Samakal:
2025-05-01@05:39:05 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

Published: 9th, February 2025 GMT

ভাই হারানোর ছয় মাস

আমার ছোট ভাই, যার নাম সদ্য সাভার ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত। ৫ আগস্ট ২০২৪, ততক্ষণে সরকারের পতন হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে ৫টায় পুলিশের গুলিতে আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছে সদ্য। তার স্মৃতি প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বুকে অজস্র কাঁটার মতো বিঁধে থাকে। সেই প্রাণহীন বাড়িটা শুধু তার স্মৃতিতে ভেসে থাকে। প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মুহূর্তে তার অভাব যেন আমাদের শ্বাস নেওয়া কঠিন করে তোলে। যদিও প্রায় ছয় মাস হতে চলল।

সম্পর্কের বিচারে আমার ফুফাতো ভাই। আমি তাদের বাসাতেই আমার ফুফুর হাতে বড় হয়েছি। আজ মনে হয়, সদ্যকে পড়াশোনা নিয়ে এত বকাঝকা না করলেই ভালো হতো। কী করব, সে তো ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে আমাদের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। স্বপ্ন ছিল, সেরাদের সেরা হবে। এখন আমাদের দিন শুরু হয় চোখের পানিতে। অফিসে যাওয়ার পথে বাসে বসে বা অফিসের ডেস্কে বসে। ঘরে কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদে, কেউ বিছানায় শুয়ে, কেউ খেতে বসে। আমরা কেউ কারও কাছে প্রশ্ন করি না– কারণটা সবাই জানি। সেই সদ্য, যে আমাদের ঘর আলো  করে জন্মেছিল, যে প্রতিদিন আমাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠছিল। সে আজ কোথাও নেই। এটি কীভাবে সম্ভব!

রাস্তাঘাটে ফুডপান্ডার লোগো দেখলেই চোখ ভিজে যায়। ফুফা সদ্যকে ফুডপান্ডার কথা বলে ক্ষ্যাপাতেন। সে হেসে হেসে আরও বায়না করত। তোমার শরীরটা কতটা নরম আর তুলতুলে ছিল, তা ভাবলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে, ছোটবেলায় দৌড়ানোর সময় আমার নখ লেগে গিয়েছিল ওর পেটে, এতেই চামড়ায় ক্ষত হয়। আজ মনে হয়, হয়তো সেই নরম শরীরটাই বুলেটকে এত সহজে ভেতরে টেনে নিয়েছিল।

সদ্য কি জানে ওর অনুপস্থিতিতে মায়ের দিনগুলো কীভাবে কাটছে? এখন আর তাঁর কোনো ব্যস্ততা নেই। কোন শিক্ষক কখন আসবে, ওর পড়া তৈরি হয়েছে কিনা– এসব নিয়ে চিন্তা করার কিছুই নেই। দুপুরে রান্নার তাড়াও নেই। স্যারের জন্য সব গুছিয়ে রাখতে হবে না যে! মায়ের সেই ছুটোছুটির জীবনটা এখন থেমে গেছে। এই থামার নাম তো জীবন নয়।

ওর প্রিয় খাবারগুলো দেখলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। শুকনা পাটশাক, পালং ডাল আর গরুর মাংস পেলে সদ্য যে কত খুশি হতো! বাসায় ঢুকেই ‘মা, মা’ বলে চিৎকার করত। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে সারাদিনের গল্প বলত– স্কুলে কী কী হলো, স্যার কী বললেন, সানিম, শ্রেয়াস, ফাইজা এমনকি ফাইজার মা কী বললেন সব.

..। ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে খেতেও যেন ওর গল্প শেষ হতো না। আজ সে টেবিলে বসে কারও মুখে কোনো কথা নেই।

ছোটবেলায় সদ্য ‘দিনরাত’ বলতে পারত না, বলত ‘রোদের দিনে, রাতের দিনে’। ভাত খেতে বসে আধো আধো বুলিতে বলত, ‘সাদা ভাত আর গোল ডিম দাও।’ ওকে নিয়ে আমার কেন জানি না, ছোটবেলার কথাগুলোই বেশি মনে পড়ে। সদ্য খালাকে ডাকত ‘আম্মনি’, যেন নামেই সব ভালোবাসা। হিলটন ভাই ছিল ওর ‘বন্ধু’, মেজো মামা আর মামির দুষ্টুমি ওর কাছে ‘দুষ্টু মামা’ আর ‘দুষ্টু মামি’ হয়ে উঠেছিল। রাজ্য ছিল ‘সুন্দর আব্বা’ আর আমার ছেলেকে ডাকত ‘পাণ্ডু মামু’। সেই ডাকগুলো ছিল এত বিশেষ! এসব নামে তাদের আর কেউ ডাকবে না। 

আর আমাকে? আমাকে ডাকত ‘বড় আপি’। সেই ডাকের সুরটা যেন এখনও কানে বাজে। সেই ডাক আর কখনও শোনা হবে না– এ ভাবনাই বুকের ভেতর এক দগদগে ক্ষত হয়ে থেকে গেছে।

পছন্দের ‘কুংফু পান্ডা’ সিনেমা যে সদ্য কতবার দেখেছে, তার কোনো হিসাব নেই। দেখার সময় হা হা করে এত হাসত যে, ওর শরীরের থুলথুলে মাংসগুলো ঝাঁকিয়ে উঠত। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। 

সাদা ভাতের প্রতি ওর ভালো লাগা ছিল বলে ওর মা এখনও কান্না থামাতে পারে না। মৃত্যুর পর বারবার বলতে থাকে, ‘‘আমি আর কখনও ভাত খাব না। তোমরা আর কখনও আমাকে ভাত সাধবে না। আমার ছেলে বলত, ‘মা, এই কয়টা ভাত খাব আমি! আমাকে আরও ভাত দাও।’ আমার ছেলে যদি এক বেলা একটু কম খেত, পরের বেলা আমি বেশি করে দিতাম।’’

ওর স্বাস্থ্য একটু বেড়ে যাচ্ছিল, তাই ওর মা ভাত একটু কমিয়ে দিত। এখন মনে হয়, যদি জানত, সময় এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তাহলে হয়তো কিছুই কমিয়ে দিত না। 

তিশমা হঠাৎ হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ওঠে। টিভির রিমোট নিয়ে ওর সঙ্গে ঝগড়া হয় না বলেই হয়তো তার এই কান্না। সদ্য আর তিশমা, দুই ভাইবোন। দু’জনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত বন্ধন– একদিকে খুনসুটি আর অন্যদিকে নিঃশর্ত টান। তিশমা কথা বলতে পারে না বলে তার প্রতি টানটা যেন আরও গভীর ছিল, আরও দায়িত্ববোধে ভরা। সদ্যই ছিল তিশমার নিঃশব্দ ভাষার শ্রোতা, তার আনন্দের সঙ্গী। তার নীরব কান্নার সান্ত্বনা।

৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল দেশের ইতিহাসের একটি অদ্ভুত মুহূর্ত, যখন বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনগণের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে গিয়েছিল এবং দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির দিন। সরকারের নির্দেশে এতদিন যে পুলিশ বাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালিয়েছে, সরকারের পতনের পর তারা বিভিন্ন জায়গায় আটকা পড়ে। সাভারে ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে বিনা অপরাধে আমাদের প্রিয় ভাই সেদিন প্রাণ হারিয়েছিল। যে কিনা শুধু মানুষের ঢল আর বিজয় মিছিলে গিয়ে রাস্তার পাশে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন আমরা একদিকে দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় দেখেছি, অন্যদিকে হারিয়েছি আমাদের প্রিয়জনকে। সদ্যর নিথর দেহ নিয়ে যাওয়ার আগে যখন ওকে শেষবারের মতো দেখার জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছিল, সেই মুহূর্তটি জীবনের সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হয়ে থাকবে। ওর মা গায়ে হাত রাখার সাহসটুকুও জোগাড় করতে পারল না। কাঁপা কাঁপা হাতে তিনবার ওর শরীরের ওপর দিয়ে আদরের ভঙ্গি করল, যেন সদ্যকে শেষবার ছুঁয়ে না দেখলেও নিজের সব ভালোবাসা দিয়ে বিদায় জানাতে পারল। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় সেই মা, বাবা কিংবা বোনের অনুভূতি অনুভব করা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র আম র ছ র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

গান নিয়েই আমার সব ভাবনা

কর্নিয়া। তারকা কণ্ঠশিল্পী। অনলাইনে প্রকাশ পাচ্ছে বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া তাঁর দ্বৈত গান ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’। এ আয়োজন ও অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা হয় তাঁর সঙ্গে–

‘ভাঙা ঘর’ ও ‘আদর’-এর পর প্রকাশ পাচ্ছে ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’। একনাগাড়ে দ্বৈত গান গেয়ে যাচ্ছেন, কারণ কী? 

শ্রোতাদের চাওয়া আর নিজের ভালো লাগা থেকেই দ্বৈত গান গাওয়া, এর বাইরে আলাদা কোনো কারণ নেই। কারণ, সব সময় ভাবনায় এটাই থাকে, যে কাজটি করছি, তা শ্রোতার প্রত্যাশা পূরণ করবে কিনা। সেটি একক, না দ্বৈত গান– তা নিয়ে খুব একটা ভাবি না। তা ছাড়া রুবেল খন্দকারের সঙ্গে গাওয়া ‘ভাঙা ঘর’ ও অশোক সিংয়ের সঙ্গে গাওয়া ‘আদর’ গান দুটি যেমন ভিন্ন ধরনের, তেমনি বেলাল খানের সঙ্গে গাওয়া ‘তুমি ছাড়া নেই আলো’ অনেকটা আলাদা। আসল কথা হলো, যা কিছু করি, তার পেছনে শ্রোতার ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। 

দ্বৈত গানের সহশিল্পী হিসেবে নতুনদের প্রাধান্য দেওয়ার কারণ?

সহশিল্পীর কণ্ঠ ও গায়কি যদি শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ার মতো হয়, তাহলে সে তরুণ, নাকি তারকা– তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন পড়ে না। এমন তো নয় যে, নতুন শিল্পীরা ভালো গাইতে পারে না। তা ছাড়া তারকা শিল্পী ছাড়া দ্বৈত গান গাইব না– এই কথাও কখনও বলিনি। তাই দ্বৈত গানে তারকাদের পাশাপাশি নতুনদের সহশিল্পী হিসেবে বেছে নিতে কখনও আপত্তি করিনি। 

প্রতিটি আয়োজনে নিজেকে নতুন রূপে তুলে ধরার যে চেষ্টা, তা কি ভার্সেটাইল শিল্পী প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য? 

হ্যাঁ, শুরু থেকেই ভার্সেটাইল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি গড়ে তুলতে চেয়েছি। এ কারণে কখনও টেকনো, কখনও হার্ডরক, আবার কখনও ফোক ফিউশনের মতো মেলোডি গান কণ্ঠে তুলেছি। গায়কির মধ্য দিয়ে নিজেকে বারবার ভাঙার চেষ্টা করছি। সব সময়ই নিরীক্ষাধর্মী গান করতে ভালো লাগে। একই ধরনের কাজ বারবার করতে চাই না বলেই নানা ধরনের গান করছি। নিজেকে ভেঙে সব সময়ই নতুনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা জারি রাখছি।

প্রযোজক হিসেবে নিজের চ্যানেলের জন্য নতুন কী আয়োজন করছেন? 

আয়োজন থেমে নেই। তবে কবে নতুন গান প্রকাশ করব– তা এখনই বলতে পারছি না। কারণ একটাই, অন্যান্য কাজের মতো গান তো ঘড়ি ধরে কিংবা সময় বেঁধে তৈরি করা যায় না। একেকটি গানের পেছনে অনেক সময় দিতে হয়। কোনো কোনো গানের কথা-সুর-সংগীতের কাটাছেঁড়া চলে দিনের পর দিন। এরপর যখন তা সময়োপযোগী হয়েছে বলে মনে হয়, তাখনই প্রকাশ করি। 

গান গাওয়ার পাশাপাশি মডেলিং বা অভিনয় করার ইচ্ছা আছে? 

সত্যি এটাই, গান নিয়েই আমার সব ভাবনা। তারপরও অনেকের অনুরোধে কয়েকটি পত্রিকার ফ্যাশন পাতার জন্য মডেল হিসেবে কাজ করেছি। তবে মডেল হব– এমন ইচ্ছা নিয়ে কাজ করিনি। অভিনয় নিয়েও কিছু ভাবি না। অন্য কোনো পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই না।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চিনি-লবণের অনুপম পাঠ
  • শততম ম্যাচটি স্মরণীয় করে রাখতে চান ইয়ামাল
  • নির্মাতার ঘোষণার অপেক্ষায় চিত্রাঙ্গদা
  • শিশুর মাথা ঘামে কেন
  • কাঠফাটা রোদ্দুরে তপ্ত হাওয়া
  • গান নিয়েই আমার সব ভাবনা