সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দিয়েছিলেন গোপালগঞ্জের সাত্তার খন্দকার, আরাফসান আশিক ও রফিকুল শেখ। কিন্তু ইতালি যাওয়া হয়নি তাদের। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান তারা। এর আগে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা।
স্বজনরা জানান, ডিসেম্বর মাঝামাঝি সময়ে ইতালির উদ্দেশে পাড়ি জমান সাত্তার, আশিক ও রফিকুল। প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই যান তারা। সেখানে কয়েক দিন থেকে সৌদি ও মিসর হয়ে লিবিয়া পৌঁছান। কথা ছিল লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে তাদের সরাসরি ইতালি পাঠানো হবে। কিন্তু দালাল কথা রাখেনি। আজদাবিয়া শহরের বন্দিশালায় জিম্মি করে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। পড়ে ইতালির উদ্দেশে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় তুলে দেওয়া হয় তাদের। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে সলিল সমাধি হয় তিন তরুণ ও কিশোরের। তাদের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।
রাঘদী ইউনিয়ন চর প্রসন্নদী গ্রামে সাত্তারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সন্তান আব্দুল্লা আল সাইদ (৪) ও হালিমাকে (৮) সান্ত্বনা দিচ্ছে এলাকাবাসী। পাশেই বাকরুদ্ধ স্ত্রী লাবনী বেগম। থেকে থেকে বিলাপ করছেন ভাই আবুল খায়ের খন্দকার। স্বজনের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে পরিবেশ।
স্বজনরা জানান, মোল্লাদী গ্রামের শহীদ শেখের সঙ্গে সাত্তারের ১৬ লাখ টাকায় ইতালি যাওয়ার চুক্তি হয়। প্রথমে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়। বাকি টাকা ইতালি পৌঁছানোর পরে পরিশোধের কথা ছিল। গত বছরের ১৭ নভেম্বর ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন সাত্তার। ২১ ডিসেম্বর লিবিয়া পৌঁছান। সেখানে বন্দিশালায় জিম্মি করে ২৬ লাখ টাকা আদায় করে দালাল চক্র। ভিটেমাটি বিক্রি ও চড়া সুদে ঋণ নিয়ে শহীদ শেখকে সেই টাকা দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার তারা নিশ্চিত হন, সাত্তার আর নেই।
সাত্তারের বড় ভাই আবুল খায়ের খন্দকার বলেন, ২৮ জানুয়ারি ফেসবুকে জানতে পারি ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির কথা। দালাল শহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানায়, সাত্তার ইতালি পৌঁছেছে। ২৮ জানুয়ারি লিবিয়ার একটি পেজের মাধ্যমে দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইয়ুব শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি উপকূলের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। ওই কর্মকর্তা নিহতদের ছবি মেসেঞ্জারের পাঠিয়ে দিলে সাত্তারকে শনাক্ত করি।
সাত্তার খন্দকারের মতো হতভাগ্য একই গ্রামের মেহেদী হাসানের ছেলে আরাফসান আশিক। তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় তিনি। ২০২৪ সালে ঢাকার ধামরাইর জালশাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। আশিকের স্বপ্ন ছিল ইউরোপে গিয়ে অনেক টাকা আয় করবেন। বোনকে ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। স্বপ্ন পূরণে শ্রীচাদপুর গ্রামের বাবু হাওলাদারকে ১৭ লাখ টাকা দিয়ে ইতালি যাওয়ার চুক্তি করেন। ধারদেনা করে বাবা ১৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা দালালকে দিয়েছেন।
আশিকের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, উঠানে হেলান দিয়ে বসে আছেন হতবিহ্বল বাবা মেহেদী হাসান। কাঁদতে কাঁদতে চোখে পানি শুকিয়ে গেছে তাঁর। ছেলের মৃত্যুর কথা শোনার পর থেকে বাকরুদ্ধ মা খাদিজা বেগম।
বাবা মেহেদী হাসান বলেন, দালাল বাবু বলেছিল ছেলেকে নিরাপদে ইতালি পৌঁছে দেবে। সে বেইমানি করেছে। এ ঝুঁকি জানলে ছেলেকে পাঠাতাম না। এখন অন্তত সরকার লাশ ফেরত আর দালাদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুক।
নৌ দুর্ঘটনার শিকার আরেক তরুণ রফিকুল শেখ মোল্লাদী গ্রামের আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে। আট মাসের মধ্যে তাঁর বাবা, মা ও ভাই মারা গেছেন। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরও একটি শোক পরিবারটিকে তছনছ করে দিয়েছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রফিকের বড় ভাই ফিরোজ শেখ বলেন, বাবা, মা ও ভাই কেউ নেই। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব। আপন বলতে কেউ রইল না। আমি দালাল বাবুর দৃষ্টান্তমূক শাস্তি চাই।
এসব বিষয়ে কথা বলতে দালাল শহীদ শেখ ও বাবু হাওলাদারের বাড়ি গেলে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্ঠী পদ রায় বলেন, সৈকতে ভেসে আসা মরদেহগুলো অর্ধগলিত ছিল। সেখানেই তাদের সমাহিত করা হয়েছে বলে জেনেছি। অবয়ব দেখে ধারণা করা হয়েছিল, লাশগুলো বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রতিনিধি দল সেখানে গিয়েছিল। তাদের ওই এলাকা পরিদর্শন করতে দেওয়া হয়নি। এসব কারণে দেশে মরদেহ আনতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ প লগঞ জ
এছাড়াও পড়ুন:
সমান কাজ করেও কম মজুরি পান আদিবাসী নারীরা
দিন যায়, আসে নতুন দিন। প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যায় অনেক কিছুই। শুধু বদল হয় না সমাজের পিছিয়ে পড়া কিছু জনগোষ্ঠীর ভাগ্য। বিশেষ করে, আদিবাসী নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
সমালোচনার মুখে ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রেই লিঙ্গ বৈষম্য কমেছে। নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দিনে দিনে কমছে। কিন্তু, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লীর নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আগের মতোই।
দিনাজপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকার সাঁওতাল পল্লী জয়পুর পাড়া। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামটি দেখতে বেশ সুন্দর। নিরিবিলি পরিবেশ, চারদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানক্ষেত আর কিছু দূর পর পর সাঁওতালদের বাড়ি। কোথাও কোথাও উঁচু টিলার মাঝে বড় বড় পুকুর। পুকুর পাড়ে কিছু সাঁওতাল ঘর বেঁধে থাকছেন। পাশের বড় মাঠে খেলা করছে কিছু আদিবাসী শিশু।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে পেশা বদলাচ্ছেন অনেক শ্রমিক
ছোট্ট হাতে সংসারের হাল
পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের কেউ কেউ বাঁশের চটা তুলছেন, কেউ রান্নার জন্য গাছের ডাল কাটছেন। বাড়িতে পালন গরু-ছাগল দেখভাল করছেন পুরুষ ও নারী উভয়ই। নারীদের অধিকাংশই গরু-ছাগল চড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে বাড়ির বাইরে। যদিও ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়নি তেমন।
কয়েকজন সাঁওতাল নারীকে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। তারদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরাও পুরুষের মতো জমিতে বীজ বপন, চারা উত্তোলন, রোপণ, সার দেওয়া, নিড়ানি ও ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত সব কাজ করি। কিন্তু, এখনো সেই আগের মতোই মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি আমরা।”
গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের জয়পুর পাড়া গ্রামের কর্মজীবী সাঁওতাল নারী মমতা হেমব্রম। তিনি বলেন, “পুরুষরা কাজ করে মজুরি পান ৫০০ টাকা আর আমাদেরকে দেওয়া হয় ৪৫০ টাকা। ক্ষেত-খামারের কাজ অনেক কঠিন। পুরুষ-নারী তো সমান কাজ করি। আমরা সমান মজুরি চাই, কিন্তু চাইলেও তো তারা দেন না।”
একই গ্রামের সাবিনা হাসদা। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ ও নারী ধান-আখ ও মাছ চাষ ও গরু-ছাগল লালনপালন করেন। কাজ একই হলেও আমাদের মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। আমরা সমান মজুরি চাই।”
সুরুজ মনি টুডু নামের আরেক নারী বলেন, “আমরা পুরুষের সমান কাজ করি, তাই আমরা এই মে দিবস থেকেই সমান মজুরি চাই। আপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে সমান মজুরি নিশ্চিত করার দাবি করছি।”
সাপমারা গ্রামের দেলু মারমা বলেন, “আমাদের সব কাজই কৃষিনির্ভর। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। তা না হলে সংসার চলে না। আমরাও চাই, পুরুষ এবং নারী যেন সমান মজুরি পান।”
পুকুর পাড়েই বাস করেন অমেদা হাজদা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “সব জায়গায় পুরুষের দাম বেশি, নারীদের দাম কম। সে কারণে তাদের মজুরি বেশি, আমাদের কম। আমাদেরকেও পুরুষের সমান দাম দেবে, সমান মজুরি দেবে, এটাই আমাদের দাবি।”
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে রাইজিংবিডিকে বলেন, “এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে তাদের ধারণাই নেই। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে ন্যায্য মজুরির বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সমঅধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ বলেন, “গাইবান্ধার নারীরা আজও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে, গোবিন্দগঞ্জের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নারীরা। নারী-পুরুষ সবাই শ্রমিক, বৈষম্য করতেই তাদের আলাদা চোখে দেখা হয়। মে দিবসে মুখে যতই বলি না কেন, পুরুষশাসিত সমাজে এখনো পরিবর্তন আসেনি। সমাজ থেকে মজুরি বৈষম্য দূর করার জোর দাবি জানাই।”
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী রাইজিংবিডিকে বলেন, সব ক্ষেত্রেই নারীরা অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মুখে সবাই নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। সাঁওতাল তথা আদিবাসী নারীদের সমান মজুরি পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। তারা এ দেশেরই নাগরিক। তাদের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে করা প্রয়োজন।
ঢাকা/মাসুম/রফিক