হামাগুড়ি দিয়ে পাঁচতলায় প্রথম খাবার পৌঁছে দিয়েছিলেন রাইডার জাহেদুল
Published: 4th, March 2025 GMT
বাঁ পা নেই, ডান পা থেকেও অকেজো। প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে ঘাড়ের ওপরে। চলেন বিশেষভাবে তৈরি করা তিন চাকার ইলেকট্রিক গাড়িতে। কেউ ভাবেননি তিনি বেঁচে ফিরবেন, কিন্তু ফিরেছেন। প্রথম দেখায়, অনেকে তাঁকে পরিবারের বোঝা মনে করেন। তবে তিনি নিজের কাজ নিজে করেন। বাড়িতে অলস বসে না থেকে বাইরে কাজও করেন। তিনি এখন ফুডপান্ডার রাইডার। রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে বিশেষ ওই গাড়িতে ছুটে বেড়ান।
রাজশাহী নগরের কাজলা এলাকার জাহেদুল ইসলাম ওরফে পলাশের (২৬) গায়ে ২০১০ সালের শেষ দিকে বৈদ্যুতিক তার খসে পড়ে। জ্ঞান ফেরার পরে নিজেকে দেখতে পান ঢাকার একটি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। বাঁ পায়ের হাড় ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। হাঁটুর নিচে থেকে এটি অপসারণ করা হয়। পরে লাগানো হয় কৃত্রিম পা। কীভাবে বৈদ্যুতিক তার খসে পড়ল, সেই কথা জাহেদুলের মনে নেই। তাঁর বাবা নাজির আলী একজন দিনমজুর, মা জানেহার বেগম গৃহিণী। তিন ভাইয়ের মধ্যে জাহেদুল মেজ। সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হয় নগরের কাজলা এলাকায়। ইলেকট্রিক ওই গাড়িতে বসেই তিনি কথা বলেন।
জাহেদুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১০ সালের দিকে জাহেদুল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তেন। অন্য আর দশ শিশুর মতো তিনিও চঞ্চল ছিলেন। হঠাৎই খেয়াল করলেন, হাসপাতালের বিছানায় তিনি। কী ঘটেছিল, তা তাঁর মনে নেই। মা–বাবার কাছ থেকে জেনেছেন, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। প্রায় সাত মাস ঢাকায় চিকিৎসা শেষে রাজশাহীতে ফেরেন তিনি। আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। মাধ্যমিক পেরিয়ে পাস করেন এইচএসসি। পরে করোনার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারেননি। শারীরিক বাধা নিয়েও তিনি কিছু একটা করার চিন্তা করতে থাকেন।
জাহেদুল বলেন, ‘রাস্তায় দেখতে পাই বিশেষ ধরনের পোশাক পরে কিছু মানুষ সাইকেল চালিয়ে যান। পরে জানতে পারি, তাঁরা খাবার ডেলিভারি দেন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ফুডপান্ডায় চাকরির আবেদন করি। প্রতিষ্ঠানটি চাকরি দেওয়ার সময় বলেছিল, অনেক সময় উচ্চ ভবনে গিয়ে খাবার দিতে হয়। তখন আমি বলেছিলাম, আগে চাকরিটা দেন, সেটা আমি করে নেব।’
জাহেদুল ক্রিকেট খেলতেও ভালোবাসেন। তিনি বাংলাদেশের হয়ে ভারতেও খেলতে গিয়েছেন। বর্তমানে তিনি রাজশাহী হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য।কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে জাহেদুল বলেন, ‘আমার প্রথম খাবার ডেলিভারিটাই ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং। প্রথম খাবার অর্ডার আসে লক্ষ্মীপুরে একটি বেসরকারি হাসপাতালের পঞ্চমতলা থেকে। নিউমার্কেট এলাকার একটি রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে ম্যাপ দেখে এগোতে থাকি। সেই হাসপাতালের সামনে গিয়ে ওই ক্রেতাকে ফোন করি এবং শারীরিক অবস্থার কথা বলি। ওই লোক বলে দেন, তাঁকে পাঁচতলায় গিয়েই খাবারটি দিতে হবে। তাঁর পুলিশি ঝামেলা আছে। আমার আগে থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে চলার অভ্যাস আছে। পরে আমি হামাগুড়ি দিয়ে পাঁচতলায় উঠে খাবারটি ডেলিভারি দিই। ওই ব্যক্তি আমার এই অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়ে যান। তিনি তখন বলতে থাকেন, “ভাই, আমি বুঝতেই পারিনি যে আপনার এই অবস্থা।” এর পর থেকে আর খুব বেশি কষ্ট হয়নি। রেস্তোরাঁর লোকজনও খুব সহযোগিতা করেন।’
খাবার ডেলিভারি দিয়ে সপ্তাহে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় করেন জাহেদুল। এই টাকা থেকে নিজে কিছু খরচ করেন; মায়ের হাতেও কিছু টাকা দেন। জাহাদুল বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে শিফটে কাজ করতে হয়। অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতা অর্ডার করেন। সেই অর্ডার নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে দিয়ে আসি। এতে কিছু কমিশন পাওয়া যায়। এটা একদম ইচ্ছেমাফিক। এ কাজ করে ভালো লাগে। কিছু টাকা আয় হয়। তা দিয়ে নিজে চলি। মাঝেমধ্যে মায়ের হাতে কিছু টাকা দিই।’
তিন চাকার ইলেকট্রিক গাড়িতে করে খাবার ডেলিভারি দেন জাহেদুল ইসলাম। সম্প্রতি রাজশাহী নগরের বিনোদপুর এলাকায়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে বাধা মাধ্যমিকে সংযুক্ত প্রাথমিক শাখা
আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ে কর্মরত শিক্ষক এবং শিক্ষক নেতৃত্ব অত্যন্ত উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, অতি সাম্প্রতিককালে মাধ্যমিকের নতুন কারিকুলাম নিয়ে এই সেক্টরের বাইরের অংশীজন অতিমাত্রায় তৎপরতা দেখাচ্ছেন, যা বিজ্ঞান এবং যুক্তিসঙ্গত নয় বলে মনে করি।
বাংলাদেশ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নতুন কারিকুলাম নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করেছেন! আবার আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের (শিক্ষা ক্যাডারের জনৈক প্রভাবশালী কর্মকর্তা) পরামর্শ মোতাবেক নতুন কারিকুলামের সফল বাস্তবায়নের জন্য নাকি ডাবল শিফট বিদ্যালয়সমূহ বন্ধের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক উইং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছেন মর্মে সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে; যা আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে!
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ডাবল শিফট স্কুল আজকে চালু হয়নি এবং এই স্কুলসমূহে প্রতি শিফটের জন্য আলাদা শিক্ষক প্যাটার্নও রয়েছে এবং সেখানে প্যাটার্ন অনুযায়ী আলাদা শিক্ষকগণ কর্মরত রয়েছেন। সুতরাং হুট করে সিদ্ধান্ত না নিয়ে এ বিষয়ে ফিল্ড সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা এমনকি প্রয়োজনে গবেষণা করার পর তার ফলের উপর নির্ভর করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি।
উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে এবং ৬৪ জেলা শহরের দুইটি করে সরকারি স্কুলের পাশাপাশি স্বনামধন্য বেশ কিছু বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে ডাবল শিফট চালু আছে। ডাবল শিফট বিদ্যালয়ের ২টি শিফটের জন্য প্যাটার্ন অনুযায়ী আলাদা আলাদা শিক্ষক কর্মরত থাকলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহের সাথে সংযুক্ত প্রাথমিক শ্রেণি সমূহের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষক নেই!
নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষকদের দিয়ে প্রাথমিকের ক্লাস নেওয়ানো কি যৌক্তিক হবে? আশাকরি ২০২৭ সালে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেই পরিকল্পনার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ থেকে সংযুক্ত প্রাথমিক শাখা বিযুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
তাছাড়া, একজন শিক্ষক প্রস্তুতিসহ ক্লাস নিতে গেলে বিরতিহীন ছয়টি বা সাতটি ক্লাস নিলে তা কি ফলপ্রসূ ক্লাস হবে? সঙ্গত কারণে মাধ্যমিক থেকে প্রাথমিকের শ্রেণিসমূহ ডিটাস্ট করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত পার্শ্ববর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা জরুরি বলে মনে করি। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনাও দেওয়া রয়েছে।
একই সঙ্গে, নতুন কারিকুলাম বিষয়ে হোক বা শিক্ষা বিষয়ক যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয় হোক, এই ফিল্ডের অভিজ্ঞ এবং নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের যুক্ত করা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়াটা খুবই জরুরি বলে মনে করি। অন্যথায় জাতি সুদূরপ্রসারী ক্ষতির মধ্যে পড়তে পারে! যা আমাদের কারো কাম্য হতে পারে না! মনে রাখতে হবে সবার আগে দেশ এবং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক ভাবে গড়ে তোলা! তা না হলে দেশের জনগণ জনসম্পদের পরিবর্তে অদূর ভবিষ্যতে দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে!
আমরা দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীন বিরাট সংখ্যক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেখভাল তথা তদারকি যথার্থভাবে হচ্ছে না বলে বিভিন্নভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছি। ২০১০-এর জাতীয় শিক্ষানীতি এবং সম্প্রতি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক মাধ্যমিকের জন্য একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই বিরাট সেক্টর পরিচালনা করা খুবই কঠিন এবং অসম্ভব বলে মনে করি। একই ভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য আলাদা অধিদপ্তর হলে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার যেমন সুযোগ বাড়বে তেমনি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও গতি সঞ্চার হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: শিক্ষক, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়
মুখপত্র, স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটি
ঢাকা/তারা