ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্ক। সার্কিট হাউসসংলগ্ন এই পার্কে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত হাজারো মানুষের কলকাকলিতে মুখর থাকে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ হাঁটাহাঁটি ও আড্ডার উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেন এই উদ্যান। শিশুদের বিনোদনের জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।

উদ্যানের এক পাশে কাচারিঘাটে দুপুর থেকে বিকেল গড়িয়ে রাত অবধি সাহিত্যজগতের মানুষেরা আড্ডায় মুখর থাকেন। আবার একঘেয়ে জীবনের অলস সময় কাটাতে অনেকে চলে আসেন এখানে।

উন্মুক্ত এই পার্কে দর্শনার্থী ও বিনোদনপ্রিয় এসব মানুষের বিনোদনের বাড়তি জোগান দিতে ভ্রাম্যমাণ হকার ছাড়াও এখানে চায়ের টং, বাদাম, ফুচকা, চটপটিসহ হালকা খাবারের জন্য ভাসমান ছোট ছোট দোকান গড়ে উঠেছে। এর সংখ্যা প্রায় ২০০।

অনেকে আছেন, যাঁরা ২০–২২ বছর ধরে এখানে এই ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কোনো কোনো দোকানে চার–পাঁচজন কর্মচারী রয়েছেন। প্রত্যেকের পরিবারসহ সব মিলিয়ে হাজারের অধিক মানুষের মুখের খাদ্যের সংস্থান হয় এখান থেকে। এসব ভ্রাম্যমাণ হকার ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার এখানে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া যে খুব সহজ, তা নয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেই তাঁদের টিকে থাকতে হয়। পুলিশি চাঁদা তো আছেই, বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি দলের নানা পর্যায়ের লোকদের নিয়মিত টাকা দিয়ে চলতে হতো।

জিনিসপত্রের চড়া মূল্যের কারণে এমনিতেই মধ্যবিত্তের জীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা, সেখানে উচ্ছেদ হওয়া কর্মহীন এসব মানুষের কী অবস্থা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুটা নিয়মনীতির মাধ্যমে মানবিক কারণে হলেও তাঁদের কর্ম করে খাওয়ার সুযোগ দিলে রাষ্ট্রের কী আর এমন ক্ষতি?

৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারবেন। কিন্তু দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের বিপদের শেষ নেই। গত ১১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সিটি করপোরেশন মিলে এসব ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী ও হকারকে উচ্ছেদ করে। এই খুদে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, উচ্ছেদের সময় তাঁদের মারধর করাসহ আসবাব ভাঙচুর করা হয়। শুধু এখানেই থেমে ছিল না। তাঁদের রিকশাভ্যান, চায়ের কেতলিসহ অন্যান্য জিনিস জব্দ করে সিটি করপোরেশন অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।

ইতিমধ্যে উচ্ছেদ হওয়া হকার ও ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা তাঁদের আসবাব ফিরিয়ে দেওয়া ও পুনরায় ব্যবসা চালু করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসনের কাছে প্রতিদিন অনুনয়–বিনয় করতে থাকেন। তাঁদের জীবন-জীবিকার কথা, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেন।

কর্মসংস্থান বন্ধ হওয়ায় অনেকের ঘরে খাবার নেই, কিস্তির টাকা নেই, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। এতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সারা না পাওয়ায় পার্কের হকার ও খুদে ব্যবসায়ীরা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ময়মনসিংহের বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন তাঁদের কর্মসূচিতে যোগ দেয়। তারাও প্রশাসনের সঙ্গে এ নিয়ে দেনদরবার করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরে যানজট নিরসন ও জয়নুল আবেদিন পার্ক এলাকার সঠিক ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত এক আলোচনা সভার উদ্যোগ নেয় জেলা প্রশাসন। সভায় সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন, ছাত্র প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সভার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মফিজুল আলম বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে পার্কের পরিবেশ ও সরকারি সম্পদ রক্ষার কথা বলে হকার উচ্ছেদের ন্যায্যতা তুলে এর পক্ষে মত দেন।

সভায় বড় রাজনৈতিক দলগুলো, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ছাত্র প্রতিনিধিদের একাংশ জেলা প্রশাসকের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদের পক্ষে মত দেন। অনেকে গরিব হকারদের জীবন-জীবিকা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যঙ্গও করতেও ভোলেননি।

সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন বাম-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ছাত্র, যুব ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা হকার উচ্ছেদ না করা, তাঁদের জীবন-জীবিকার বিষয়টি ভেবে পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসনের জন্য জন্য বলেন।

কিন্তু জেলা প্রশাসক বিষয়টি পাত্তা না দিয়ে পরোক্ষভাবে উচ্ছেদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সভা শেষ করে তড়িঘড়ি গাড়িতে ওঠেন। এ সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেওয়া প্রায় অর্ধশতাধিক হকার ডিসি ও কর্মকর্তাদের গাড়িবহর ঘিরে বিক্ষোভ করতে থাকেন। অনেকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁদের কোনো কথা না শুনে কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়েই চলে যায় বড় কর্তাদের গাড়ি।

জানা গেছে, জয়নুল আবেদিন পার্কে এই হকার ও ভ্রাম্যমাণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বছরের পর পর বছর ধরে তাঁদের জীবন-জীবিকার তাগিদে ব্যবসা করে আসছেন, যা দিয়ে হাজারো মানুষের খাওয়া–থাকার সংস্থান হয়। তাঁদের এই কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেলে তাঁরা এক মানবেতর জীবনে নিক্ষিপ্ত হবেন। বাসাভাড়া, খাবার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, ঋণের কিস্তির টাকার জোগান—সবই এখন অনিশ্চিত অন্ধকারে। ফলে চুরি ছিনতাইসহ নানা সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।

অন্যদিকে অনেকেই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে সপরিবার পার্কে ঘুরতে আসেন। ফলে এখানে চটপটি, ফুচকা, ঝালমুড়ি, বাদাম, চা, পানীয়ের চাহিদা থাকা স্বাভাবিক। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে দীর্ঘ সময় পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরাও যে বিপাকে পড়বেন, এটাও স্বাভাবিক। মানুষের ঘুরতে আসার যে আনন্দ, সেটিও কিছুটা ফিকে হয়ে আসবে নিঃসন্দেহে।

জিনিসপত্রের চড়া মূল্যের কারণে এমনিতেই মধ্যবিত্তের জীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা, সেখানে উচ্ছেদ হওয়া কর্মহীন এসব মানুষের কী অবস্থা হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছুটা নিয়মনীতির মাধ্যমে মানবিক কারণে হলেও তাঁদের কর্ম করে খাওয়ার সুযোগ দিলে রাষ্ট্রের কী আর এমন ক্ষতি?

আবুবকর সিদ্দিক রুমেল রাজনৈতিক কর্মী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র জ বন জ ব ক র জন ত ক র ব যবস ব যবস য় হক র ও র জন য র পর ব অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে

জিল হোসেনের ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে, এরপর ক্ষতিপূরণের দাবিতে তাঁর এই দীর্ঘ লড়াই। লড়াই এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মারা গেছেন জিল হোসেন।

জিল হোসেনের মৃত্যুর পর তিন বছর ধরে লড়াইটা করে যাচ্ছেন স্ত্রী ও তাঁর সন্তানেরা। কিন্তু পরিবারটির বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি।

পরিবার ও মামলার নথিতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে তিনি ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের (কৃষি) পরীক্ষার্থী ছিলেন। এই পরীক্ষা হয় ১৯৭৩ সালে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার ফলাফলে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করেন জিল হোসেন। কিন্তু সেই আবেদনে কাজ হয়নি।

১৯৭৫ সালে জিল হোসেন আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে।

সেই আইনি লড়াইয়ের শুরু। নিম্ন আদালত পেরিয়ে বছরের পর বছর উচ্চ আদালতেও ছুটেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। সংসারে স্ত্রী এবং চার ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। আইনি লড়াই নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যান জিল হোসেন। এর পর থেকে মামলায় পক্ষ হয়ে তাঁর স্ত্রীসহ উত্তরাধিকারীরা লড়াই করে যাচ্ছেন।

বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।নূর হোসেন, বাদী জিল হোসেনের ছোট ছেলে

জিল হোসেনের ছোট সন্তান নূর হোসেন গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা উচ্চ আদালতের রায় দেখে যেতে পারেননি। বাবা নেই, বুকে চাপা কষ্ট হয়। বাবার কাছে শুনেছি, মামলা চালাতে গিয়ে জমিসহ অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালির কারণে বাবার জীবন ধ্বংস হয়েছে, আমাদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।’

আরও পড়ুনশিক্ষাসনদ নিয়ে ৪৮ বছরের আইনি লড়াই: ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায় বাস্তবায়নে বাধা নেই০৮ অক্টোবর ২০২৩

নূর হোসেন আরও বলেন, ‘মা এবং ভাইবোনেরা এখন মামলা চালাচ্ছি। মায়ের বয়স ৬৯ বছর। তিনিও নানা রোগে ভুগছেন। তিনিও চূড়ান্ত রায় দেখে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। বাবা মারা যাওয়ার পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো অনুশোচনা নেই, এটা কষ্টের।’

আইনি লড়াই

জিল হোসেন যখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (কৃষি) দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরোনো পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। ময়মনসিংহের মুনসেফ আদালতে করা মামলায় জয়ী হন তিনি। আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

তবে জিল হোসেনের লড়াই তখনো বাকি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে যায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়েও জিল হোসেনের বহিষ্কারাদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুনসেবাদাতা বা গ্রহীতাদের সন্তুষ্টির মূল্যায়ন হয়নি২৮ এপ্রিল ২০২২

এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এ রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।

অতঃপর সনদ, ক্ষতিপূরণ মামলা

পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেওয়া হয়। তখন জিল হোসেনের বয়স ৪৭ বছর। তখন তাঁর সরকারি চাকরির বয়সসীমা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।

লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টর স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।চঞ্চল কুমার বিশ্বাস, বাদীপক্ষের আইনজীবী

এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। মামলায় অভিযোগ করেন, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে সরকারি চাকরির সম্ভাবনাও।

ক্ষতিপূরণের এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২ কোটি টাকা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

১৪ বছর পর নিষ্পত্তি

বিচারিক আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্ত সাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ স্থগিত করেন। শর্ত হিসেবে ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা ৩ মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলেও ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান, জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০২২ সালে ৪ নভেম্বর ওই অর্থ জমা দেয়।

বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী

বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল খারিজ করে ২০২৩ সালের ৭ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায় সংশোধন সাপেক্ষে বহাল রাখেন হাইকোর্ট। রায়ের দিন থেকে ওই অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তারা (জিল হোসেনের পরিবার) লভ্যাংশ পাবেন বলেও জানানো হয়। অবশ্য এর আগে শর্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জমা করা ২৫ লাখ টাকা ওই অর্থ থেকে বাদ যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভ টু আপিল

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে লিভ টু আপিল করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনটি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। শুনানি নিয়ে সেদিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করে দেন। লিভ টু আপিল ক্রম অনুসারে শুনানি হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের গত ৩১ আগস্টের কার্যতালিকায় ৫০৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।

জিল হোসেনের পরিবারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি পরিচালনার জন্য ২০২৩ সালের ৯ মার্চ আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস নিয়োগ পান। তাঁকে নিয়োগ দেয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতে অর্থ আদায়ে জারি মামলার (২০০৯ সালে করা) কার্যক্রম অগ্রসরের জন্য বাদীর উত্তারাধিকারীকারেরা আবেদন করেন।

আরও পড়ুনসনদ ও ক্ষতিপূরণের জন্য ৪৭ বছরের আইনি লড়াই ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

চঞ্চল কুমার বিশ্বাস বলেন, লিভ টু আপিল বিচারাধীন উল্লেখ করে একের পর এক সময় নিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকায় মামলা চলতে আইনগত বাধা নেই। অথচ মামলাটি চলছে না, যা জিল হোসেনের পরিবারের জন্য ভোগান্তির।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নিয়োগ দেওয়া জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। বিচারাধীন থাকলে নিম্ন আদালতে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তও আছে। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।’

আরও পড়ুন৩৩ বছর কেটে গেছে, কাজল কথা রেখেছেন০৫ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজীপুরে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের মহাসড়ক অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ
  • ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ 
  • জিল হোসেন মারা গেছেন, আদালতে তাঁর লড়াই শেষ হবে কবে
  • ময়মনসিংহে সিলিন্ডার লিকেজে হোটেলে অগ্নিকাণ্ড 
  • অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, পাহাড় ধসের শঙ্কা