বেড়েছে ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ, ৬ মাসে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার
Published: 7th, March 2025 GMT
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।
এছাড়া সরকারের ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণও বেড়েছে। চলতি প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকের বাইরে থেকে ২৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট ঋণ নেওয়া হয়েছিল ৭ হাজার ৯০ কোটি টাকা।
শুক্রবার (৭ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
আরো পড়ুন:
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্ক
ফেব্রুয়ারিতে ২০০০ কোটি টাকার নিট ডিপোজিট প্রবৃদ্ধি অর্জন
কিছু ব্যাংকের বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ: গভর্নর
গত সপ্তাহে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা, যা এর আগের গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ গুণ বেশি। ওই সময়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৫৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগের সরকারের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতেই চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার কোনো ঋণ নেয়নি, বরং গত জুলাই-ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৫৮ হাজার ১১৬ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সরকার বিশেষ বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে সার ও বিদ্যুৎ বিল বাবদ ১২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরে এ বাবদ ৩৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছিল সরকার।
অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের সরকারি সিকিউরিটিজ কেনার আগ্রহ বাড়ার কারণেও ঋণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ২৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ায় সরকারের ব্যাংক-বহির্ভূত মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ১৩০ কোট টাকা।
সাধারণত সরকার সঞ্চয়পত্র ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংক-বহির্ভূত উৎস থেকে ঋণ নেয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেড়েছে। সে জন্য চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ না বেড়ে উল্টো তা ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা কমেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী, পুরো অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার। তার মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে ৯৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক–বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেবে। যদিও অর্থবছরের প্রথমার্ধেই ব্যাংক–বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ পুরো বছরের পরিকল্পনার চেয়ে ৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ বেশি নিয়ে ফেলেছে।
ঢাকা/এনএফ/এসবি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ল ই ড স ম বর সরক র র ন ট ঋণ ঋণ ন য়
এছাড়াও পড়ুন:
বেসরকারি ঋণ তলানিতে, তবে ঋণপত্র খোলায় গতি
প্রবাসী আয়ের পর দেশের অর্থনীতির সূচকে আরেকটি ইতিবাচক যাত্রা শুরু হয়েছে। পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র খোলা বেড়ে গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণপত্র খোলায় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ১৮ শতাংশ। আর চলতি (২০২৫-২৬) অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে, অর্থাৎ গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ঋণপত্র খোলা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলাও বেড়েছে।
এদিকে ঋণপত্র খোলা বাড়লেও বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমে আসছে। গত আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে। গত বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ফলে বাড়তি ঋণপত্র কারা খুলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, এটা অর্থনীতির জন্য ভালো বার্তা। এর মাধ্যমে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দেখতে পাচ্ছি। নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা কেটে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোটা আরও বেগবান হবে—মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডিবাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, গত অর্থবছরে পণ্য আমদানি তলানিতে নেমে গিয়েছিল। সেখান থেকে গত জুলাই থেকে কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। এ কারণে ঋণপত্র খোলার প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। তবে প্রকৃতপক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রে প্রতিবছর কিছু ছোট ছোট যন্ত্র সংযোজন করতে হয়। এসব পণ্য আসা বেড়েছে। এ ছাড়া এখন মৌসুম না থাকায় প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করছে বড় শিল্পগ্রুপগুলো। পাশাপাশি সরকারি চাল ও গম আমদানি হচ্ছে। এসব কারণে খাদ্যপণ্যে ঋণপত্র খোলা বেড়েছে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা এখনো ফেরেনি।
আমদানি ঋণপত্র পরিস্থিতিবাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঋণপত্র খোলায় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ১৮ শতাংশ ও ঋণপত্র নিষ্পত্তিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। গত অর্থবছরে আমদানি হয় ৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় যা ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমে ২৫ শতাংশ, মধ্যবর্তী পণ্যের নিষ্পত্তি কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এ ছাড়া ভোগ্য পণ্যের ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ভোগ্যপণ্যের ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৫৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪৭ কোটি ১৬ লাখ ডলারের, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া আলোচ্য সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য, পেট্রোলিয়াম, শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি ঋণপত্র খোলা বেড়েছে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অর্থনীতির গতি বাড়াতে আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়লে কলকারখানার চাকা বেশি ঘুরবে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অর্থনীতিতে গতি ফিরে আসবে।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, কিছু কারখানা ভালো ক্রয়াদেশ পাচ্ছে। এ ছাড়া পুরোনো অনেক কারখানা আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এ জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কিছুটা বেড়েছে। এখন দেশে খাদ্য উৎপাদনের মৌসুম নয়। এ জন্য বেসরকারি শিল্পগ্রুপগুলো প্রচুর খাদ্যপণ্য আমদানি করছে। এতে ঋণপত্র খোলা বেড়েছে।
বেসরকারি ঋণ তলানিতেগত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির সমর্থিত অনেক ব্যবসায়ী পালিয়ে গেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ব্যাংকমালিকদের সংগঠনের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী। পাশাপাশি শেখ হাসিনার পরিবারসহ ১১টি শিল্পগ্রুপ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। ফলে তাদের ব্যবসার গতি ধীর হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদ বদলে দেওয়ার ১৫টি ব্যাংকঋণ কার্যক্রমও কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে একীভূত হতে যাওয়া ৫ ব্যাংকঋণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে তাই ব্যবসা-বাণিজ্য গতি হারিয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশে নেমেছে। গত জুলাই মাসে যা ছিল ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণপত্র খোলা বেড়েছে, এটা অর্থনীতির জন্য ভালো বার্তা। এর মাধ্যমে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস দেখতে পাচ্ছি, তবে সেটা পুরোপুরি না। বিনিময় হার স্থিতিশীল ও রিজার্ভ বাড়ায় আমদানি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি এখনো বেশি থাকায় সুদের হার কমছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে আছে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা কেটে গেলে ঘুরে দাঁড়ানোটা আরও বেগবান হবে।’