আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচে সান্ত্বনার জয়ের খোঁজ
Published: 27th, February 2025 GMT
বিদায় রাগিণী আগেই বেজেছে। প্রাপ্তির খাতাও শূন্য। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ‘এ’ গ্রুপে এমন দুটি দলের ম্যাচ আজ রাওয়ালপিন্ডিতে। বাংলাদেশ খেলবে পাকিস্তানের বিপক্ষে। অথচ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে উভয় দেশের সমর্থকদের মাঝে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল টুর্নামেন্ট শুরুর আগে।
নাজমুল হোসেন শান্ত ঢাকার সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন শিরোপা জয়ের লক্ষ্যের কথা। তারাই কিনা খেলছেন সাদামাটা ক্রিকেট! ব্যর্থতার চোরাবালিতে আটকে পড়া একটি দল তারা। এই চিত্র পাকিস্তানের ক্রিকেটেও। বাংলাদেশিদের চেয়ে পাকিস্তানিদের দুঃখ আরও বেশি।
স্বাগতিক দলের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া কতটা হতাশার, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। ২৯ বছর পর একটি আইসিসি টুর্নামেন্ট হচ্ছে দেশটিতে। অথচ সেমিফাইনাল, ফাইনালে তারাই দর্শক। এই হতাশা থেকেই কিনা পাকিস্তানি মিডিয়ায় ‘ফান’ শো হচ্ছে নিজেদের দলের পারফরম্যান্স নিয়ে। মজা করে তারা বলাবলি করছে, হাত ধরাধরি করে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিচ্ছে ‘দুই ভাই’। তবে এই দুঃখকে ভাগাভাগি করে দিতে পারে বৃষ্টি। পাকিস্তানের আবহাওয়া বিভাগের বার্তা– বৃষ্টিতে ভেসে যেতে পারে খেলা।
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বিদায় আগেই নিশ্চিত হওয়ায় আজকের ম্যাচটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এই আনুষ্ঠানিকতার মাঝেও লুকিয়ে আছে মর্যাদা। উভয় দলই চাইবে জয় দিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করতে। ‘এ’ গ্রুপের পয়েন্ট টেবিলের দুই ‘মিনোসের’ ম্যাচের ফল টুর্নামেন্টে কোনো প্রভাব না রাখলেও সমর্থকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই রাওয়ালপিন্ডিতেই গত বছর বাংলাদেশের কাছে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হয়েছিল পাকিস্তান; যে ফল কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না দেশটির সাবেক ক্রিকেটাররা।
বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচে হেরে গেলে একেবারে তুলাধোনা হবেন মোহাম্মদ রিজওয়ানরা। স্বাগতিক ক্রিকেটাররাও বিষয়টি জানেন। তাই যে কোনো মূল্যে সান্ত্বনার জয় পেতে চাইবেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। লড়াই যখন মর্যাদার, তখন নাজমুল হোসেন শান্তরাও ছেড়ে কথা বলবেন না। কারণ, তুলাধোনা হওয়ার ভয় তো তাদের মনের জানালায়ও উঁকি দিচ্ছে।
আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন সিনিয়র সহকারী কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। ভারত ও নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে। কূটনৈতিক উত্তর দিয়েছেন তিনি, ‘পাকিস্তান তাদের মতো করে পারফর্ম করতে পারেনি। আমরাও পারিনি। দুটি দলই সেরাটা দিয়ে খেলতে চেষ্টা করবে। আমার মনে হয়, ভালো ক্রিকেট খেলা হবে।’ এই টুর্নামেন্টে গত দুই ম্যাচের একটিতেও আড়াইশ রান করতে পারেনি বাংলাদেশ।
দুবাইয়ের ট্রিকি কন্ডিশনে ২২৮ আর রাওয়ালপিন্ডির ফ্ল্যাট ট্র্যাকে ২৩৬ রান করেছে টেনেটুনে। মূলত ব্যাটিং ধসের কারণে ছোট স্কোর করা টাইগারদের। ভারতের বিপক্ষে শুরুতে আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসের মাঝের ওভারগুলোতে উইকেট হারালে বড় সংগ্রহে যেতে পারেননি শান্তরা। অথচ পিন্ডিতে জিততে হলে অন্তত পৌনে তিনশ থেকে তিনশ রান করতে হতো। ভালো পুঁজি না থাকায় বোলাররাও লড়াই করতে পারেননি। শেষ ম্যাচ নিয়েও তাই খুব একটা আশার বাণী শোনা যায়নি সালাউদ্দিনের মুখে। বরং ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে কথার খেলায় মেতেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার লড়াই সব সংস্করণে এখন ভালো জমে। টেস্টে টাটকা স্মৃতি আছে। ওয়ানডে ক্রিকেটেও শেষ সাত ম্যাচের চারটিতে জিতেছে টাইগার বাহিনী। তবে শেষ তিন ম্যাচের জয়ী পাকিস্তান। যদিও ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম দেখায় বাংলাদেশ বাজিমাত করেছিল ১৯৯৯ সালে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এই প্রথম মুখোমুখি হবে তারা। আইসিসির এই টুর্নামেন্টেও পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ বাজিমাত করলে মন্দ হয় না।
পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট জিতলেও সাদা বলের ক্রিকেটে জেতা হয়নি। ১২ ওয়ানডের সবই জিতেছে পাকিস্তান। রাওয়ালপিন্ডিতে ২০০৩ সালে এ দুই দলের খেলা একমাত্র ম্যাচটি স্বাগতিকরা জিতেছে। পরিসংখ্যান এবং হোমে খেলার সুবিধা বিবেচনা করা হলে আজ পাকিস্তান ফেভারিট।
তবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ঠিক হলে জয়-পরাজয় নিয়ে কোনো দলকেই ভাবতে হবে না। সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে এক-এক পয়েন্ট করে নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করতে পারবে। ম্যাচ পণ্ড হবে কিনা বলা না গেলেও বৃষ্টি যে ভোগাবে, তা বোঝা গেছে গতকাল বাংলাদেশের অনুশীলন বাতিল করায়।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সমান কাজ করেও কম মজুরি পান আদিবাসী নারীরা
দিন যায়, আসে নতুন দিন। প্রযুক্তি আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যায় অনেক কিছুই। শুধু বদল হয় না সমাজের পিছিয়ে পড়া কিছু জনগোষ্ঠীর ভাগ্য। বিশেষ করে, আদিবাসী নারী শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
সমালোচনার মুখে ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক ক্ষেত্রেই লিঙ্গ বৈষম্য কমেছে। নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দিনে দিনে কমছে। কিন্তু, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঁওতাল পল্লীর নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আগের মতোই।
দিনাজপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটামোড় এলাকার সাঁওতাল পল্লী জয়পুর পাড়া। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামটি দেখতে বেশ সুন্দর। নিরিবিলি পরিবেশ, চারদিকে সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানক্ষেত আর কিছু দূর পর পর সাঁওতালদের বাড়ি। কোথাও কোথাও উঁচু টিলার মাঝে বড় বড় পুকুর। পুকুর পাড়ে কিছু সাঁওতাল ঘর বেঁধে থাকছেন। পাশের বড় মাঠে খেলা করছে কিছু আদিবাসী শিশু।
আরো পড়ুন:
গাজীপুরে পেশা বদলাচ্ছেন অনেক শ্রমিক
ছোট্ট হাতে সংসারের হাল
পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, নারীদের পাশাপাশি পুরুষদের কেউ কেউ বাঁশের চটা তুলছেন, কেউ রান্নার জন্য গাছের ডাল কাটছেন। বাড়িতে পালন গরু-ছাগল দেখভাল করছেন পুরুষ ও নারী উভয়ই। নারীদের অধিকাংশই গরু-ছাগল চড়ানোসহ বিভিন্ন কাজে বাড়ির বাইরে। যদিও ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়নি তেমন।
কয়েকজন সাঁওতাল নারীকে কাজের ফাঁকে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়। তারদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমরাও পুরুষের মতো জমিতে বীজ বপন, চারা উত্তোলন, রোপণ, সার দেওয়া, নিড়ানি ও ধান কেটে ঘরে তোলা পর্যন্ত সব কাজ করি। কিন্তু, এখনো সেই আগের মতোই মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছি আমরা।”
গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের জয়পুর পাড়া গ্রামের কর্মজীবী সাঁওতাল নারী মমতা হেমব্রম। তিনি বলেন, “পুরুষরা কাজ করে মজুরি পান ৫০০ টাকা আর আমাদেরকে দেওয়া হয় ৪৫০ টাকা। ক্ষেত-খামারের কাজ অনেক কঠিন। পুরুষ-নারী তো সমান কাজ করি। আমরা সমান মজুরি চাই, কিন্তু চাইলেও তো তারা দেন না।”
একই গ্রামের সাবিনা হাসদা। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, “এই অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষ ও নারী ধান-আখ ও মাছ চাষ ও গরু-ছাগল লালনপালন করেন। কাজ একই হলেও আমাদের মজুরি পুরুষের চেয়ে কম। আমরা সমান মজুরি চাই।”
সুরুজ মনি টুডু নামের আরেক নারী বলেন, “আমরা পুরুষের সমান কাজ করি, তাই আমরা এই মে দিবস থেকেই সমান মজুরি চাই। আপনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের কাছে সমান মজুরি নিশ্চিত করার দাবি করছি।”
সাপমারা গ্রামের দেলু মারমা বলেন, “আমাদের সব কাজই কৃষিনির্ভর। সে কারণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের কাজ করতে হয়। তা না হলে সংসার চলে না। আমরাও চাই, পুরুষ এবং নারী যেন সমান মজুরি পান।”
পুকুর পাড়েই বাস করেন অমেদা হাজদা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “সব জায়গায় পুরুষের দাম বেশি, নারীদের দাম কম। সে কারণে তাদের মজুরি বেশি, আমাদের কম। আমাদেরকেও পুরুষের সমান দাম দেবে, সমান মজুরি দেবে, এটাই আমাদের দাবি।”
সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ফিলিমন বাস্কে রাইজিংবিডিকে বলেন, “এই এলাকার অধিকাংশ নারী তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা বিষয়ে তাদের ধারণাই নেই। অনেকে জানলেও কাজ হারানোর ভয়ে ন্যায্য মজুরির বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সমঅধিকারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।”
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক রিকতু প্রসাদ বলেন, “গাইবান্ধার নারীরা আজও মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে, গোবিন্দগঞ্জের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর নারীরা। নারী-পুরুষ সবাই শ্রমিক, বৈষম্য করতেই তাদের আলাদা চোখে দেখা হয়। মে দিবসে মুখে যতই বলি না কেন, পুরুষশাসিত সমাজে এখনো পরিবর্তন আসেনি। সমাজ থেকে মজুরি বৈষম্য দূর করার জোর দাবি জানাই।”
বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিলুফার ইয়াসমিন শিল্পী রাইজিংবিডিকে বলেন, সব ক্ষেত্রেই নারীরা অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মুখে সবাই নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো। সাঁওতাল তথা আদিবাসী নারীদের সমান মজুরি পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। তারা এ দেশেরই নাগরিক। তাদের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে করা প্রয়োজন।
ঢাকা/মাসুম/রফিক