গাজা ও লেবানন থেকে সম্পদ লুটে বিক্রি করছেন ইসরায়েলি সেনারা
Published: 7th, March 2025 GMT
ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবানন থেকে লুটপাট করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করছেন ইসরায়েলি সেনারা। নতুন এক অনুসন্ধানে ইসরায়েলি সেনাদের বেআইনি এ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি উঠে এসেছে।
হামাকম হাচি হাম বাগেহেনম (দ্য হটেস্ট প্লেস ইন হেল) ইসরায়েলি সেনাদের লুটপাট ও চুরির অসংখ্য ঘটনা একসঙ্গে জড়ো করেছে। ইসরায়েলি সেনাদের এই দুই অঞ্চল থেকে লুটপাট ও চুরি করা মালামালের মধ্যে রয়েছে—নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ও গাড়ি।
ইসরায়েলি সেনারা এসব সম্পদ লুটপাট করার পর টেলিগ্রাম চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস অথবা বাজারে নিয়ে বিক্রি করছেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি শাখা নাহাল ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের এইতান (ছদ্মনাম) নামের এক কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রথম দিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজা ও লেবাননে বিভিন্ন বাড়ি থেকে স্মারক হিসেবে কিছু জিনিসপত্র নেন। এরপরই তাঁদের মধ্যে লুটপাট ও চুরির প্রবণতা বেড়ে যায়।
সৈন্যদের ব্যাগ তল্লাশির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, তাঁদের পুরো ব্যাটালিয়ন একসঙ্গে থাকে। ফলে তাঁরা ছিলেন নির্ভয়। এ সুযোগে ইসরায়েলি সেনারা সর্বত্র লুটপাটের কাজ করছিলেন এবং সব জায়গায় তাঁরা নানাভাবে জিনিসপত্র লুকিয়েছিলেন।
বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে তখনই, যখন দেখা যায়, কেবল তরুণ ও নিম্নপদের সেনারা লুটপাট-চুরি করছেন না, বরং সার্জেন্ট পদবির কর্মকর্তারাও একই অপকর্মে নেমে পড়েছেন।
এইতান বলেন, ‘একজন ইসরায়েলি জ্যেষ্ঠ কমান্ডার গাজায় ঘরবাড়ি থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। বিষয়টি সার্জেন্ট ও কোম্পানি কমান্ডার জানতেন। আমি তখন আমার সার্জেন্টের কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি আমাকে বলেন, এটা সত্যিই খারাপ। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাঁর কিছু করার নেই।’
তদন্তে জানা যায়, এভাবে লুটপাট আর চুরি করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করা সাধারণত অপরাধ। ফলে এসব জিনিসপত্র স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় না।
এসব লুটের মালামালের মধ্যে আরব শিলালিপি অঙ্কিত অলঙ্কার, গোলাবারুদ ও অস্ত্র রয়েছে। ফলে এসব জিনিস প্রকাশ্যে বিক্রি করা হলে সন্দেহের উদ্রেক করবে।
আরেক ইসরায়েলি সৈন্য ওমার বলেন, ‘অন্যান্য মালামালের চেয়ে নগদ অর্থ নেওয়া অনেক সহজ। কারণ, এ টাকা সহজেই খরচ করা যায়। লাখ লাখ শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা) যে লুট করা হয়েছে, আমি সে সম্পর্কে শুনেছি।’
ওই সেনাসদস্য বলেন, ‘কিছু জিনিসপত্র নেওয়া হলে তা বিক্রির জন্য নেওয়া হয়েছে—এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে আমি এটাও জানি, অনেকে অতিমাত্রায় মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে। ফলে তাঁরা সেসব জিনিস গোপন করে রেখেছেন। যাঁরা এসব জিনিসপত্র বিক্রি করবেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে এখনই বন্ধুদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন বলে মনে হয় না।’
ওমার আরও বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যাঁরা কর্তৃপক্ষের অবস্থানে ছিলেন, তাঁরাও এসব সমস্যা ঠিকমতো দেখেননি বা ব্যবস্থা নেননি। ওই সৈন্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তারা একচোখা নীত গ্রহণ করেছেন। সৈন্যদের এই লুটপাটের বিষয়ে তাঁরা মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না।’
ইসরায়েলি সেনাদের অনেকে বিশ্বাস করেন, কমান্ডারদের অনেকেও গাজা ও লেবাননে লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আরও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করেছেন।
সেনাদের নীতিমালায় বলা আছে, কোনো নগদ অর্থ বা গোলাবারুদ পাওয়া গেলে সৈন্যদের বিষয়টি তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি সেনাবাহিনীর টেকনোলজিক্যাল অ্যান্ড লজিস্টিক ডিরেকটোরেটের বুটি ক্লিয়ারেন্স ইউনিটকে (ইয়াহপাশ) জানাবে।
গাজায় এক মাস যুদ্ধের পর ইসরায়েলের ওই ইউনিট জানিয়েছিল, উপত্যকা থেকে ৫০ লাখ শেকেল (১৩ লাখ ডলার) জব্দ করা হয়েছে এবং এই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গাজা ও লেবাননে ১০ কোটি শেকেল (২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) নগদ জব্দ করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ওয়াইনেট নিউজ সিরিয়া, লেবানন ও গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর লুটপাট ও চুরি করে নেওয়ার বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পদের একটি হিসাব দিয়েছিল। এতে দেখা যায়, এসব সম্পদের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের নগদ অর্থ, সোনার বার, দামি স্বর্ণালংকার এবং ১ লাখ ৮৩ হাজার অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি রয়েছে।
চুরি যে ব্যাপকভাবে হয়েছে, সেটা সেনাদের নিজেদের মধ্যকার ঠাট্টাতামাশায় ফুটে উঠেছে। তাঁরা হাসি-তামাশা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, চুরির মালামাল বহন করতে গিয়ে তাদের ‘পিঠের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে’।
ইসরায়েলের বিশেষ সেনাবাহিনীর ইউনিটের নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি লুটপাট চালানো হয়েছে। গাজা ও লেবানন অঞ্চল থেকে ‘শত্রুদের’ সম্পদ জব্দ করার দায়িত্ব এই ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওই ইউনিটের বাইরেও ইসরায়েলি সেনারা ব্যাপকভাবে লুটপাট চালিয়েছেন।
ওয়াইনেট নিউজের অথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় চলমান অভিযানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী এত পরিমাণ অস্ত্র জব্দ করেছে যে সেগুলো দিয়ে একটি ছোটখাটো সেনাবাহিনী বানানো যেতে পারে।
গাজায় বিধ্বস্ত একটি বাড়ির ভেতরে ইসরায়েলি সেনা। ফেব্রুয়ারি ২০২৪-.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ন সপত র কর মকর ত ও ল ব নন কম ন ড র ইসর য় ল ইউন ট করছ ন ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ
এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।
সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।
ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।
‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।
ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।
খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।
এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরীডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।
প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।
ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।
পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।
ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।
বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।
নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউবইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।
ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।
ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।
২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।