রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় না থাকলেও মাঠে সোচ্চার। আর ক্ষমতার লক্ষ্যে তোড়জোড় থাকাটা স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার এই লড়াইয়ের চিত্র-চরিত্র কেমন? মত-ভিন্নমত প্রকাশের ভঙ্গি কি স্বাভাবিক? মানুষ কী বার্তা পাচ্ছে তাদের বক্তব্য-বিবৃতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে?
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বিদায়ের কৃতিত্ব দাবি সবাই করে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনেও সবাইকে একমত হতে দেখা গেছে। কিন্তু এর পরই দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। দলীয় রাজনীতির বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ প্রশ্নে তাদের মত ও পথের ভিন্নতা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। এই ভিন্নতা এতই বেশি যে, মনে হতে পারে অভিধানের শব্দ হযবরল-কে বদলে দিয়ে নতুন শব্দ আবিষ্কার করতে হবে। এই হযবরল অবস্থা গোটা রাজনীতিকে এখন গিলে খাচ্ছে। মনে হতে পারে, লক্ষ্যহীন পথের যাত্রী সবাই। একজন একটা বিষয়ে যা বলে আরেকজন উল্টোটা, একজন একটা সুপারিশ করলে কালক্ষেপণ না করে আরেকজন তার উল্টোটা বলে দিচ্ছে।
মোটামুটিভাবে এই পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো অনেকটা সমান্তরালে চলতে থাকে। সংস্কার প্রস্তাব আসার সঙ্গে সঙ্গে মতপার্থক্যগুলো বাড়তে থাকে। যেমন সংবিধান সংশোধন, নাকি পুনর্লিখন হবে– এ বিতর্ক শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপিত করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সংবিধানকে কবর দেওয়ার কথা বলে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে ক্ষুব্ধ করে দেয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তারা। একসময় সংবিধান সংস্কার কমিটি সংস্কার, নাকি নতুন রচনা– এমন শব্দ উচ্চারণ ব্যতিরেকে সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলো পরিবর্তন এমনকি দেশের নামও পরিবর্তনের প্রস্তাব করে প্রতিবেদন জমা দেয়।
বোধ করি দলগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিতর্ক হয়েছে সংবিধান প্রশ্নেই। যা একসময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অঘোষিত নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়াই শব্দ লড়াইয়ের মুখে পড়ে। এই সংস্কার চালানোর অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। আলোচনার পক্ষ-বিপক্ষ তখন বহুমুখী হয়ে পড়ে। সরকার পক্ষ তাদের দায়িত্বকাল নিয়ে যা বলছে, তাও বিএনপির মনঃপূত হয় না। সংস্কার কর্মসূচি নিয়েও তাদের আপত্তি দেখা দেয়। লড়াইটা তখন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও চলতে থাকে। বিএনপি দাবি করে সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বলতে থাকেন বিএনপি চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব কায়েম করেছে। এর মধ্যে তৃতীয় ধারার কিছু মানুষ বলতে থাকে– চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের, সুতরাং ওমুক এটা করছে তমুক এটা করছে, এমনটা বলে দায়মুক্ত থাকার সুযোগ নেই।
দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থেকে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব যে মানুষের জন্য পীড়াদায়ক, তা এদের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এবার নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল কিংবা ব্যর্থ, সেটি ভিন্ন বিষয়।
কাদা ছোড়াছুড়ির মাত্রাটা একটু বেশি হওয়ার পরই প্রধান উপদেষ্টা সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন। সেখানে দু-একটি দল যোগদানে বিরত থাকে। বৈঠকের পূর্বক্ষণেও মানুষের প্রশ্ন ছিল বৃহত্তম দল বিএনপি বৈঠকে যোগ দেবে তো? সর্বশেষ একজন সাংগঠনিক সম্পাদক দলের প্রতিনিধিত্ব করে মান রক্ষা করেছেন। কিন্তু কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আহূত বৈঠকে দলের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিনিধিত্ব করার অর্থ কি দূরত্ব বুঝিয়ে দেওয়া? তবে বৈঠকে অংশ নেওয়া সাংগঠনিক সম্পাদক মনে করিয়ে দিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন হতাশাজনক। এই বিষয়টি অনুধাবন করেই প্রধান উপদেষ্টা যে বৈঠক ডেকেছেন, তা সবাই বুঝতে পেরেছে।
কিন্তু নির্বাচন আগে, নাকি সংস্কার আগে কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে, নাকি জাতীয় নির্বাচন আগে– এমন বিতর্ক জীবন্তই রয়ে গেছে। সুরাহা হয়নি জুলাই আন্দোলনের প্রোক্লেমশনের প্রসঙ্গটিও। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, আন্দোলনে বিএনপিসহ অন্যান্য পক্ষের অংশগ্রহণের স্বীকৃতি প্রশ্নে প্রোক্লেমশন ঘোষণা আপাতত স্থগিত রয়ে গেছে। নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, আন্দোলনের আগেই যে ঘোষণাপত্র হওয়ার কথা ছিল, আন্দোলনের পাঁচ মাস পরও তা ঘোষণা হচ্ছে না কেন? তাহলে আন্দোলনের লক্ষ্য নয়, পক্ষগুলোর সুবিধা-স্বার্থই কি মূল বিষয় এখানে?
রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্য ট্যাগ লাগানোর বিষয়টিও আলোচনাযোগ্য। কেউ কিছু করলেই আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা আওয়ামী ট্যাগ লাগানো শুরু হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতির মাঠে থাকা প্রায় সবাই ট্যাগ চর্চা করে। মারামারি-চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব যেখানে সেখানেই আওয়ামী ট্যাগ লাগানোর প্রবণতা বেশি। এই যে একে অন্যের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে, এতে করে কি অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে? এমন প্রশ্ন যেমন আসছে, পাশাপাশি জনমত ও জননিরাপত্তাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। এ থেকে বাঁচার পথ নিশ্চয়ই রাজনৈতিক দলগুলোর অজানা থাকার কথা নয়। তারা যদি নিজ উদ্যোগে অভিন্ন লক্ষ্য নির্ধারণ করে তাহলে হয়তো সংস্কার ও নির্বাচন দুটো লক্ষ্যই অর্জন সহজতর হবে।
মোস্তফা হোসেইন: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ষমত সরক র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম আলোর সাংবাদিককে বৈষম্যবিরোধী নেতার হুমকি, থানায় জিডি
প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেনকে ফেসবুকে হুমকি দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মুখ্য সংগঠক মোত্তাসিন বিশ্বাস। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টে এ হুমকি দেন তিনি।
এ ঘটনায় গতকাল রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন আনোয়ার হোসেন।
ফেসবুক পোস্টে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনের দুটি ছবি লাল দাগ দিয়ে ক্রস চিহ্ন দেন মোত্তাসিন। ক্যাপশনে তিনি আনোয়ার হোসেনের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘....সত্য লিখুন, না হলে আপনিও ছাড় পাবেন না। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’
মোত্তাসিন বিশ্বাসের পোস্টের পর মন্তব্যের ঘরে আনোয়ার হোসেনকে একাধিক আইডি থেকে মারধরের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে আজ বুধবার বেলা ৩টা ১৬ মিনিটে মোত্তাসিনের আইডি থেকে পোস্টটি সরিয়ে নেওয়া হয়। ঘণ্টাখানেক পর পোস্টটি তাঁর ওয়ালে আবার দেখা যায়। এ হুমকির প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ’।
ফেসবুক পোস্টের বিষয়ে জানতে চাইলে মোত্তাসিন বিশ্বাস আজ বেলা সাড়ে তিনটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুক পোস্টে হলুদ কথাটা লেখা ঠিক হয়নি। এটি গত শনিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের শহীদ সাটু অডিটরিয়ামে জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে থামিয়ে দেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘পুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ খবরের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েই এমন পোস্ট করেছেন বলে জানিয়েছেন মোত্তাসিন।
তাৎক্ষণিকভাবে লিখে ফেলেছিলেন, পরে মুছে দিয়েছেন। আনোয়ার হোসেনের করা কোন সংবাদটির বিষয়ে পোস্ট করেছেন, জানতে চাইলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাকে বাধা দেওয়ার সংবাদটির কথা জানান।
মোত্তাসিন বিশ্বাস আরও বলেন, প্রথম আলোর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন চব্বিশের আন্দোলনে তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু সংবাদটি এভাবে কেন লিখেছেন, তা জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি তাঁদের এড়িয়ে গেছেন। সে জন্যই তিনি ফেসবুকে লিখেছেন।
আনোয়ার হোসেন জিডিতে উল্লেখ করেছেন, স্ট্যাটাসে তাঁর দুটি ছবি ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। ওই পোস্টে মোত্তাসিনের অনুসারীসহ আরও অনেকে খারাপ মন্তব্য করে তাঁকে হুমকি দিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়ায় জিডি করার কথা জানান তিনি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন। এটি একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আহ্বায়ক আবদুর রাহিম বলেন, এই পোস্ট দেওয়ার পর রাতে তাঁরা এটি নিয়ে সভা করেছেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, পোস্টটি ডিলিট করা হবে।
আরও পড়ুনপুলিশের সুধীসমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে জামায়াত নেতার বাধা২৭ এপ্রিল ২০২৫সাংবাদিক সমাজের নিন্দা-প্রতিবাদআনোয়ার হোসেনকে হুমকি দেওয়ার ঘটনায় জরুরি সভা করে ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লিখিতভাবে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গতকাল মঙ্গলবারের সভায়। অবহিত করার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাবতীয় সংবাদ বর্জন করা হবে বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (সিটিজেএ) সভাপতি রফিকুল আলম। উপস্থিত ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রেসক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিটিজেএর নেতা ও সদস্যরা।
সভার পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘পরিবর্তিত বাংলাদেশে একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে আপত্তিজনক ও হুমকিস্বরূপ বক্তব্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। যেসব অধিকারের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান হয়, তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে বাক্স্বাধীনতার অধিকার। একজন পেশাদার সাংবাদিককে নিয়ে ফেসবুকে এমন পোস্ট সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর হস্তক্ষেপ, যা আমাদের উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত করেছে।’ অবিলম্বে মোত্তাসিন বিশ্বাস তাঁর দেওয়া পোস্টটি প্রত্যাহার করে দুঃখ প্রকাশ না করলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সাংবাদিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে বিবৃতিতে।