বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার ও ব্যবস্থাপক সাফায়েত আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর আবেদন করা হয়েছে।

সোমবার দুপুরে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সেগুলোর বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে দুদক কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সোমবার প্রধান উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ আমলে নেওয়ার আবেদন করেন দিনাজপুর সদরের বালুবাড়ী এলাকার জোবায়দুর রহমান।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যবস্থাপকের দুর্নীতি ও অনিয়মের তদন্ত করতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই দুদকের কর্মকর্তারা এই তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছেন। দুর্নীতি অনিয়মের সংশ্লিষ্টতার বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।

অভিযোগ জোবায়দুর রহমান উল্লেখ করেন, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার খনিতে একের পর এক দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে নানান অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ নভেম্বর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার ও ব্যবস্থাপক সাফায়েত আলীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পেট্রোবাংলা থেকে একটি অফিস আদেশ হয়।

পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আমজাদ হোসেন স্বাক্ষরিত আদেশে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ থাকলেও ৩ মাসেও ওই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। একইসঙ্গে প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার ও সাফায়েত আলীকে ওএসডি না করে খুবই ধীর গতিতে তাদের তদন্ত কাজ করায় জনমনে নানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে বলে ওই আবেদনে বলা হয়।

এর আগেও বিভিন্ন সময়ে জোবায়দুর রহমান ও মোর্শেদ আলম বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম ও ব্যবস্থাপক সাফায়েত আলীর বিরুদ্ধে পেট্রোবাংলা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, উপ-কর কমিশনারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ, উৎকোচের বিনিময়ে আউটসোর্সিং কর্মচারী হিসেবে ২৫ জনকে নিয়োগ প্রদান, ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন, ব্যাংকে এফডিআর, প্রক্রিয়া ছাড়াই গাছ কাটা ও টাকা আত্মসাৎ।

অভিযোগগুলো থেকে জানা যায়, প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকারের বাড়ি বগুড়া জেলা সদরের ফুলবাড়ী মধ্যপাড়া এলাকায়। প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার ২০২২ সালের ২১ জুলাই ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে বিসিএমসিএলে কর্মরত আছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতির পূর্বে তিনি চাইনিজ ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির ইঞ্জিনিয়ার টু কন্ট্রাক্ট ও মহাব্যবস্থাপক (মাইনিং) পদে দায়িত্বে ছিলেন। এই খনিতে চাকরিতে থেকে তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজের পেছন দিকে ৮/১০ শতক জমির উপর ৫/৬ তলা বিশিষ্ট একটি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে দায়িত্ব পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকার মিরপুর-২ এ একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়াও তিনি বগুড়া ও ফুলবাড়ীতে নামে বেনামে কয়েক কোটি টাকার জমি কিনেছেন।

অভিযোগগুলো বলছে, তার নামে অফিস আদেশের মাধ্যমে প্রধান কার্যালয়, চৌহাটি, পার্বতীপুর, দিনাজপুর-এ চলাচলের জন্য একটি পাজেরো স্পোর্টস জিপ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। অফিস আদেশ বহির্ভূত আরও একটি পাজেরো ভি-৬ জিপ এককভাবে ঢাকাতে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও তিনি অবৈধভাবে ঢাকায় বসবাসরত তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য একটি মিতসুবিসি ল্যান্সার কার ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও সাইফুল ইসলাম সরকারের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ বছরে ২ কোটি ২৯ লাখ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি গত ২ বছরে কয়লা খনির আবাসিক এলাকায় ২৮/৩০ বছরের পুরাতন ৪০/৫০টি ফলদ বৃক্ষ কোনোরকম প্রক্রিয়া ছাড়াই বিক্রি করে সব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

এদিকে খনির ব্যবস্থাপক শাফায়েত আলী মিয়ার বিরুদ্ধেও সাইফুল ইসলামের সঙ্গে দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। 

২০১২ সালে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে চাকরিতে যোগদান করা শাফায়েত আলী ২০২০ সালে ঢাকার মিরপুর-০১ এর প্রাণকেন্দ্র রূপায়ণ টাওয়ারের পেছনে অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। তার দুটি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৪ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে।

এ ব্যাপারে কথা বলতে ব্যবস্থাপক শাফায়েত আলী মিয়ার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন।

তিনি বলেন, ব্যাংকের লেনদেনের স্টেটমেন্টও সঠিক নয় এবং ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্টের বিষয়টিও সঠিক নয়।

কথা হলে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী সাইফুল ইসলাম সরকার বলেন, যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়। আমার বিরুদ্ধে কিছু মানুষ ওঠেপড়ে লেগেছে। এখানে বেশ কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো করতে হয়। তবে এখানে কোনো অনিয়ম করা হয়নি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ফ য় ত আল তদন ত ক র তদন ত কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

কাজের আনন্দই জীবনের সার্থকতা

জন্মদিনের অনুষ্ঠান নয়, তবে অনানুষ্ঠানিক আয়োজনটি ছিল সে উপলক্ষেই। আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাবিদ ও সুবক্তা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মদিন ছিল গত ২৫ জুলাই। তাঁর অগণিত অনুরাগীরা চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে মিলিত হতে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে, তারপর আর জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে কিছুতেই সম্মত হননি তিনি।

শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ষষ্ঠতলায় কেন্দ্রের প্রাক্তনী ও তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠজন আলাপচারিতার এক ঘরোয়া আয়োজন করেছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে। সেখানে তিনি বললেন, কাজের মধ্য দিয়ে জীবনে যে আনন্দ পেয়েছেন, সেটিই জীবনের সার্থকতা। এই আনন্দই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে, শক্তি জোগায়।

এ আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছেন। তিনি তাঁর চিরপরিচিত সরস অথচ বুদ্ধিদীপ্ত গভীর তাৎপর্যময় কথায় উত্তর দিয়েছেন। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প থেকে শিক্ষা, ইতিহাস, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংগঠন, প্রেম–ভালোবাসা—সবকিছু উঠে আসে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক কথোপকথনে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বহু কালজয়ী লেখকের রচনা থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। এক অন্তরঙ্গ প্রাণবন্ত আবহ বিরাজমান ছিল সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত অবধি এই আয়োজনে।

আবৃত্তিশিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতা আবৃত্তি করে জানতে চান, তিনি কবিতার চর্চা করেননি কেন? জবাবে তিনি বলেন, কবি শামসুর রাহমান একবার তাঁকে বলেছিলেন, তাঁর মধ্যে কবিত্বের ঘাটতি আছে। তাঁর নিজেরও সে রকম মনে হয়েছে। তারপর সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর প্রকাশ ও অনেক রকম কাজ করতে গিয়ে আর কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনি।

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রশ্ন করেন, এখন একটা কঠিন সময় যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে কীভাবে দেখেন, কী আশা করেন তাদের কাছে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘তরুণেরা কী হবে, তা তরুণদের ওপরে নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে আমরা তাদের কী বানাতে চাই, তার ওপর। দেখতে হবে তরুণদের গড়ার মতো আমাদের ক্ষমতা কতটা আছে। অর্থাৎ শিক্ষক কেমন হবে, তার ওপরে নির্ভর করে তাঁর ছাত্র কেমন হবে। সক্রেটিস শিক্ষক ছিলেন বলে ছাত্র প্লেটো হয়েছেন। প্লেটোর শিক্ষা পেয়ে ছাত্র অ্যারিস্টটল হতে পেরেছেন। বড়দের যদি বড়ত্ব না থাকে, তবে ছোটরা বড় হতে পারে না। দুর্ভাগ্য যে আমরা বড়রা তাদের সামনে আদর্শ দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে এখন বড়দেরই ছোটদের পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে।’

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম জানতে চান, তিনি এত বিচিত্র ধরনের এত বিপুল কাজ করেছেন। এই প্রাণশক্তি পান কেমন করে?

উত্তর দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘শক্তি আসে আনন্দ থেকে। কাজ করতে পারাটাই আনন্দের। আর সব সময় আশাবাদী থাকি। আশা কখনো শেষ হয় না। আশা শেষ মানে আমি শেষ।’

আলাপচারিতায় আরও অংশ নেন দুদক চেয়ারম্যান এম এ মোমেন, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ, চিকিৎসক আমজাদ হোসেন, অভিনয়শিল্পী খায়রুল আলম সবুজ, কথাশিল্পী আনিসুল হক, ছড়াকার আমিরুল ইসলাম, উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার, অভিনয়শিল্পী আফসানা মিমি, মশিউর রহমান, আলী নকী প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাক্তনী খাদিজা রহমান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ