Samakal:
2025-11-03@13:34:14 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

Published: 9th, February 2025 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

আমার ছোট ভাই, যার নাম সদ্য সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। ৫ আগস্ট ২০২৪, ততক্ষণে সরকারের পতন হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় পুলিশের গুলিতে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে সদ্য। তার স্মৃতি প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বুকে অজস্র কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সেই প্রাণহীন বাড়িটা শুধু তার স্মৃতিতে ভেসে থাকে। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব যেন আমাদের শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে। যদিও প্রায় ছয় মাস হতে চলল।

সম্পর্কের বিচারে আমার ফুফাতো ভাই। আমি তাদের বাসাতেই আমার ফুফুর হাতে বড় হয়েছি। আজ মনে হয়, সদ্যকে পড়াশোনা নিয়ে এত বকাঝকা না করলেই ভালো হতো। কী করব, সে তো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে আমাদের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। স্বপ্ন ছিল, সেরাদের সেরা হবে। এখন আমাদের দিন শুরু হয় চোখের পানিতে। অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে বা অফিসের ডেস্কে বসে। ঘরে কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদে, কেউ বিছানায় শুয়ে, কেউ খেতে বসে। আমরা কেউ কারও কাছে প্রশ্ন করি না– কারণটা সবাই জানি। সেই সদ্য, যে আমাদের ঘর আলো  করে জন্মেছিল, যে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠছিল। সে আজ কোথাও নেই। এটি কীভাবে সম্ভব!

রাস্তাঘাটে ফুডপান্ডার লোগো দেখলেই চোখ ভিজে যায়। ফুফা সদ্যকে ফুডপান্ডার কথা বলে ক্ষ্যাপাতেন। সে হেসে হেসে আরও বায়না করত। তোমার শরীরটা কতটা নরম আর তুলতুলে ছিল, তা ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় দৌড়ানোর সময় আমার নখ লেগে গিয়েছিল ওর পেটে, এতেই চামড়ায় ক্ষত হয়। আজ মনে হয়, হয়তো সেই নরম শরীরটাই বুলেটকে এত সহজে ভেতরে টেনে নিয়েছিল।

সদ্য কি জানে ওর অনুপস্থিতিতে মায়ের দিনগুলো কীভাবে কাটছে? এখন আর তাঁর কোনো ব্যস্ততা নেই। কোন শিক্ষক কখন আসবে, ওর পড়া তৈরি হয়েছে কিনা– এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই। দুপুরে রান্নার তাড়াও নেই। স্যারের জন্য সব গুছিয়ে রাখতে হবে না যে! মায়ের সেই ছুটোছুটির জীবনটা এখন থেমে গেছে। এই থামার নাম তো জীবন নয়।

ওর প্রিয় খাবারগুলো দেখলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। শুকনা পাটশাক, পালং ডাল আর গরুর মাংস পেলে সদ্য যে কত খুশি হতো! বাসায় ঢুকেই ‘মা, মা’ বলে চিৎকার করত। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে সারাদিনের গল্প বলত– স্কুলে কী কী হলো, স্যার কী বললেন, সানিম, শ্রেয়াস, ফাইজা এমনকি ফাইজার মা কী বললেন সব.

..। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতেও যেন ওর গল্প শেষ হতো না। আজ সে টেবিলে বসে কারও মুখে কোনো কথা নেই।

ছোটবেলায় সদ্য ‘দিনরাত’ বলতে পারত না, বলত ‘রোদের দিনে, রাতের দিনে’। ভাত খেতে বসে আধো আধো বুলিতে বলত, ‘সাদা ভাত আর গোল ডিম দাও।’ ওকে নিয়ে আমার কেন জানি না, ছোটবেলার কথাগুলোই বেশি মনে পড়ে। সদ্য খালাকে ডাকত ‘আম্মনি’, যেন নামেই সব ভালোবাসা। হিলটন ভাই ছিল ওর ‘বন্ধু’, মেজো মামা আর মামির দুষ্টুমি ওর কাছে ‘দুষ্টু মামা’ আর ‘দুষ্টু মামি’ হয়ে উঠেছিল। রাজ্য ছিল ‘সুন্দর আব্বা’ আর আমার ছেলেকে ডাকত ‘পাণ্ডু মামু’। সেই ডাকগুলো ছিল এত বিশেষ! এসব নামে তাদের আর কেউ ডাকবে না। 

আর আমাকে? আমাকে ডাকত ‘বড় আপি’। সেই ডাকের সুরটা যেন এখনও কানে বাজে। সেই ডাক আর কখনও শোনা হবে না– এ ভাবনাই বুকের ভেতর এক দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে গেছে।

পছন্দের ‘কুংফু পান্ডা’ সিনেমা যে সদ্য কতবার দেখেছে, তার কোনো হিসাব নেই। দেখার সময় হা হা করে এত হাসত যে, ওর শরীরের থুলথুলে মাংসগুলো ঝাঁকিয়ে উঠত। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। 

সাদা ভাতের প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল বলে ওর মা এখনও কান্না থামাতে পারে না। মৃত্যুর পর বারবার বলতে থাকে, ‘‘আমি আর কখনও ভাত খাব না। তোমরা আর কখনও আমাকে ভাত সাধবে না। আমার ছেলে বলত, ‘মা, এই কয়টা ভাত খাব আমি! আমাকে আরও ভাত দাও।’ আমার ছেলে যদি এক বেলা একটু কম খেত, পরের বেলা আমি বেশি করে দিতাম।’’

ওর স্বাস্থ্য একটু বেড়ে যাচ্ছিল, তাই ওর মা ভাত একটু কমিয়ে দিত। এখন মনে হয়, যদি জানত, সময় এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তাহলে হয়তো কিছুই কমিয়ে দিত না। 

তিশমা হঠাৎ হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে। টিভির রিমোট নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয় না বলেই হয়তো তার এই কান্না। সদ্য আর তিশমা, দুই ভাইবোন। দু’জনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত বন্ধন– একদিকে খুনসুটি আর অন্যদিকে নিঃশর্ত টান। তিশমা কথা বলতে পারে না বলে তার প্রতি টানটা যেন আরও গভীর ছিল, আরও দায়িত্ববোধে ভরা। সদ্যই ছিল তিশমার নিঃশব্দ ভাষার শ্রোতা, তার আনন্দের সঙ্গী। তার নীরব কান্নার সান্ত্বনা।

৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল দেশের ইতিহাসের একটি অদ্ভুত মুহূর্ত, যখন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনগণের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে গিয়েছিল এবং দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিন। সরকারের নির্দেশে এতদিন যে পুলিশ বাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালিয়েছে, সরকারের পতনের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে। সাভারে ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বিনা অপরাধে আমাদের প্রিয় ভাই সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। যে কিনা শুধু মানুষের ঢল আর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাস্তার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন আমরা একদিকে দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় দেখেছি, অন্যদিকে হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনকে। সদ্যর নিথর দেহ নিয়ে যাওয়ার আগে যখন ওকে শেষবারের মতো দেখার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছিল, সেই মুহূর্তটি জীবনের সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হয়ে থাকবে। ওর মা গায়ে হাত রাখার সাহসটুকুও জোগাড় করতে পারল না। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনবার ওর শরীরের ওপর দিয়ে আদরের ভঙ্গি করল, যেন সদ্যকে শেষবার ছুঁয়ে না দেখলেও নিজের সব ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাতে পারল। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেই মা, বাবা কিংবা বোনের অনুভূতি অনুভব করা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র আম র ছ র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত

বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ। 

সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।

আরো পড়ুন:

একা বাস করতে পারে যে পাখি

কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?

সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।

তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না। 

এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস। 

তিনি জানেন,  প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে।  বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।

সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন। 

একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।

সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।

চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।

গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কারা বেশি কাঁদেন? 
  • বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
  • প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত