বাংলাদেশে মুদ্রানীতি কতটা কাজ করে?
Published: 15th, February 2025 GMT
গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁর মেয়াদের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ঘটনাক্রমে বর্তমান অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গভর্নর থাকাকালীনই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা শুরু করে। সেই থেকে পরিস্থিতি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি কখনও সংকোচনমূলক, কখনও সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে আসছে। গভর্নর আতিউর রহমান চালু করেছিলেন জোড়াতালির সংস্থানমূলক মুদ্রানীতি। বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে মুদ্রানীতি এখনও নামকাওয়াস্তে রয়ে গেছে, পরিণত হয়েছে রুটিন ওয়ার্কে। এবারের ঘোষিত মুদ্রানীতিও ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হচ্ছে না।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। সম্প্রতি ঘোষিত দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতিতেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা একই রাখা হয়েছে। অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিদ্যমান ১০ শতাংশ নীতি সুদহার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ নীতি সুদহার ধরে রাখার পেছনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের। যদিও এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন, এভাবে উচ্চ সুদহার বিদ্যমান থাকা অবস্থায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির সুযোগ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখার মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতির হার আগামী জুন শেষে ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যপূরণের অংশ হিসেবে কঠোর মুদ্রানীতি বজায় রাখা হয়েছে; যাতে সম্পদ হিসেবে টাকার মূল্যমান আকর্ষণীয় থাকে, বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং মূল্যস্ফীতির চাপ কমে আসে। সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে সুদহার ও তারল্য সরবরাহে প্রয়োজনীয় সমন্বয় হবে বলে মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যদিও এ সময়ে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছিল। যেটি গত আগস্ট থেকে তিন দফায় বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেসব দেশ নীতি সুদহার বাড়িয়েছে, গেল কয়েক মাস ধরে সবাই আবার নীতি সুদহার কমানোর দিকে হাঁটছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৪ শতাংশে নিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে।
আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য অস্ত্র সমন্বিতভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম আরেক দফা বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। রমজানকে কেন্দ্র করে অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া না। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে মুদ্রানীতিতে ব্যক্ত প্রত্যাশা কতটুকু বাস্তবসম্মত?
নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে এরই মধ্যে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে ১৫-১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিনিয়োগের সামগ্রিক পরিবেশও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির জন্য অনুকূল নয়। আমাদের শিল্প খাতের উৎপাদন অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। আমদানি কিছুটা বাড়লেও সেখানে উৎপাদনের সূচকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা সামনে বাড়ার কী গ্যারান্টি আছে? ফলে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রেখে মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হলেই যে বাস্তবে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা বাড়বে তা নয়। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত ছিল ব্যাংক খাতের দুর্বলতাগুলো দূর করতে ও দক্ষতা বাড়াতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া। তাহলে খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারত এবং সুদহারও কমানো সম্ভব হতো।
নীতি সুদহারের পাশাপাশি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে বিশেষ রেপো বা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটির (এসএলএফ) ঊর্ধ্বসীমা ও সুদহার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ)। বর্তমানে এসএলএফ ও এসডিএফের সুদহার যথাক্রমে ১১ দশমিক ৫ ও ৮ দশমিক ৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে নীতি সুদহারের করিডোর রাখা হয়েছে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট।
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। নীতি সুদহার ও সুদহার করিডোরের মধ্যে তারল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যাপক মুদ্রার এ প্রবৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা করা হবে। প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশ ধরা হলে এ ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে রিজার্ভ মুদ্রার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ শতাংশ।
আমি মনে করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের মানসিকতা থেকে এখনও বের হতে পারেনি। বরং বিভিন্ন অজুহাত বের করে মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রণটা কীভাবে তাদের হাতে রেখে দেবে সেটির চেষ্টা করে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। এর আগে প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এ লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হলেও এ সময়ে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের মতোই ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে।
অনেকের সঙ্গে আমিও একমত, বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার কোনোই সম্ভাবনা নেই। এটি আগামীতে আরও কমতে পারে। ব্যক্তি খাতের ঋণ বৃদ্ধি সহায়ক কিছু মুদ্রানীতিতে নেই। যেসব প্যারামিটারের কারণে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, সেই প্যারামিটারের মধ্যে শুধু সুদহার বাড়িয়ে এটিকে বিবেচনায় নেওয়া সম্ভব না। এটি মূলত পণ্য সরবরাহের বিষয় এবং সেখানেই সরকারের ব্যর্থতা। কারণ চাঁদাবাজিটা হচ্ছে। তার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিছু জায়গায় ভ্যাটও বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও কোনো সুসংবাদ নেই। এমনিতেই শিল্প-কারখানাগুলো বিভিন্ন কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। এর মধ্যে যদি এসব প্যারামিটার সামনে আসে, তখন বিনিয়োগ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ ছাড়া সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
সবাই জানি, কয়েক যুগ ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে বেসরকারি খাত। শিল্পের উৎপাদন, বিপণন কিংবা সেবা খাতের সিংহভাগই বেসরকারি খাতনির্ভর। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে খাতটিকে ঋণবঞ্চিত করা হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি না কমে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
সোজা কথায়– বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমলে বিনিয়োগ কমবে, কর্মসংস্থান হুমকিতে পড়বে। মুদ্রানীতিতে ঘোষিত আশাবাদ ভালো মানুষের আকাঙ্ক্ষাই থেকে যাবে। বাজারে খুব একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রথম র ধ র ম দ র ন ত ত পর স থ ত ৯ দশম ক র প রথম ব সরক র দশম ক ৮ ৭ দশম ক হয় ছ ল এ সময় ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে বিদেশি ঋণ শোধ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়াল
চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই–মার্চ) বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ৩২১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের পুরো সময়ের প্রায় সমান। গত অর্থবছরে (২০২৩–২৪) মোট ৩৩৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে। এর মানে হলো, এবার প্রথম ৯ মাসেই গত অর্থবছরের কাছাকাছি ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে।
আজ বুধবার বিকেলে প্রকাশিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তৈরি জুলাই–মার্চ মাসের বিদেশি ঋণ পরিস্থিতির হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধের এই তথ্য পাওয়া গেছে।
ইআরডির তথ্য অনুসারে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই–মার্চ) দেশে মোট প্রায় ৪৮১ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বিদেশি ঋণ এসেছে। এ সময়ে ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয়েছে অর্থছাড়ের প্রায় দুই–তৃতীয়াংশের সমান।
অন্যদিকে আলোচ্য ৯ মাসে বিদেশি ঋণ বাবদ পরিশোধের মধ্যে আসলের পরিমাণ ২০১ কোটি ডলার। আর সুদ বাবদ ১২০ কোটি ডলার পরিশোধ হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ২৫৭ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছিল। এক বছরের ব্যবধানে ৬৪ কোটি ডলার বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।
এদিকে গত জুলাই–মার্চ সময়ে ৩০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ, যা গতবারের একই সময়ে পাওয়া প্রতিশ্রুতির অর্ধেকের কম। গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ৭২৪ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল।
জুলাই–মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি ১২২ কোটি ডলার ছাড় করেছে এডিবি। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ১০৭ কোটি ডলার ও জাপান ৮৯ কোটি ডলার দিয়েছে।