ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক পেশাগত কাজে গত ১৪ জানুয়ারি গিয়েছিলেন কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাজ শেষে পরদিন বিকেলে একটি বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। রাত ১০টা ৫ মিনিটে বাস থেকে ঢাকার টেকনিক্যাল মোড়ে নামে তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে ২৫০ টাকা ভাড়ায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠিক করেন।

অধ্যাপককে নিয়ে অটোরিকশাটি যখন জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট পার হয়ে গণভবনের সামনে আসে, তখন রাত ১০টা ৫৫ মিনিট। হঠাৎ গণভবনের সামনে এসে থেমে যায় অটোরিকশাটি।

হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় অধ্যাপক চালককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হয়েছে? গাড়িটি থামানো হলো কেন?’ জবাবে চালক বলেন, ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তিনি গাড়িটি সচল করার চেষ্টা করছেন। চালকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে অধ্যাপক অটোরিকশার ভেতর মুঠোফোন দেখছিলেন। হঠাৎ অটোরিকশার কাছে আসেন তিন ব্যক্তি। দুজনের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আরেকজনের বয়স ত্রিশোর্ধ্ব।

কোনো কথা না বলে তিনজন অটোরিকশার দরজা খুলে অধ্যাপকের পাশে বসেন। একজন তাঁর মুখ চেপে ধরেন। আরেকজন গলায় ধারালো চাকু ধরে অধ্যাপককে বলেন, ‘তুই চিৎকার করলে গলা কেটে নামিয়ে দেব।’ ভয়ে তখন ওই অধ্যাপক চোখ বন্ধ করেন।

যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে যে চালক গাড়ি থামান, তিনি আবার গাড়িটি সচল করেন। অটোরিকশাটি গণভবনের সামনের মোড় থেকে ঘুরিয়ে শেরেবাংলা নগর এলাকার দিকে চলতে থাকে।

এ ঘটনায় বেশ কয়েক দিন মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন বলে জানান ওই অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আমি ছিনতাইকারীদের হাতে আটক হলাম, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলো, গলায় আমার চাকু ধরল, বারবার আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, তখন আমার মাথায় কেবল মৃত্যুচিন্তা ভর করেছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে সক্ষম হই। ছিনতাইকারীরা আমাকে যা করতে বলেছে, সেটিই করেছি।’

গলায় চাকু ধরে তিনজন ছিনতাইকারী প্রথমে অধ্যাপকের মুঠোফোনটি কেড়ে নেন। এরপর তাঁর কোলে থাকা ব্যাগটি কেড়ে নেন তাঁরা।

ছিনতাইকারীদের কবল থেকে বেঁচে ফেরা ওই অধ্যাপক গত ৪ মার্চ প্রথম আলোর কাছে এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘দুই লাখ টাকা দিবি, নইলে তোকে মেরে ফেলব’

মুঠোফোন ও ব্যাগপত্র কেড়ে নেওয়ার পর অধ্যাপকের উদ্দেশে একজন ছিনতাইকারী বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আছে, তোর কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। টাকাগুলো কোথায়?’ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া অধ্যাপক তখন ওই ছিনতাইকারীদের বলেন, তিনি একজন শিক্ষক। পাঁচ লাখ টাকা তাঁর কাছে নেই।

অধ্যাপক যখন ছিনতাইকারীকে এ কথা বলেন, তখন আরেকজন ছিনতাইকারী ক্ষিপ্ত হন। তিনি অধ্যাপকের উদ্দেশে বলেন, ‘তুই এখনই দুই লাখ টাকা দিবি, নইলে তোর গলা কেটে দেব।’

ছিনতাইকারীর এ কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে যান ওই অধ্যাপক। তিনি ছিনতাইকারীদের বলেন, ‘যত টাকাপয়সা আমার কাছে রয়েছে, তা তো আপনাদের কাছেই রয়েছে।’ অধ্যাপকের এ কথা শুনে আরও ক্ষিপ্ত হন ছিনতাইকারীরা। যেভাবেই হোক দুই লাখ টাকা এনে দেওয়ার জন্য ছিনতাইকারীরা অধ্যাপককে চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে অধ্যাপক ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে নিজের মুঠোফোন নেন। তিনি তাঁর এক আত্মীয়কে ফোন করেন। ওই আত্মীয়কে বলেন, ‘আমি একটা বিকাশ নম্বর দিচ্ছি। এখনই এক লাখ বিকাশ করো।’

এ কথা বলার পরপরই অধ্যাপকের হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেন একজন ছিনতাইকারী। তখন ছিনতাইকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৪৫ হাজার টাকা পাঠান অধ্যাপকের ওই আত্মীয়। বিকাশে টাকা আসার পর অধ্যাপক ছিনতাইকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভাই, আপনারা তো টাকা পেয়েছেন। এবার আমাকে ছেড়ে দেন।’

অধ্যাপকের ওই কথা শোনার পর একজন ছিনতাইকারী বলতে থাকেন, ‘আপনার মোবাইলে এত ফোন আসে ক্যান, আপনি কিসের স্যার?’

তখন অধ্যাপক নিজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ছিনতাইকারীদের কাছে তুলে ধরেন। যে তিনজন ছিনতাইকারী অধ্যাপককে শুরুতে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তাঁরা তখন তাঁকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক মনে করেন, নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। একজন নাগরিকের মনে যদি আতঙ্ক থাকে, চলাচল করতে ভয় পান, সেটি উদ্বেগজনক।  

একজন ছিনতাইকারী ওই অধ্যাপকে উদ্দেশে বলেন, ‘স্যার, আমরা আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি। আপনি গাড়ি থেকে নেমে পেছনে ফিরে তাকাবেন না। আপনি যদি পেছনে ফিরে তাকান, তাহলে আপনার অনেক বড় ক্ষতি হবে। আমাদের লোক আপনাকে ফলো (অনুসরণ) করবে।’

প্রায় ৪৫ মিনিট অধ্যাপককে জিম্মি করে অটোরিকশাটি শেরেবাংলানগর এলাকা ঘুরে এক পর্যায়ে সংসদ ভবনের সামনে আসে। তখন রাত সাড়ে ১১টার বেশি।

হঠাৎ করে তখন ওই তিন ছিনতাইকারী অধ্যাপককে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে দেন। তখন সংসদ ভবনের সামনে নিরূপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অধ্যাপক। তাঁর পকেটে কোনো টাকা নেই। হতবিহ্বল ওই অধ্যাপক কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। একপর্যায়ে ইঞ্জিনচালিত একটি রিকশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার উদ্দেশে রওনা হন। মধ্যরাতে বাসায় পৌঁছানোর পর স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার ভাড়া পরিশোধ করেন তিনি।

এ ঘটনায় বেশ কয়েক দিন মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন বলে জানান ওই অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আমি ছিনতাইকারীদের হাতে আটক হলাম, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলো, গলায় আমার চাকু ধরল, বারবার আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, তখন আমার মাথায় কেবল মৃত্যুচিন্তা ভর করেছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে সক্ষম হই। ছিনতাইকারীরা আমাকে যা করতে বলেছে, সেটিই করেছি।’

এ ঘটনায় এখনো ছিনতাইকারীদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা জানিয়ে ভুক্তভোগী অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মামলায় ছিনতাইকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বর উল্লেখ করেছিলাম। কেন পুলিশ ছিনতাইকারীদের ধরতে পারছে না, সেটি বোধগম্য নয়।’

কেন ছিনতাইকারীদের ধরা হচ্ছে না, জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম আযম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। স্যারকে জিম্মি করে যারা টাকা আদায় করেছে, তাঁদের চিহিৃত করার কাজ চলছে।’

ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ যে ছিনতাইকারীরা আমাকে জিম্মি করে টাকা আদায় করল, তারা যদি বিচারের আওতায় না আসে, তাহলে একই অপরাধ করতেই থাকবে। ছিনতাইকারীদের হাতে অনেকে খুন হচ্ছে। আমি ভাগ্যগুনে সেদিন বেঁচে ফিরেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক মনে করেন, নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। একজন নাগরিকের মনে যদি আতঙ্ক থাকে, চলাচল করতে ভয় পান, সেটি উদ্বেগজনক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক এ ঘটন য় র স মন পর য য় কর ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সিরাত বা জীবনী শুধু ইসলামের ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং এটি একটি স্বতন্ত্র জ্ঞানশাখা, যার কেন্দ্রে রয়েছেন তিনি এবং তাঁর যুগের ঘটনাবলি, মূল্যবোধ, নীতি, মুজিজা এবং সম্পর্ক।

নবীজির সিরাত প্রতিষ্ঠিত কোরআন, হাদিস এবং সাহাবিদের জীবনাচরণের আলোকে। তবে এই জীবনী নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা এবং তথ্য বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

প্রামাণিক উৎস

মহানবী (সা.)–এর জীবন সম্পর্কে অধ্যয়নের সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো কোরআন মাজিদ। কোরআনে তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়, তাঁর রিসালাত, হিজরত, যুদ্ধ এবং তাঁর মানবিক গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সুরা মুহাম্মদে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়েছে (আয়াত: ২)।

সুরা আলে ইমরানেও এসেছে (আয়াত: ১৪৪), সুরা আহজাবে তাঁকে ‘খাতামুন নাবিয়্যিন’ বা নবীদের সিলমোহর (মানে শেষ নবী) বলা হয়ে (আয়াত: ৪০) এবং সুরা ফাতহে তাঁকে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর রাসুল’ (আয়াত: ২৯)।

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

এ ছাড়া চরিত্র, কাজ, অবস্থান সম্পর্কে বহু আয়াত আছে কোরআনে।

হাদিস গ্রন্থগুলোও সিরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইমাম মালিকের মুয়াত্তা, সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে ইবনে মাজা, সুনানে তিরমিজি এবং সুনানে নাসাইতে তাঁর বাণী, কাজ ও সম্মতির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং সিরাতের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

এই গ্রন্থগুলোর সনদ (বর্ণনা পরম্পরা ও বিষয়বস্তু যাচাইয়ের জন্য মুহাদ্দিসগণ কঠোর মানদণ্ড প্রয়োগ করেছেন, যা ‘জার্‌হ ও তাদিল’ নামে পরিচিত।

এ ছাড়া ইবনে ইসহাকের সিরাতু রাসুলিল্লাহ সিরাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর একটি, ইবনে হিশাম, যার একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রকাশ করেছেন এবং আস-সুহাইলি তা নিয়ে আর-রওদুল উনুফ নামে একটি ব্যাখ্যা রচনা করেছেন।

এ ছাড়া ইবনে শিহাব জুহরি ও মুসা ইবনে উকবার মাগাজি মহানবী (সা.) রাসুলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ। কাজি ইয়াজের আশ-শিফা বি তা’রিফ হুকুকিল মুস্তফা তাঁর গুণাবলি ও অধিকারের ওপর বিশদ আলোচনা করেছে, যা পূর্ব ও পশ্চিমের পণ্ডিতদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত।

আরও পড়ুনমহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনী রচনার হাজার বছর১১ নভেম্বর ২০২০ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও তথ্য বিকৃতি

মহানবীর সিরাত নিয়ে কিছু ব্যাখ্যা ও রচনা ঐতিহাসিক সত্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে, যা ইসলামের প্রকৃত চিত্রকে বিকৃত করেছে। এই বিকৃতিগুলো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হয়েছে, কখনো অতিরঞ্জিত বর্ণনা বা ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।

মহানবীর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পায় হজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজের সময়। তিনি আরাফাতে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে তোমাদের হজের রীতি গ্রহণ করো। কারণ, এ বছরের পর আমি হয়তো আর হজ করতে পারব না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,২৯৭)

সুরা নাসর অবতীর্ণ হলে তিনি বলেন, ‘এটি আমার মৃত্যুর ঘোষণা।’ (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৫/২০৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শিরা ছিঁড়ে যাবে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮

রাসুল (সা.) মসজিদে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাঁর একজন বান্দাকে দুনিয়া ও আল্লাহর নৈকট্যের মধ্যে পছন্দ করতে বলেছেন, আর সেই বান্দা আল্লাহর নৈকট্য পছন্দ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৫০৪)

তাঁর অসুস্থতার সময় তিনি আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকতে পছন্দ করেন। আয়েশা বলেন, ‘তিনি জান্নাতুল বাকি (কবরস্থান) থেকে ফিরে এসে আমাকে মাথাব্যথায় কাতর দেখে বললেন, “বরং আমি বলি, হায় আমার মাথা”!’ (মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, সিরাতু রাসুলিল্লাহ, পৃ. ৬৭৮, দারুল মা’রিফা, বৈরুত, ১৯৭৮)

তিনি তীব্র জ্বরে ভুগছিলেন এবং বলেন, ‘আমি এখনো খায়বারে খাওয়া বিষাক্ত খাবারের যন্ত্রণা অনুভব করছি, এখন এর সময় এসেছে যে আমার শ ছিঁড়ে যাবে’ (সহিহ আল-বুখারি, হাদিস: ৪৪২৮)। তিনি নির্দেশ দেন সাতটি মশকের পানি তাঁর ওপর ঢালার জন্য, যা তাঁর জ্বর কমাতে সাহায্য করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৪২, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল, সোমবার (৭ জুন, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আয়েশা (রা.)–এর ঘর থেকে মসজিদে উঁকি দিয়ে মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাকে মৃত্যুর যন্ত্রণায় সাহায্য করো।’ (আবু বকর আল-বাইহাকি, দালাইলুন নুবুওয়া, ৭/২৪৪, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৮৫)

তাঁর মৃত্যুর পর আবু বকর (রা.) ঘোষণা দেন, ‘যে মুহাম্মদের ইবাদত করত, সে জানুক, মুহাম্মদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে জানুক আল্লাহ চিরজীবী, তিনি মরেন না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১২৪১)

আরও পড়ুননবীজি (সা.)–র কোন জীবনী পড়বেন২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫খিলাফতের প্রতিষ্ঠা: সাকিফা বনু সায়েদা

মহানবী (সা.)–এর মৃত্যুর পর ‘সাকিফা বনু সায়েদা’য় সাহাবিরা খিলাফত নির্বাচনের জন্য সমবেত হন। আনসাররা সাদ ইবন উবাদার নেতৃত্বে দাবি করেন যে তারা ইসলামের প্রথম দিন থেকে রাসুলকে সমর্থন করেছেন, তাই তাদের মধ্য থেকে আমির নির্বাচিত হওয়া উচিত।

আবু বকর (রা.) মুহাজিরদের পক্ষে বলেন, ‘কুরাইশরা ইসলামে প্রথম ইমান এনেছে এবং তারা আরবের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র। আমি তোমাদের জন্য উমর বা আবু উবাইদাহর মধ্যে একজনকে প্রস্তাব করছি।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৫৬, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

আনসাররা প্রস্তাব করেন, ‘একজন আমির মুহাজিরদের থেকে এবং একজন আনসারদের থেকে হবে।’ তবে এই প্রস্তাব ঐক্য রক্ষার জন্য প্রত্যাখ্যাত হয়। উমর ইবনে খাত্তাব আবু বকরের হাত ধরে বায়আত করেন এবং আনসাররাও তাঁকে সমর্থন দেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৮৩০)

আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।হজরত আবু বকর (রা.)

পরদিন মসজিদে সাধারণ বায়আত অনুষ্ঠিত হয়। আবু বকর (রা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি, কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট নই। আমি যদি ভালো করি, আমাকে সাহায্য করো; আর যদি ভুল করি, আমাকে সংশোধন করো।’ (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ২/৬৫৮, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

কয়েকজন সাহাবি, যেমন আলী (রা.) এবং জুবাইর ইবন আওয়াম, ফাতিমা (রা.)-এর ঘরে মহানবীর দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই সাকিফায় উপস্থিত ছিলেন না। কেউ কেউ মনে করেন, খিলাফতের জন্য আলী (রা.) বা আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব উপযুক্ত ছিলেন।

তবে মহানবী কাউকে স্পষ্টভাবে খলিফা মনোনয়ন করেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে কাগজ দাও, আমি তোমাদের জন্য এমন কিছু লিখে দেব, যার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না।’ কিন্তু উমর বলেন, ‘নবীজি এখন প্রবল যন্ত্রণায় ভুগছেন, (তাকে বিরক্ত করব না) আমাদের জন্য কোরআনই যথেষ্ট।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৪)।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মহানবীর ভূমিকা

‘আবু বকর (রা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন’ বলে হালা ওয়ার্দি যে দাবি করেছেন, তা ঐতিহাসিক তথ্যের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।

মহানবী (সা.) নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি মদিনায় একটি জাতি গঠন করেন, যারা কোরআনের নির্দেশনা অনুসরণ করে ঐক্যবদ্ধ হয়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরো এবং বিচ্ছিন্ন হোয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)

তিনি মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। (ইবনে হিশাম, সিরাতুন নবী, ১/৫০১, দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, বৈরুত, ১৯৯৮)

তিনি বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি, যুদ্ধে নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রদূত প্রেরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। যেমন রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াস, পারস্যের কিসরা এবং মিসরের মুকাউকিসের কাছে পত্র প্রেরণ করেন, যা তাঁর রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪/২৬৯, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৮৮)

তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচার ও শুরার নীতি প্রয়োগ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচারের সঙ্গে রায় দাও।’ (সুরা সাদ, আয়াত: ২৬)

মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদ চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৭৮৭)।

তিনি শুরার বাস্তবায়ন করেন, কেননা কোরআন বলেছে, ‘তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)

তিনি বলেন, ‘আমি একজন মানুষ। ধর্মীয় বিষয়ে আমার নির্দেশ গ্রহণ করো, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে বেশি জানো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩৬৩)

হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।শেষ কথা

মহানবীর ‘সিরাত’ ইসলামের ইতিহাস ও মূল্যবোধের একটি জীবন্ত দলিল। কোরআন, হাদিস এবং প্রামাণিক সিরাত গ্রন্থগুলো তাঁর জীবনের সঠিক চিত্র তুলে ধরেছে। তবে হালা ওয়ার্দির গ্রন্থের মতো অনেক গ্রন্থ বাজারে পাওয়া যায়, যা ঐতিহাসিক তথ্যের অপব্যাখ্যা করে এবং তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করে।

মহানবী (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, যিনি ন্যায়বিচার, শুরা এবং ঐক্যের ভিত্তিতে এটি গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মৃত্যু ও খিলাফত নির্বাচনের ঘটনাগুলো তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করেছে। এই সিরাত আমাদের শিক্ষা দেয় যে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা এবং ঐক্যের মাধ্যমে সমাজ গঠন করা সম্ভব।

সূত্র: আল-মালুম আন আল-জাদওয়াল আত-তারিখি লি-সিরাতির রাসুল

আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর জন্মকালের অলৌকিক ঘটনাবলি১৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফ্রান্সজুড়ে কৃচ্ছ্রতা বিরোধী বিক্ষোভ
  • চিমামান্দা এনগোজি আদিচির নারীবাদ
  • ভোররাতে রণক্ষেত্র: নরসিংদীতে নিহত ১, গুলিবিদ্ধ ৫
  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে