Samakal:
2025-06-15@23:42:28 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

Published: 9th, February 2025 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

আমার ছোট ভাই, যার নাম সদ্য সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। ৫ আগস্ট ২০২৪, ততক্ষণে সরকারের পতন হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় পুলিশের গুলিতে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে সদ্য। তার স্মৃতি প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বুকে অজস্র কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সেই প্রাণহীন বাড়িটা শুধু তার স্মৃতিতে ভেসে থাকে। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব যেন আমাদের শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে। যদিও প্রায় ছয় মাস হতে চলল।

সম্পর্কের বিচারে আমার ফুফাতো ভাই। আমি তাদের বাসাতেই আমার ফুফুর হাতে বড় হয়েছি। আজ মনে হয়, সদ্যকে পড়াশোনা নিয়ে এত বকাঝকা না করলেই ভালো হতো। কী করব, সে তো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে আমাদের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। স্বপ্ন ছিল, সেরাদের সেরা হবে। এখন আমাদের দিন শুরু হয় চোখের পানিতে। অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে বা অফিসের ডেস্কে বসে। ঘরে কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদে, কেউ বিছানায় শুয়ে, কেউ খেতে বসে। আমরা কেউ কারও কাছে প্রশ্ন করি না– কারণটা সবাই জানি। সেই সদ্য, যে আমাদের ঘর আলো  করে জন্মেছিল, যে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠছিল। সে আজ কোথাও নেই। এটি কীভাবে সম্ভব!

রাস্তাঘাটে ফুডপান্ডার লোগো দেখলেই চোখ ভিজে যায়। ফুফা সদ্যকে ফুডপান্ডার কথা বলে ক্ষ্যাপাতেন। সে হেসে হেসে আরও বায়না করত। তোমার শরীরটা কতটা নরম আর তুলতুলে ছিল, তা ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় দৌড়ানোর সময় আমার নখ লেগে গিয়েছিল ওর পেটে, এতেই চামড়ায় ক্ষত হয়। আজ মনে হয়, হয়তো সেই নরম শরীরটাই বুলেটকে এত সহজে ভেতরে টেনে নিয়েছিল।

সদ্য কি জানে ওর অনুপস্থিতিতে মায়ের দিনগুলো কীভাবে কাটছে? এখন আর তাঁর কোনো ব্যস্ততা নেই। কোন শিক্ষক কখন আসবে, ওর পড়া তৈরি হয়েছে কিনা– এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই। দুপুরে রান্নার তাড়াও নেই। স্যারের জন্য সব গুছিয়ে রাখতে হবে না যে! মায়ের সেই ছুটোছুটির জীবনটা এখন থেমে গেছে। এই থামার নাম তো জীবন নয়।

ওর প্রিয় খাবারগুলো দেখলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। শুকনা পাটশাক, পালং ডাল আর গরুর মাংস পেলে সদ্য যে কত খুশি হতো! বাসায় ঢুকেই ‘মা, মা’ বলে চিৎকার করত। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে সারাদিনের গল্প বলত– স্কুলে কী কী হলো, স্যার কী বললেন, সানিম, শ্রেয়াস, ফাইজা এমনকি ফাইজার মা কী বললেন সব.

..। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতেও যেন ওর গল্প শেষ হতো না। আজ সে টেবিলে বসে কারও মুখে কোনো কথা নেই।

ছোটবেলায় সদ্য ‘দিনরাত’ বলতে পারত না, বলত ‘রোদের দিনে, রাতের দিনে’। ভাত খেতে বসে আধো আধো বুলিতে বলত, ‘সাদা ভাত আর গোল ডিম দাও।’ ওকে নিয়ে আমার কেন জানি না, ছোটবেলার কথাগুলোই বেশি মনে পড়ে। সদ্য খালাকে ডাকত ‘আম্মনি’, যেন নামেই সব ভালোবাসা। হিলটন ভাই ছিল ওর ‘বন্ধু’, মেজো মামা আর মামির দুষ্টুমি ওর কাছে ‘দুষ্টু মামা’ আর ‘দুষ্টু মামি’ হয়ে উঠেছিল। রাজ্য ছিল ‘সুন্দর আব্বা’ আর আমার ছেলেকে ডাকত ‘পাণ্ডু মামু’। সেই ডাকগুলো ছিল এত বিশেষ! এসব নামে তাদের আর কেউ ডাকবে না। 

আর আমাকে? আমাকে ডাকত ‘বড় আপি’। সেই ডাকের সুরটা যেন এখনও কানে বাজে। সেই ডাক আর কখনও শোনা হবে না– এ ভাবনাই বুকের ভেতর এক দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে গেছে।

পছন্দের ‘কুংফু পান্ডা’ সিনেমা যে সদ্য কতবার দেখেছে, তার কোনো হিসাব নেই। দেখার সময় হা হা করে এত হাসত যে, ওর শরীরের থুলথুলে মাংসগুলো ঝাঁকিয়ে উঠত। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। 

সাদা ভাতের প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল বলে ওর মা এখনও কান্না থামাতে পারে না। মৃত্যুর পর বারবার বলতে থাকে, ‘‘আমি আর কখনও ভাত খাব না। তোমরা আর কখনও আমাকে ভাত সাধবে না। আমার ছেলে বলত, ‘মা, এই কয়টা ভাত খাব আমি! আমাকে আরও ভাত দাও।’ আমার ছেলে যদি এক বেলা একটু কম খেত, পরের বেলা আমি বেশি করে দিতাম।’’

ওর স্বাস্থ্য একটু বেড়ে যাচ্ছিল, তাই ওর মা ভাত একটু কমিয়ে দিত। এখন মনে হয়, যদি জানত, সময় এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তাহলে হয়তো কিছুই কমিয়ে দিত না। 

তিশমা হঠাৎ হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে। টিভির রিমোট নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয় না বলেই হয়তো তার এই কান্না। সদ্য আর তিশমা, দুই ভাইবোন। দু’জনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত বন্ধন– একদিকে খুনসুটি আর অন্যদিকে নিঃশর্ত টান। তিশমা কথা বলতে পারে না বলে তার প্রতি টানটা যেন আরও গভীর ছিল, আরও দায়িত্ববোধে ভরা। সদ্যই ছিল তিশমার নিঃশব্দ ভাষার শ্রোতা, তার আনন্দের সঙ্গী। তার নীরব কান্নার সান্ত্বনা।

৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল দেশের ইতিহাসের একটি অদ্ভুত মুহূর্ত, যখন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনগণের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে গিয়েছিল এবং দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিন। সরকারের নির্দেশে এতদিন যে পুলিশ বাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালিয়েছে, সরকারের পতনের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে। সাভারে ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বিনা অপরাধে আমাদের প্রিয় ভাই সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। যে কিনা শুধু মানুষের ঢল আর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাস্তার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন আমরা একদিকে দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় দেখেছি, অন্যদিকে হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনকে। সদ্যর নিথর দেহ নিয়ে যাওয়ার আগে যখন ওকে শেষবারের মতো দেখার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছিল, সেই মুহূর্তটি জীবনের সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হয়ে থাকবে। ওর মা গায়ে হাত রাখার সাহসটুকুও জোগাড় করতে পারল না। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনবার ওর শরীরের ওপর দিয়ে আদরের ভঙ্গি করল, যেন সদ্যকে শেষবার ছুঁয়ে না দেখলেও নিজের সব ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাতে পারল। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেই মা, বাবা কিংবা বোনের অনুভূতি অনুভব করা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র আম র ছ র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’

এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।    

আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা। 

আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।    

আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।

আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।

এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।

এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।

বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।

লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
  • বর্ষার শুরুতেই সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির বার্তা
  • টানা সাত দিন সারাদেশে বৃষ্টি ঝরবে
  • অর্ধশত বছরের চামড়ার মোকাম রাজারহাট
  • সিদ্ধিরগঞ্জে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সোর্স ইকবালের ডাকাতি