখন এই ঘটনাকে লেবাননের ‘তৃতীয় মুক্তি’ বলা হচ্ছে (২০০০ ও ২০০৬ সালের পর)। তবে এই ফিরে আসা স্থায়ী হবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত।

মানুষ ফেরার মাত্র দুই দিন পর ইসরায়েল নাবাতিয়েহ শহরে বিমান হামলা চালিয়ে ২৪ জনকে আহত করেছে। ইসরায়েলি বাহিনী এখনো কিছু সীমান্তবর্তী গ্রামে অবস্থান করছে। কারণ, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকার অনুমতি দিয়েছে।

এই পরিস্থিতি লেবাননের দক্ষিণ অংশকে সব সময় যুদ্ধের আতঙ্কে রাখছে। ওয়াশিংটন সম্ভবত এই অনিশ্চয়তাকে কূটনৈতিক চাপ হিসেবে ব্যবহার করবে, যাতে তারা লেবাননের নতুন সরকার ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় নিজেদের শর্ত চাপিয়ে দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই সহায়তাকে এমনভাবে ব্যবহার করতে চায়, যাতে লেবাননের জনগণের রাজনৈতিক চেতনা থেকে সশস্ত্র প্রতিরোধের ধারণাকে আলাদা করা যায়।

এদিকে দেশীয় ব্যবসায়ী চক্রগুলোও ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারের নামে অতিরিক্ত অর্থ কামিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

সম্প্রতি হিজবুল্লাহর নতুন সেক্রেটারি জেনারেল নায়েম কাসিম তাঁর দলের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি। তিনি বলেছেন, যত দিন দখলদারি থাকবে, তত দিন প্রতিরোধের অধিকার থাকবে। তবে তিনি নতুন সামরিক অভিযান শুরু করার কথা বলেননি।

এর পরিবর্তে তিনি সব দায় লেবাননের সরকার এবং সেনাবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দেন। এটি একটি দ্বিধাগ্রস্ত নীতি।

লেবানন সরকারের পক্ষ থেকে দখলদারি শেষ না করার ব্যর্থতা প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরবে। তবে হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের প্রতিরোধহীনতা তার সক্ষমতার প্রতি আস্থা আরও কমিয়ে দেবে।

এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, সবাই জনগণের প্রতিরোধের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

হিচাম সাফিইদ্দিন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল ব নন র স ইসর য় ল র ন সরক র দখলদ র জনগণ র র সময় র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক

লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক দেশে আগামী সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক অচলাবস্থা, সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর করবে বলে আশা করছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। আজ শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন তিনি।

লন্ডনে দুই নেতার বৈঠকের বিস্তারিত সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করারও আহ্বান জানিয়েছেন সাইফুল হক।

সরকারের এই উদ্যোগ বিলম্বিত বোধদয়ের ফল বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সাইফুল হক বলেন, আরও আগে সরকারের এই বোধদয় হলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক ও রাজনৈতিক বিরোধ এড়িয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিসহ মৌলিক কাজে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া যেত।

সব অংশীজনকে আস্থায় নিয়ে সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানান সাইফুল হক। তিনি বলেন, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের রাস্তা সুগম হলো।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাইফুল হক বলেন, দেশের মানুষের অধিকার ও মুক্তি অর্জনে তাঁর দল জনগণের ভালোবাসা নিয়ে আগামীতে আপসহীন ধারায় সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য বহ্নিশিখা জামালী, আকবর খান, আবু হাসান টিপু, আনছার আলী দুলাল ও মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক। সমাবেশে সংহতি জানান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিষদের আহবায়ক শেখ আবদুর নূর।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম মীর, রেজাউল আলম, ফিরোজ আলী, কেন্দ্রীয় সংগঠক আইয়ুব আলী, বাবর চৌধুরী, ঢাকা মহানগর কমিটির নেতা মো. সালাউদ্দীন, মিজারুল রহমান ডালিম, আরিফুল ইসলামসহ পার্টির ঢাকা মহানগরের নেতারা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানের শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান সাবেক শাহের পুত্রের
  • আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেন ইশরাক হোসেন
  • আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা ইশরাকের
  • রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের হিস্যা কোথায়
  • লন্ডন বৈঠকে অবিশ্বাস দূর, সরকারের সম্মানজনক প্রস্থানের পথ সুগম হবে: সাইফুল হক
  • বাজেটের ত্রুটি সংশোধনের আহ্বান
  • ইসরায়েলের ৯ ভবন ধ্বংস করল ইরান
  • ড. ইউনূসকে দেশের কাজে যুক্ত রাখতে চায় বিএনপি
  • জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ইরানের প্রেসিডেন্ট