সরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে
Published: 23rd, February 2025 GMT
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগের নীতিমালা আবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালকেরা যথেষ্ট জবাবদিহির মধ্যে নেই বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে আপত্তি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সেই আপত্তি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আমলে নিয়েছে। সে অনুযায়ী তারা পরিচালকদের অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনতে নিয়োগ নীতিমালা সংশোধন করতে যাচ্ছে।
২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগের বিদ্যমান নীতিমালা প্রণয়নের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এক সপ্তাহের মাথায় ১৬ এপ্রিল এর ওপর কিছু পর্যবেক্ষণ দেয় বিশ্বব্যাংক। এরপর বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এসে নতুন করে তা নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সভাপতিত্বে গত ৬ জানুয়ারি ঢাকায় সচিবালয়ে একটি বৈঠক হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সে বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ ও বিশ্বব্যাংককে নিয়ে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে এ–সংক্রান্ত খসড়া দাঁড় করাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। আর জুনের মধ্যে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির কাছে।
জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। আশা করি পরিচালকদের অধিকতর জবাবদিহির মধ্যে আনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেই তাঁদের নিয়োগের নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে।’
জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এখন পর্যন্ত যতটুকু খসড়া দাঁড় করিয়েছে তাতে ঋণখেলাপি ও করখেলাপি হলে এবং ১০ বছরের প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনা বা পেশাগত অভিজ্ঞতা না থাকলে কেউই ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য হতে পারবেন না। ফৌজদারি অপরাধ বা জাল-জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ বা অন্য কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন, এমন কেউ পর্ষদ সদস্য হতে পারবেন না। দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলায় আদালতের রায়ে বিরূপ পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্য থাকলে এবং আর্থিক খাত-সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার বিধিমালা, প্রবিধান বা নিয়মাচার লঙ্ঘন করে দণ্ডিত হলেও পর্ষদ সদস্য হওয়া যাবে না। একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকাবস্থায় কেউ অন্য কোনো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংক খাত থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে তার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব যেমন দায়ী তেমনি ব্যাংকাররাও দায়ী। চূড়ান্ত দায় অবশ্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের। কারণ, চূড়ান্ত প্রস্তাব তাঁরাই অনুমোদন করেন। তবে যত অন্যায় সিদ্ধান্তই পরিচালকেরা নেন না কেন তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ একেবারেই বিরল। এখানেই বিশ্বব্যাংকের মূল আপত্তি।
জানা গেছে, একশ্রেণির লুটেরা গ্রাহকের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমেই ঋণপ্রস্তাব তৈরি করেন ব্যাংকাররা। প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা (পিও), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), মহাব্যবস্থাপক (জিএম), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এবং সবশেষে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হয়ে সেই প্রস্তাব উপস্থাপিত হয় পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে। পর্ষদ অনুমোদন দিলেই ঋণ বিতরণ হয়। জনগণের বিশ্বাস করে ব্যাংকে রাখা আমানতের টাকাই ঋণ দেওয়া হয়। আমানতের বিপরীতে সুদও গুনতে হয় ব্যাংকগুলোকে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের উদাহরণ তুলে ধরেন। বলেন, বেক্সিমকো শিল্পপার্কের আওতায় থাকা ৩১ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকঋণ ২৮ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। এ ঋণের বিপরীতে জমি, ভবন, যন্ত্রপাতি, শেয়ার ও ব্যাংকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ইত্যাদি মিলিয়ে মাত্র ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্থাৎ ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার সম্পদ বন্ধক রয়েছে। জনতা ব্যাংক এ ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের জবাবদিহি থাকলে এত বেশি টাকা ঋণ পেত না বেক্সিমকো গ্রুপ।
আগে কী হয়েছে
রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিয়োগে শক্ত কোনো নীতিমালা ছিল না দেশে। সেই সুযোগ নিয়ে সরকার অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে থেকে খেয়ালখুশিমতো পরিচালক নিয়োগ দিয়ে আসছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাবেক আমলা, সাংবাদিক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ এর ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ, সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদে বসানোর উদাহরণ তৈরি করে তৎকালীন অর্থ মন্ত্রণালয়। তিন বছরের জন্য নিয়োগ পাওয়া এসব পরিচালকের অনেকেরই দেশের অর্থনীতি, ব্যাংকিং, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানের অভাব ছিল বলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে।
ব্যাপক সমালোচনার পরও এ পথ ও প্রক্রিয়া থেকে আওয়ামী লীগ সরকার সরে তো আসেইনি, বরং দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালে ক্ষমতায় এসে একই কাজ শুরু করে। এর পরিণতিতে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, হল-মার্ক ও বিছমিল্লাহ গ্রুপ ইত্যাদি কেলেঙ্কারির সৃষ্টি হয়েছে। পরে আরও বড় কেলেঙ্কারির জন্ম দেয় ব্যাংকগুলো। যেমন এস আলম ও বেক্সিমকো গ্রুপের লুটপাট।
আবুল মাল আবদুল মুহিত দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় লোক নিয়োগ দেওয়া থেকে সরে আসে তৎকালীন সরকার। পরিচালক নিয়োগে নামকাওয়াস্তে হলেও একটা নীতিমালা করা হয় মাঝখানে। তখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন এম আসলাম আলম। অর্থমন্ত্রী ও সচিবের কাছে হঠাৎ মনে হয় এভাবে ওপর থেকে চাপিয়ে সরাসরি পরিচালক নিয়োগ দেওয়া বেআইনি হচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে পরিচালক নিয়োগের জন্য লোক বাছাই করে ব্যাংকগুলোর পর্ষদের কাছে চিঠি পাঠানো শুরু করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। কিন্তু এর পর থেকে বেশির ভাগ নিয়োগ দেওয়া হচ্ছিল দলীয় আনুগত্য পোষণকারী সাবেক আমলাদের। সমানতালে চলতে থাকে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া-ও। এভাবে চলতে চলতেই ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এসে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিতে উপযুক্ত ও প্রমাণিত দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়।
নীতিমালাটিতে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের যোগ্যতা কী হবে, কাদের নিয়োগ দেওয়া যাবে, তা ঠিক করে দেওয়া হয়। বলা হয়, রাষ্ট্র খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশেষায়িত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের মালিকানা (শেয়ার) রয়েছে এমন বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালাটি প্রযোজ্য হবে। এমন প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৬টি।
বিদ্যমান নীতিমালাও মানা হচ্ছে না
নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদে অর্থনীতি, ব্যাংকিং, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও ব্যবসায় শিক্ষা, কৃষি বা শিল্প, আইন ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন এবং সরকারের বিবেচনায় অভিজ্ঞ ও প্রমাণিত দক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীরা নিয়োগ পাবেন। এ ক্ষেত্রে ‘সরকারের বিবেচনা’ বিষয়টির অস্পষ্টতা রয়েছে। এ সুযোগে এখনো অনভিজ্ঞ ও প্রমাণিত অদক্ষতাসম্পন্ন পেশাজীবীরাও পর্ষদে রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব ও নিরীক্ষা বোঝার জন্য সনদপ্রাপ্ত হিসাবরক্ষক (সিএ) ও আইনি বিষয় বোঝার জন্য একজন সাবেক জেলা জজ অথবা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন ব্যাংকার নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে নীতিমালায়।
পর্ষদে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য রাখাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে ২ জন নারী সদস্য থাকলেও অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডে (বিডিবিএল) নারী সদস্য একজনও নেই।
নিয়োগ নীতিমালা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক মাইন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, আগে পর্ষদ সদস্যদের সম্মানী যথেষ্ট মাত্রায় বাড়াতে হবে। তারপর তাঁদের অধিকতর জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। জবাবদিহি বাড়ানো হলে অনেকে যে এখন ফুটানি দেখায় যে তিনি অমুক ব্যাংকের পরিচালক, সেই ভাবটা আর থাকবে না।
রাজনৈতিক প্রভাবে আমানতের টাকা যাচাই-বাছাই করা ছাড়া দিয়ে দেওয়ার দায়ভার পরিচালকেরা নেবেন না, এটা হতে পারে না বলে মনে করেন মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, নারী সদস্যদের বিষয়টি ঐচ্ছিক রাখাই ভালো। যোগ্য নারী না থাকলেও শুধু এক-তৃতীয়াংশের শর্ত পূরণের জন্য তখন অযোগ্যরা পর্ষদে ঢুকে যেতে পারেন। তাই সে সুযোগ রাখা ঠিক হবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য ক র পর
এছাড়াও পড়ুন:
আরও বিস্তৃত হয়েছে শ্রমিকের সংগ্রামের জমিন
মে দিবস। পৃথিবীর খেটে খাওয়া মানুষের দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন শ্রমিকেরা। পুলিশের গুলিতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু সেই রক্তের বিনিময়েই কাগজে–কলমে হলেও প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমের মর্যাদা, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, ন্যায্য মজুরি ও সংগঠনের অধিকার। একসময় এসব দাবিই রূপ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের ভিত্তিতে।
কিন্তু ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যখন এই দিনে ফিরে তাকাই, তখন প্রশ্ন আসে, এখনো কি সেই সব দাবি প্রাসঙ্গিক? নাকি সময় পাল্টে দিয়েছে সব? এখন তো কাজের ধরনই বদলে গেছে—একদিকে অটোমেশন, অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়যাত্রা। উৎপাদনের পদ্ধতি যেভাবে বদলেছে, তাতে পুরোনো ধরনের শ্রমিক যেন ক্রমে অদৃশ্য হয়ে পড়ছেন।
আজকের দুনিয়ায় পুঁজি এক ক্লিকে দেশান্তরিত হয়, কারখানা গড়ে ওঠে যেখানে মজুরি কম এবং আইনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল। মানুষ এখন আর কেবল শ্রমিক নয়; তাঁদের বলা হচ্ছে ‘ফ্রিল্যান্সার’, ‘কন্ট্রিবিউটর’, ‘পার্টনার’, ‘ডেলিভারি ম্যান’। কিন্তু আসলে, এদের অনেকেই এক নতুন ধরনের দিনমজুর; যাঁদের নেই নিরাপত্তা, নেই সুনির্দিষ্ট অধিকার। কাজ করছেন তাঁরা—কখনো রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিয়ে, কখনো কম্পিউটারে চ্যাটবট প্রশিক্ষণ দিয়ে, আবার কখনো অ্যালগরিদম পরিশোধনে; কিন্তু কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন। তাঁরা জানেন না যে তাঁদের কাজের ফল কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবহৃত হবে।
এই ব্যবস্থার একটি বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন। তাদের গুদাম ও সরবরাহ চেইনে রোবট, ড্রোন ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। শ্রমিকেরা সেখানে নির্ধারিত সময়ের বেশি কাজ করতে বাধ্য হন, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অথচ যখন তাঁরা সংগঠিত হতে চান, তখন কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠে লবিং, বিরোধিতা, ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ। ২০২৩ সালে অ্যামাজনের একাধিক গুদামে ইউনিয়ন গঠনের চেষ্টাকে রুখে দিতে কোম্পানিটি কোটি কোটি ডলার খরচ করে আইনি দল গঠন করে।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়; সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে নাশুধু অ্যামাজন নয়, গোটা দুনিয়াতেই শ্রমের এক নতুন রূপ তৈরি হচ্ছে—ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্মভিত্তিক শ্রম। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকেরা কাজ করেন উবার, ফুডপান্ডা, আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো অ্যাপে যুক্ত হয়ে। অথচ তাঁদের নেই কোনো কর্মস্থল, নেই কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, নেই অসুস্থতার ছুটি বা পেনশনের মতো সামাজিক সুরক্ষা। বাস্তবে তাঁরা একা, বিচ্ছিন্ন। প্রতিযোগিতার চাপে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় অনিরাপত্তার ভেতর।
২০২৩ সালের একটি আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অন্তত ৮০% গিগ-ওয়ার্কার দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন। অথচ তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মাস শেষে কোনো নির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরি পান না। গ্লোবাল গিগ ইকোনমির এই বাস্তবতা বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। আমাদের শহরগুলোয় এখন হাজারো বাইক বা সাইকেলচালক কাজ করছেন খাবার কিংবা পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তাঁরা কেউই প্রাতিষ্ঠানিক কর্মী নন।
এর পাশাপাশি আরও একটি বড় পরিবর্তন এনেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান। প্রশ্ন উঠেছে, এআই কি শ্রমিকের বন্ধু, না প্রতিদ্বন্দ্বী? যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে এআই কমপক্ষে ৮০ কোটি মানুষের কাজের ধরন পাল্টে দেবে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ সম্পূর্ণভাবে কাজ হারাতে পারেন। হোয়াইট-কলার পেশাগুলো যেমন হিসাবরক্ষণ, গ্রাহকসেবা, এমনকি সাংবাদিকতার কাজও এই প্রযুক্তির কারণে সংকটে পড়ছে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৩ সালের ‘দ্য ফিউচার অব জবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৮ কোটি ৫০ লাখ কাজ হারিয়ে যাবে প্রযুক্তি ও অটোমেশনের কারণে। তবে একটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। যদি উৎপাদিত পণ্যের খরিদ্দার না থাকে, তাহলে উৎপাদন করে কীভাবে মুনাফা আসবে? আর শ্রমিক না থাকলে কিনবে কে? তবে একই সময়ে ৯ কোটি ৭০ লাখ নতুন ধরনের কাজের সৃষ্টি হতে পারে। কাজগুলো হবে ডেটা অ্যানালিটিকস, প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালনা এবং সৃজনশীল ও মানবিক দক্ষতানির্ভর কাজ। এই নতুন শ্রমিকদের অবস্থার কথা ওপরে বলা হয়েছে।
কিন্তু এই নতুন কাজের মালিকানা কার হাতে? শ্রমিকদের নয়, রাষ্ট্রেরও নয়—এই ক্ষমতা এখন করপোরেট অলিগার্কদের হাতে কেন্দ্রীভূত। যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, মার্ক জাকারবার্গদের মতো প্রযুক্তি ধনকুবেররা শুধু প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রকই নন, তাঁরা রাজনীতিতেও সরাসরি প্রভাব ফেলছেন। করপোরেট লবিংয়ের মাধ্যমে আইন তৈরির পেছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে; যেমন ট্যাক্স ছাড়, শ্রম আইন শিথিলকরণ বা প্রতিযোগিতা নীতির ধ্বংস।
বাংলাদেশেও দৃশ্যপট খুব আলাদা নয়। তৈরি পোশাকশিল্পে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাঁরা দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত্তি। কিন্তু তাঁরা এখনো ন্যূনতম মানবিক মজুরি পান না। গত বছর শ্রমিকেরা ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা মজুরি চাইলেও সরকার তা নামিয়ে ১২ হাজারে নিয়ে আসে। আন্দোলনের জবাবে আসে পুলিশি দমন, ধরপাকড়, ভয়ের পরিবেশ। মালিকেরা নতুন প্রযুক্তি বসিয়ে আরও কম শ্রমিক দিয়ে আরও বেশি উৎপাদন নিশ্চিত করবেন। আগে–পরে এটা অবধারিত।
এই প্রেক্ষাপটে মে দিবস আজ আমাদের সামনে এক নতুন প্রশ্ন তোলে—শ্রমিক আসলে কে? তাঁর অধিকার কী? আর লড়াইটা কিসের জন্য?
যদি শ্রমিকের সংজ্ঞাই বদলে যায়, তাহলে লড়াইয়ের রূপও কি পাল্টাতে হবে না? একসময়ের আট ঘণ্টার কাজের দাবি এখন হয়তো পুরোনো মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বহু মানুষ এখনো দিনে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। কেউ কাজ পাচ্ছেন না, কেউ কাজ করেও মাস শেষে ঠিকমতো পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। কেউ এমন এক ধরনের ডিজিটাল শ্রম করছেন, যার নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা তাঁর নয়, তিনি জানেনই না যে কার জন্য কাজ করছেন।
তাই আজ মে দিবস শুধু অতীত স্মরণের দিন নয়—এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনারও দিন। এটি নতুন ধরনের দাবির জায়গা—ডিজিটাল শ্রমের স্বীকৃতি, গিগ-ওয়ার্কারদের অধিকার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি। আর অবশ্যই আমাদের মতো দেশে গায়ে খাটা শ্রমের ন্যায্য মজুরির দাবি।
মে দিবস আজও জীবিত; কিন্তু তার সংগ্রামের মাঠ আরও বিস্তৃত হয়ে গেছে। তা এখন শুধু কারখানার ফটক নয়, সার্ভার রুমে, ডেটা সেন্টারে, কোড লাইনে, ক্লাউড সিস্টেমে। কিন্তু যেখানেই হোক, শ্রমিক তো সে–ই, যাঁর শ্রমে পৃথিবী চলে, যাঁকে ছাড়া কিছুই চলে না।
এই সত্য যত দিন থাকবে, মে দিবস তত দিন থাকবে; নতুন প্রশ্ন নিয়ে, নতুন লড়াই নিয়ে।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী