অনেকে বাল্যবয়সে মেয়ে বিয়ে দেওয়াকে সুন্নত বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। তারা বলতে চান, নবীজি (সা.)–ও তো তার কন্যাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছেন। অনেকে আবার আয়েশা (রা.)–র কম বয়সে তাঁর সঙ্গে নবীজি (সা.) বিয়ে নিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলতে চান।

নবীজি (সা.)–এর মেয়ে ফাতিমার (রা.) বিয়ে আমাদের সামনে একটি উদাহরণ। নবীজি (সা.)–এর অন্য তিন মেয়ের বিয়ে হয়েছে মক্কায় থাকাকালে, ইসলামের বিধান আসার আগে। তাদের ব্যাপারে এমন প্রমাণও মেলে না যে সাবালক হওয়ার আগেই নবীজি (সা.

) তাদের বিয়ে দিয়েছেন।

বুরাইদাহ (রা.) বলেন, ফাতিমা (রা.)–র জন্য আবু বকর (রা.) এবং ওমর (রা.) বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। নবীজির (সা.) বলেছিন, সে এখনও ছোট। এরপর আলি (রা.) প্রস্তাব পাঠালে নবীজি (সা.) তাঁর সঙ্গে ফাতিমাকে বিবাহ দেন। (নাসায়ি, হাদিস: ৩২২১)

আরও পড়ুনআলহামদুলিল্লাহ সর্বোত্তম দোয়া১০ আগস্ট ২০২৩

এই হাদিস এবং এ বিষয়ে অন্যান্য হাদিসের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, আলির (রা.) প্রস্তাব এসেছে আবু বকর ও ওমরের প্রস্তাবের পরপরই। সময়ের ব্যবধান তেমন ছিল না। তাই ‘সে এখনও ছোট’ নবীজির (সা.) এ-কথার মানে এই নয় যে, ফাতিমা তখনও বিবাহের যোগ্য হননি। তিনি ছোট ছিলেন তাঁর সঙ্গে আবু বকর (রা.) এবং ওমরের (রা.) বয়সের ব্যবধানের তুলনায়। সে তুলনায় আলি (রা.) ও ফাতিমার (রা.) বয়স ছিল কাছাকাছি।

সুতরাং কন্যার জন্য কল্যাণকর দিক কোনটি, সেদিকে লক্ষ রাখা এবং যথাসম্ভব তা বাস্তবায়ন করা প্রত্যেক পিতার কর্তব্য। এটাই সুন্নাহ।

বিয়ের সময় ফাতিমার (রা.) বয়স কত ছিল? ঐতিহাসিক মত হলো তিনি নবীজি (সা.)–এর নবুয়তপ্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে জন্ম নেন। এটাই বেশি গ্রহণযোগ্য মত। নবুয়তের পর মক্কায় নবীজি (সা.) নামাজের সেজদায় গেলে কাফেররা একবার তার মাথায় উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দেয়। ফাতিমা (রা.) তখন দৌড়ে এসে নবীজি (সা.)–এর মাথা থেকে জঞ্জাল সরাতে সাহায্য করেন। বোঝা যায়, তাঁর বয়স তখন অন্তত সাত।

আরও পড়ুনযে ১২টি আমলে রিজিক বাড়ে০৯ আগস্ট ২০২৩

আরেকটি মত হলো, নবীজি (সা.)–এর ৪১ বছর বয়সে তার জন্ম হয়। (আল-মাওয়াহিবুল লাদুনিয়্যাহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৩)

তবে দ্বিতীয় হিজরিতে আলি (রা.)–র সঙ্গে তাঁর বিয়ের বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। (মিন মায়ীনিস সিরাত, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২২৫)

প্রথম মতানুসারে বিয়ের সময় ফাতিমার (রা.) বয়স ছিল ২০ বছর। এটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। দ্বিতীয় মত ধরা হলেও তাঁর বয়স তখন ১৫ বছরের কম হয় না। সে যুগের প্রচলন অনুযায়ী এ বয়স আরব মেয়েদের বিয়ের জন্য অযৌক্তিক ছিল না।

আয়েশা (রা.)–কে বিয়ে করার মতো ফাতিমা (রা.)–কে বিয়ে দেওয়াও ছিল নবীজি (সা.)–র একটি আমল। একটির উল্লেখ করে অন্যটি ভুলে গেলে চলবে না। আয়েশা (রা.)–র বয়স বিয়ের সময় ছিল ছয় বছর এবং বাসর যাপনের নয় বছর। (বুখারি, হাদিস: ৫,১৩৩)

এর বিশেষ এক কারণ ছিল। উপযুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের বেলায় তাড়াহুড়া করে বিয়ের ব্যাখ্যায় আয়েশা (রা.) নিজেই জানিয়েছেন, নবীজি (সা.) আমাকে বলেছেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি, একদল ফেরেশতা তোমাকে এক টুকরা রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে এনেছে। একজন বলল, এ আপনার স্ত্রী। আমি ওপর থেকে কাপড় সরালাম, দেখি তুমি। আমি বললাম, এ যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, তাহলে আমি বাস্তবায়ন করব। বুখারির বর্ণনায় আছে, দুবার তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি। মুসলিমের বর্ণনায় আছে, তিন রাত স্বপ্নে দেখেছি। (বুখারি, হাদিস: ৩,৮৯৫; মুসলিম, হাদিস: ২৪৩৮)

নবীদের স্বপ্নও অহি। একই স্বপ্ন বারবার দেখা দ্রুত আকদ করার নির্দেশ দেয়। অর্থাৎ, এই বিয়ে ছিল আল্লাহ একটি আদেশ।

আরও পড়ুনঅকালমৃত ও গর্ভপাত হয়ে যাওয়া শিশুরা হবে নাজাতের উপায়০৮ আগস্ট ২০২৩

আয়েশা (রা.) বলেন, দুইবার সতীনরা সমবেত হয়ে আমার বিরুদ্ধে নবীজি (সা.)–কে অভিযোগ জানালেও তিনি বিমুখ থাকেন। তৃতীয়বার নবীজি (সা.) বলেন, আয়েশার বিষয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহর শপথ, আয়েশার (রা.) ছাড়া তোমাদের কারও সঙ্গে বিছানায় থাকাকালে অহি নাজিল হয়নি। (বুখারি, হাদিস: ৩,৭৭৫)

বোঝা যায়, আয়েশা (রা.)–কে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ এই বৈশিষ্ট দিয়েছিলেন।

অহির মাধ্যমে এই বিয়ের আদেশ দেওয়া এবং কেবল তারই ঘরে অহি নাজিলের রহস্য নবীজি (সা.)–এর ইন্তেকালের পর যখন তিনি জ্ঞানবতী মহীয়সীরূপে আবির্ভূত হন, তখন উন্মোচিত হয়। তিনি ছিলেন উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে বড় নারী ফকিহ। বড় বড় সাহাবি তাঁর বক্তব্যে নিজের মত শুধরে নিতেন এবং তাঁর ফতোয়া গ্রহণ করতেন। (যাদুল মাআদ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১০৬)

তাঁর কক্ষ মসজিদে নববী সংলগ্ন হওয়ায় তিনি সহজেই নবীজি (সা.)–এর বক্তব্য, হাদিস ও বিধিবিধান শোনার কাজে লেগে থাকতে পারতেন। কোনো বিষয় ছুটে গেলে নবীজি (সা.)–কে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন। এটাই তাকে এই বিরল যোগ্যতা অর্জনের পথ করে দেয়।

আরও পড়ুনসুরা ইয়াসিনে আছে জীবন ও মৃত্যুর কথা১০ আগস্ট ২০২৩

আয়েশা (রা.)–র বর্ণিত হাদিসের সংখ্যার দিকে তাকালেও তাঁর অবস্থান ও যোগ্যতা পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি দুই হাজার দুইশ দশটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। নবীজি (সা.)–র বাকি সব স্ত্রীর বর্ণিত হাদিসের সর্বমোট পরিমাণ এর তিনভাগের একভাগ হবে না। (আস-সিরাতুন নাবাবিয়্যাতুস সাহিহিয়্যা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৬৪৯)

প্রায় অর্ধ-শতাব্দি পর্যন্ত ইলম ও ফতোয়ায় সাহাবিদের অনন্য ভরসাস্থল ছিলেন তিনি। আবু মুসা আশয়ারি (রা.) বলেন, আমরা রাসুলের সাহাবিগণ যখনই হাদিস সর্ম্পকিত সমস্যার মুখে পড়ে আয়েশার শরণাপন্ন হতাম, তাঁর কাছে অবশ্যই সমাধান পেতাম। (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৮৮৩)

মাসরুক ইবনে আজদা বলেন, অনেক প্রবীণ সাহাবিকেও দেখেছি তাঁর কাছে ‘ফারায়েয’ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২৪২)

এসব যোগ্যতা অর্জনের এর একমাত্র কারণ নবীজির (সা.) দীর্ঘ সন্নিধ্য। সাওদার (রা.) পরে তিনিই নবীজি (সা.)–এর নৈকট্য সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন। দ্রুত বিবাহ ছাড়া এ সান্নিধ্য কিছুতেই সম্ভব হতো না। আয়েশার (রা.) বিবাহ-ঘনিষ্ঠ ঘটনাবলিও প্রমাণ করে যে এই বিবাহ ছিল একটি বিশেষ ব্যতিক্রম। অনুসরণের ক্ষেত্রে বিশেষকে সাধারণের ওপরে প্রাধান্য দেওয়া যায় না।

তাই পিতার জন্যে নবীজির (সা.) প্রকৃত সুন্নাত হলো কন্যার জন্য পাথির্ব ও পরকালীন উভয় দিক বিবেচনায় রেখে কল্যাণকর সিদ্ধান্ত নেওয়া।

আরও পড়ুনজান্নাতে আল্লাহর প্রতিবেশী হতে চেয়েছেন যে নারী১১ আগস্ট ২০২৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র বর ণ আল ল হ আয় শ র র জন য আগস ট র বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।

এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন। 

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।

এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়। 

এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে। 

মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়। 

জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।

এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়। 

এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।

যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।

তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে। 

ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই। 

অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়। 

এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা। 

এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।

এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। 

এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়। 

এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ