ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবানন থেকে লুটপাট করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করছেন ইসরায়েলি সেনারা। নতুন এক অনুসন্ধানে ইসরায়েলি সেনাদের বেআইনি এ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি উঠে এসেছে।

হামাকম হাচি হাম বাগেহেনম (দ্য হটেস্ট প্লেস ইন হেল) ইসরায়েলি সেনাদের লুটপাট ও চুরির অসংখ্য ঘটনা একসঙ্গে জড়ো করেছে। ইসরায়েলি সেনাদের এই দুই অঞ্চল থেকে লুটপাট ও চুরি করা মালামালের মধ্যে রয়েছে—নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ও গাড়ি।

ইসরায়েলি সেনারা এসব সম্পদ লুটপাট করার পর টেলিগ্রাম চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস অথবা বাজারে নিয়ে বিক্রি করছেন।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি শাখা নাহাল ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের এইতান (ছদ্মনাম) নামের এক কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রথম দিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজা ও লেবাননে বিভিন্ন বাড়ি থেকে স্মারক হিসেবে কিছু জিনিসপত্র নেন। এরপরই তাঁদের মধ্যে লুটপাট ও চুরির প্রবণতা বেড়ে যায়।

সৈন্যদের ব্যাগ তল্লাশির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, তাঁদের পুরো ব্যাটালিয়ন একসঙ্গে থাকে। ফলে তাঁরা ছিলেন নির্ভয়। এ সুযোগে ইসরায়েলি সেনারা সর্বত্র লুটপাটের কাজ করছিলেন এবং সব জায়গায় তাঁরা নানাভাবে জিনিসপত্র লুকিয়েছিলেন।

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে তখনই, যখন দেখা যায়, কেবল তরুণ ও নিম্নপদের সেনারা লুটপাট-চুরি করছেন না, বরং সার্জেন্ট পদবির কর্মকর্তারাও একই অপকর্মে নেমে পড়েছেন।

এইতান বলেন, ‘একজন ইসরায়েলি জ্যেষ্ঠ কমান্ডার গাজায় ঘরবাড়ি থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। বিষয়টি সার্জেন্ট ও কোম্পানি কমান্ডার জানতেন। আমি তখন আমার সার্জেন্টের কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি আমাকে বলেন, এটা সত্যিই খারাপ। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাঁর কিছু করার নেই।’

তদন্তে জানা যায়, এভাবে লুটপাট আর চুরি করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করা সাধারণত অপরাধ। ফলে এসব জিনিসপত্র স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় না।

এসব লুটের মালামালের মধ্যে আরব শিলালিপি অঙ্কিত অলঙ্কার, গোলাবারুদ ও অস্ত্র রয়েছে। ফলে এসব জিনিস প্রকাশ্যে বিক্রি করা হলে সন্দেহের উদ্রেক করবে।

আরেক ইসরায়েলি সৈন্য ওমার বলেন, ‘অন্যান্য মালামালের চেয়ে নগদ অর্থ নেওয়া অনেক সহজ। কারণ, এ টাকা সহজেই খরচ করা যায়। লাখ লাখ শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা) যে লুট করা হয়েছে, আমি সে সম্পর্কে শুনেছি।’

ওই সেনাসদস্য বলেন, ‘কিছু জিনিসপত্র নেওয়া হলে তা বিক্রির জন্য নেওয়া হয়েছে—এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে আমি এটাও জানি, অনেকে অতিমাত্রায় মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে। ফলে তাঁরা সেসব জিনিস গোপন করে রেখেছেন। যাঁরা এসব জিনিসপত্র বিক্রি করবেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে এখনই বন্ধুদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন বলে মনে হয় না।’

ওমার আরও বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যাঁরা কর্তৃপক্ষের অবস্থানে ছিলেন, তাঁরাও এসব সমস্যা ঠিকমতো দেখেননি বা ব্যবস্থা নেননি। ওই সৈন্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তারা একচোখা নীত গ্রহণ করেছেন। সৈন্যদের এই লুটপাটের বিষয়ে তাঁরা মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না।’

ইসরায়েলি সেনাদের অনেকে বিশ্বাস করেন, কমান্ডারদের অনেকেও গাজা ও লেবাননে লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আরও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করেছেন।

সেনাদের নীতিমালায় বলা আছে, কোনো নগদ অর্থ বা গোলাবারুদ পাওয়া গেলে সৈন্যদের বিষয়টি তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি সেনাবাহিনীর টেকনোলজিক্যাল অ্যান্ড লজিস্টিক ডিরেকটোরেটের বুটি ক্লিয়ারেন্স ইউনিটকে (ইয়াহপাশ) জানাবে।

গাজায় এক মাস যুদ্ধের পর ইসরায়েলের ওই ইউনিট জানিয়েছিল, উপত্যকা থেকে ৫০ লাখ শেকেল (১৩ লাখ ডলার) জব্দ করা হয়েছে এবং এই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গাজা ও লেবাননে ১০ কোটি শেকেল (২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) নগদ জব্দ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ওয়াইনেট নিউজ সিরিয়া, লেবানন ও গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর লুটপাট ও চুরি করে নেওয়ার বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পদের একটি হিসাব দিয়েছিল। এতে দেখা যায়, এসব সম্পদের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের নগদ অর্থ, সোনার বার, দামি স্বর্ণালংকার এবং ১ লাখ ৮৩ হাজার অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি রয়েছে।

চুরি যে ব্যাপকভাবে হয়েছে, সেটা সেনাদের নিজেদের মধ্যকার ঠাট্টাতামাশায় ফুটে উঠেছে। তাঁরা হাসি-তামাশা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, চুরির মালামাল বহন করতে গিয়ে তাদের ‘পিঠের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে’।

ইসরায়েলের বিশেষ সেনাবাহিনীর ইউনিটের নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি লুটপাট চালানো হয়েছে। গাজা ও লেবানন অঞ্চল থেকে ‘শত্রুদের’ সম্পদ জব্দ করার দায়িত্ব এই ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওই ইউনিটের বাইরেও ইসরায়েলি সেনারা ব্যাপকভাবে লুটপাট চালিয়েছেন।

ওয়াইনেট নিউজের অথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় চলমান অভিযানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী এত পরিমাণ অস্ত্র জব্দ করেছে যে সেগুলো দিয়ে একটি ছোটখাটো সেনাবাহিনী বানানো যেতে পারে।

গাজায় বিধ্বস্ত একটি বাড়ির ভেতরে ইসরায়েলি সেনা। ফেব্রুয়ারি ২০২৪-.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ন সপত র কর মকর ত ও ল ব নন কম ন ড র ইসর য় ল ইউন ট করছ ন ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলে ইরানের নতুন হামলায় নিহত বেড়ে ৫, আহত ২৯

ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে অন্তত চার জায়গায় হামলা চালিয়েছে ইরান। এ হামলায় তিনজন নিহত হয় বলে জানায় জেরুজালেম পোস্ট। বিবিসি আরও দুইজন নিহতের খবর দেয়। এরপর আরেকজনের ফলে নতুন হামলায় ইসরায়েলে নিহত বেড়ে পাঁচজনে পৌঁছাল।

আজ সোমবার আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স ও ব্লাড ব্যাংক সংস্থাগুলো বলছে, এসব হামলায় ২৯ জন আহত হয়েছেন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার প্রধান ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম জানান, মধ্য ইসরায়েলজুড়ে ইরানের হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন নারী, একজন পুরুষ। 

এর আগে সিএনএন ইসরায়েলের ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর দেয়। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবর বলছে, ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে হামলায় একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়াও বন্দরনগরী হাইফায় অন্তত দুইজন আহত হয়েছেন। এছাড়াও সেখান আরও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।

এর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছিল, ইরান থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে হামলা প্রতিহত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।

আজ সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে জরুরি সতর্ক সংকেত (সাইরেন) বাজতে শুরু করেছে। আইডিএফ সতর্ক করে বলেছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি অভেদ্য নয়।

সিএনএনের একজন প্রযোজক জেরুজালেমে সাইরেন এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তার তোলা ভিডিওতে আকাশে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যেতে দেখা গেছে।

ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদোম জানিয়েছে, তাদের দলগুলো আক্রান্ত এলাকার দিকে রওনা দিয়েছে।

সারা দেশের নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, বর্তমানে বিমানবাহিনী হামলা প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা চালানোর কাজ করছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের পেতাহ টিকভা শহরের একটি ভবনে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। হামলার ফলে ওই স্থানে আগুন ধরে যায়। তবে এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এদিকে মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর দাবি, বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সফলভাবে মধ্য ইরানে অবস্থিত একাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব স্থাপনা থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছিল।’

তবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

এদিকে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।

বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় ১ হাজার ২৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। রোববার ইসরায়েল সরকারের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এছাড়া ইরানের হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাত জনের অবস্থা গুরুতর।

এদিকে ইসরায়েলি পুলিশের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়াম শহরে ৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া সাতজন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন জরুরি সেবাদানকারীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ