১৯৮০-এর দশকে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) ও তার করিতকর্মা চেয়ারম্যান আগা হাসান আবেদির সঙ্গে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্কটা যে কতটা বিশেষ, তা খুব কম মানুষই জানতেন।

এরশাদের আত্মীয়দের চাকরির প্রয়োজন হলে আবেদি গোপনে তাঁদের উচ্চ বেতনে বিসিসিআইয়ের হংকং, ব্রিটেন ও কানাডা শাখায় নিয়োগ দিতেন। এরশাদও প্রতিদান দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ ব্রুনেইয়ের লাভজনক ব্যাংকিং খাতে ব্যবসা করতে আবেদির কূটনৈতিক আশ্রয়ের প্রয়োজন হলে এরশাদ সেই দেশে নতুন দূতাবাসই খুলে বসলেন এবং ব্যাংকের একজন ডাকসাইটে কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেন। সে জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ ব্যয় হলো। বাস্তবতা হলো, ওই দূতাবাস কার্যত বিসিসিআইয়ের বিক্রয় কার্যালয় হিসেবেই মূলত ব্যবহৃত হয়, ঠিক দূতাবাস হিসেবে নয়।

এরপর ক্ষমতায় শেষ দিকে বিদেশি সহায়তার কমিশন ও কোটি কোটি ডলার অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করার জন্য এরশাদের সহায়তা প্রয়োজন হলে এগিয়ে আসেন সেই আবেদি।

অর্ধশতাধিক দুর্নীতির মামলায় ক্ষমতাচ্যুত এরশাদের তখন বিচার চলছিল। সরকারের প্রধান কৌঁসুলির তথ্যানুসারে, বিসিসিআই নিজের আন্তর্জাতিক ব্যাংক শাখার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইউরোপ, কানাডা, ক্যারিবীয় অঞ্চল ও দূর প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে এরশাদের ব্যাংক হিসাবে এসব অর্থ পাঠিয়েছে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল ইসলাম (তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল) দুঃখ করে বলেছেন, ‘এরা দুজনেই দেশকে লুণ্ঠন করেছে।’ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি প্রথমবার এরশাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগের বিষয়ে সবিস্তার বলেছেন, অর্থাৎ কীভাবে বিসিসিআইয়ের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এই বিসিসিআই ব্যাংকটি পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য। সব দুর্নীতিবাজ ও পাচারকারীর ব্যাংকিং সেবা দিত বিসিসিআই। আমাদের দেশ ধ্বংসে তারা মদদ দিয়েছে।’

কে এই আবেদি

পাকিস্তানি নাগরিক আগা হাসান আবেদির নিজস্ব একটা স্টাইল ছিল—ভাবখানা এমন ছিল যে তিনি নানা জনদরদি কাজের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বকে উদ্ধার করছেন। কিন্তু দ্য টাইমসের হাতে আসা বিভিন্ন নথি ও বিসিসিআইয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, এই ব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করেছে। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস আগা হাসান আবেদিকে বিপণনের জাদুকর হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে। বিশ্বের ৭০টির বেশি দেশে এই ব্যাংক গরিবের কল্যাণে নিয়োজিত বলে প্রচারণা চালানো হতো।

সংবাদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে বিসিসিআই ব্যাংকিং আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা নিয়েছে—সরকারকে কর না দেওয়া থেকে শুরু করে দেশ থেকে যত পরিমাণ মুনাফা নিয়ে যাওয়া সম্ভব তা নেওয়া। মুনাফার এই অর্থ ব্যাংকটি তাদের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন করপোরেশন ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিতে নিয়ে গেছে। তদন্তে উঠে আসছে, সেই অর্থ ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাঁদের বন্ধুদের ভোগে গেছে।

১৯৯০ সালে গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এরশাদ সরকারের পতন ও বিশ্বব্যাপী বিসিসিআই ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এখন টের পাওয়া যাচ্ছে, তারা কীভাবে মানুষকে শোষণ করেছে। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে তারা এভাবেই কাজ করেছে। ব্যাংকটির সাবেক এক কর্মকর্তার ভাষায়, তারা ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট—রবিন হুডের ঠিক উল্টো। রবিন হুড ধনীদের কাছ থেকে অর্থ কেড়ে গরিবদের দিত—তারা গরিবদের অর্থ কেড়ে নিয়ে ধনীদের দিত।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে শাখা খোলার কয়েক বছরের মধ্যে ব্যাংকটি দেশ থেকে ১২ মিলিয়ন বা ১ কোটি ২০ লাখ ডলার মুনাফা নিয়ে যায়।

বিসিসিআইয়ের কুটিল পরিকল্পনা

কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পুঁজি পাচার রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি বাড়ানোর চাপ দিলে লন্ডনে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্তারা কুটিল এক পরিকল্পনা করেন। কর ফাঁকি দিতে তাঁরা পৃথক একটি ব্যাংক চালু করেন।

প্রথমত, বিসিসি ফাউন্ডেশন গঠন করে বিসিসিআই। গরিব ছাত্রদের বৃত্তি দিতে মূলত এই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। তার সঙ্গে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও বিদ্যালয়ে পাঠাগার তৈরিতে অনুদান দিত তারা। ব্যাংকটির বাংলাদেশ শাখার পরিচালন মুনাফা থেকে এর অর্থায়ন করা হয়েছে। এর বিপরীতে তাদের কার্যক্রম কার্যত কর মওকুফ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিসিসিআইয়ের মুনাফার ১০ শতাংশেরও কম জনদরদি কাজে ব্যয় হতো। ঠিক তারা যে কায়দায় পাকিস্তানে কর ফাঁকি দিত, বাংলাদেশেও সেই কায়দা করেছে। বাংলাদেশের বিসিসি ফাউন্ডেশন যে পরিমাণ সুদ আয় করত, তার চেয়ে অনেক কম পরিমাণ অর্থ জনদরদি কাজে ব্যয় করত।

ফাউন্ডেশনর মূল কর্মসূচি ছিল মেধা সহায়ক কর্মসূচি। এর মাধ্যমে দরিদ্র কলেজছাত্রদের সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হতো। এই কার্যক্রমের আওতায় ১৯৯০ সালে মাত্র ৪ লাখ টাকা বা তৎকালীন ১০ হাজার ৫০০ ডলার অনুদান দেওয়া হয়েছে। অথচ ফাউন্ডেশন নিজে ১০ মিলিয়ন বা ১ কোটি টাকা সুদ আয় করেছে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ফাউন্ডেশনের সবচেয়ে বড় অঙ্কের অনুদান জনদরদি কাজে দেওয়া হয়নি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তারা নিজেরাই সেই টাকা নিয়েছে। ব্যাংক অব স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স বা বেসিক ব্যাংক গঠনে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা ১৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে তারা। সেই ব্যাংকের কর্মকর্তারা ছিলেন প্রায় সবাই বিসিসিআই থেকে আসা। ফাউন্ডেশনের এমন লাভজনক কাজে বিনিয়োগ সরকার কেবল আইনি স্বীকৃতিই দিল না, বরং স্বৈরশাসক এরশাদ ও তাঁর আর্থিক উপদেষ্টা সেই ব্যাংকে বিনিয়োগ করেন। তাঁরা ব্যাংকের এক-তৃতীয়াংশ মালিকানা কিনে নিয়ে তারল্য জোগান দেন।

বিসিসিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, এরশাদ নিজে বেসিক ব্যাংককে লাইসেন্স দিয়েছেন, যেখানে অন্যান্য ব্যাংকের লাইসেন্স আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালে বেসিক ব্যাংকের জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজে উপস্থিত ছিলেন। এই বিনিয়োগের ন্যায্যতা প্রমাণে ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা বলেন, নতুন ব্যাংককে অবশ্যই সব মুনাফা ফাউন্ডেশনে ফেরত দিতে হবে। কিন্তু তাঁরা স্বীকার করেছেন, কার্যত ব্যাংকের সব মুনাফা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যয় হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ফাউন্ডেশনের পর্ষদ নিয়েছে, যাদের সঙ্গে বিসিসিআই পর্ষদের কার্যত পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ছিল শত শত কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়া।

সরকার ও বিসিসিআই একাকার

শুধু এরশাদ নয়, বিসিসিআইয়ের কাছ থেকে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই লাভবান হয়েছেন। ফলে রাজনৈতিক আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকটিকে বেগ পেতে হয়নি। এরশাদের জমানায় তাঁর তিনজন জামাতা ব্যাংকে কাজ করেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে ব্যাংকটিতে রাজনৈতিক নিয়োগ শুরু হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এত বেশিসংখ্যক রাজনৈতিক নিয়োগ হয়েছে যে বিসিসিআই ও সরকারের ভেদরেখা একরকম মুছে যায়।

যে দুই দশক তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বিসিসিআই ব্যবসা করেছে, ওই সময় তারা প্রতিটি দেশেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের দু–একজন বা তাঁদের আত্মীয়দের নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সংখ্যা ১৫-এর কম নয়। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশপ্রধান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজন এই ব্যাংকে কাজ করেছেন।

এ নিয়োগের মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে বিসিসিআইয়ের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়। সরকার ও বিসিসিসিআই যে একাকার হয়ে গিয়েছিল, তার সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ হচ্ছে ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জামাতা ইফতেখার করিমকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া।

ইফতেখার করিম তখন ফ্রান্সের প্যারিসে বিসিসিআইয়ের নির্বাহী হিসেবে কাজ করছিলেন। কিন্তু আবেদির ব্যক্তিগত অনুরোধে এরশাদ ইফতেখারকে শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিলেন না, তাঁকে ব্রুনেইয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন। বিষয়টি হলো, বিসিসিসিআই তখন ব্রুনেইয়ে শাখা খোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। তারা মূলত সুলতানের ২৫ বিলিয়ন ডলার সরকারি তহবিলের ভাগ নিতে মরিয়া।

কিন্তু করিম শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন। সেখানে চারটি ব্রিটিশ ব্যাংক আগে থেকেই সুলতানের পেছনে লাইন ধরে ছিল। ফলে তাদের ডিঙিয়ে বিসিসিআইয়ের পক্ষে সেই তহবিল জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। করিম নিজে খুব ভালো ব্যাংকার ছিলেন, কিন্তু তারপরও বিষয়টি ছিল অসম্ভব। অন্যদিকে করিমের বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। এই কাজটি যে এরশাদ আবেদিকে খুশি করতে করেছিলেন, সেটা তখন সবাই জানলেও মুখে বলতে সাহস পেতেন না।

এরশাদ পতনের পর এসব ঘটনা জানাজানি হয় এবং বিসিসিআই বাংলাদেশের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধের সময় ব্যাংকে ১৫ হাজার বাংলাদেশের আমানত আটকা পড়ে। এরপর বিভিন্ন তদন্তে এরশাদের সঙ্গে আবেদির বিশেষ সখ্যের বিষয়গুলো জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।

ওই সময় খালেদা জিয়ার সরকার এরশাদের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে নিউইয়র্কের একটি আর্থিক তদন্তকারী ফার্মকে নিয়োগ দেয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব স স আই ব য ব স স আইয় র কর মকর ত র র জন ত ক সরক র র এরশ দ র র কর ম ক জ কর কর ত র পর ম ণ ক র যত ব যবস তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

ইউটিউবে ভুয়া ‘টক শো’র ছড়াছড়ি, বিভ্রান্ত মানুষ

এক পাশে বেগম খালেদা জিয়া, অন্য পাশে শেখ হাসিনা, মাঝখানে খালেদ মুহিউদ্দীন—ইউটিউবে একটি ‘টক শো’তে তিনজনকে এভাবেই দেখা যায়। যদিও বিষয়টি পুরোটাই ভুয়া।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা কখনোই সুপরিচিত উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীনের টক শোতে (আলোচনা অনুষ্ঠান) যাননি; কিন্তু ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

সুপরিচিত নবীন ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আলোচিত ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় বিশ্লেষক, সাংবাদিক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইনফ্লুয়েন্সার’দের নিয়ে এ ধরনের ভুয়া টক শো তৈরি করা হচ্ছে। তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাব বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ইউটিউবে এমন ভুয়া টক শো অনেক রয়েছে।

ইউটিউবে কারসাজি করে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। ব্যবহার করা হয়েছে খণ্ড খণ্ড ভিডিও চিত্র (ক্লিপ)। মনে হয়, যেন টক শোর অতিথিরাই কথা বলছেন।

ডিসমিসল্যাব ২৮৮টি ভিডিও পর্যালোচনা করেছে। তারা বলছে, অধিকাংশ ভিডিওতে মূল সাক্ষাৎকারগুলোকে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে গিয়ে কাটাছেঁড়া করে এমনভাবে বানানো হয়েছে, যা আদতে ঘটেনি। এসব ভিডিও গড়ে ১২ হাজারবার দেখা হয়েছে।

‘ভুয়া টক শোকে উসকে দিচ্ছে ইউটিউব, যেখানে আসল কনটেন্ট জায়গা হারাচ্ছে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন গতকাল বুধবার প্রকাশ করে ডিসমিসল্যাব। এতে বলা হয়, ভুয়া টক শোতে বিজ্ঞাপন প্রদর্শিত হয়। অর্থাৎ সেখান থেকে অর্থ আয়ের সুযোগের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইউটিউবের নিজস্ব নীতিমালা ভঙ্গ করে বানানো এ ধরনের ভিডিও প্রচার করে ইউটিউব নিজেও লাভবান হচ্ছে।

ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।

খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে বানানো ভিডিওটি পর্যালোচনা করে ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভিডিওতে দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে মুখ করে দুই নেত্রী অনলাইনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ‘ভার্চু৵য়াল টক শো’তে অংশ নিয়েছেন। যেখানে সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দীন শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান, ২০২৪ সালের আগস্টে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে; কিন্তু কিছুক্ষণ যেতেই দর্শক বুঝবেন, ভিডিওটি ভুয়া। খালেদা জিয়ার নড়াচড়া স্বাভাবিক না। শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বর তাঁর মুখভঙ্গির সঙ্গে মিলছিল না। খালেদার ভিডিও ফুটেজ বিকৃত বা টেনে লম্বা করা হয়েছে। উপস্থাপকের হাতের অঙ্গভঙ্গি বারবার একই রকম দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে ক্লিপ কেটে জোড়া লাগিয়ে কথোপকথন তৈরি করে এই ভুয়া টক শো বানানো হয়েছে।

এ ধরনের ভুয়া টক শো অনেকে বিশ্বাস করেন, যার ফলে সমাজে বিভাজন তৈরি হয় এবং রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ওপর প্রভাব পড়ে।ডিজিটালি রাইটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ আহমেদ চৌধুরী

ডিসমিসল্যাব জানায়, ভুয়া টক শোটি চলতি মাসের শেষ নাগাদ ফেসবুকে দুই লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির ওপর একটি লোগো ছিল ‘টক শো ফার্স্ট নিউজ’ নামে, যা একই নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে মিলে যায়। সেখানে একই ভিডিওটি আরও ১ লাখ ৩৫ হাজারবার দেখা হয়েছে। ওই চ্যানেলে এমন বেশ কিছু ক্লিপ ছিল, যা একইভাবে বিকৃত বা সাজানো হয়েছিল।

প্রবাসী সাংবাদিক খালেদ মুহিউদ্দীন ইউটিউবে ‘ঠিকানায় খালেদ মুহিউদ্দীন’ নামে একটি চ্যানেলে টক শো উপস্থাপনা করেন। সম্প্রতি তাঁর ছবি, ফুটেজ ব্যবহার করে বিভিন্ন ক্লিপ যুক্ত করে প্রচুর ভুয়া টক শো তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। ডিসমিসল্যাব এ বিষয়ে গবেষণা করেছে। তারা ইউটিউবে ‘খালেদ মুহিউদ্দীন টক শো’ লিখে খোঁজ করে অন্তত ৫০টি চ্যানেল চিহ্নিত করেছে। খালেদ মুহিউদ্দীন ছাড়াও এসব চ্যানেলে অন্যান্য উপস্থাপক ও রাজনৈতিক বক্তাদের বিভিন্ন বক্তব্যের ক্লিপ জুড়ে দিয়ে ভুয়া টক শো তৈরি করা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ থেকে ৩১ মার্চে খুঁজে পাওয়া এসব চ্যানেলের মধ্যে ২৯টি চ্যানেল অন্তত একটি বিকৃত টক শো প্রচার করেছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, চিহ্নিত ২৯টির মধ্যে ২০টি চ্যানেল তৈরি হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাকি চ্যানেলগুলো ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি। পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

পর্যালোচনা করা ভিডিওগুলোতে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ (নেপথ্যের দৃশ্য) বদলানো, ফুটেজ কাটাছেঁড়া বা জুম করা এবং মূল প্রসঙ্গ বিকৃত করা হয়েছে। অধিকাংশ ভিডিও ইউটিউব, টেলিভিশন শো, ফেসবুক লাইভ এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে ক্লিপ জোড়া লাগিয়ে তৈরি। অনেক ক্ষেত্রে, মূল বক্তার ফুটেজে এমন ভয়েসওভার (কথা) জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যা ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে নেওয়া এবং যার সঙ্গে কথোপকথনের কোনো সম্পর্ক নেই; কিন্তু বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত একটি ভিডিওর শিরোনাম ছিল, ‘ড. ইউনূস চীন সফরের পরপরই পদত্যাগ করলেন’। যেখানে যমুনা টিভির লোগো ব্যবহার করা হয়। যমুনা টিভির সঙ্গে ডিসমিসল্যাব যোগাযোগ করে জানতে পারে যে তাদের অনুমতি ছাড়া লোগো ব্যবহার করা হয়েছে। ভিডিওটিতে উপস্থাপক খালেদ মুহিউদ্দীন এবং রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনির আলাদা আলাদা ফুটেজ জোড়া লাগানো হয়েছে।

ডিসমিসল্যাব বলছে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলের নেতা ফজলুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না, এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের ফুটেজও এসব ভুয়া টক শোতে ব্যবহার করা হয়েছে।

পর্যালোচনার আওতায় আসা ভিডিওগুলোর মধ্যে অন্তত ৫৮ জন রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও টক শো উপস্থাপকের ছবি, ফুটেজ বা বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে।

ভুয়া টক শোর বিষয়ে ডিসমিসল্যাবকে খালেদ মুহিউদ্দীন বলেন, তিনি দর্শকদের তাঁর ভেরিফায়েড ইউটিউব চ্যানেলের আধেয়র ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান।

ডিসমিসল্যাব বলেছে, ভুয়া টক শোগুলোতে বক্তব্য তুলে ধরা হয় মূলত রাজনৈতিক দল ও সরকারকে নিয়ে। ভুয়া টক শোগুলোর ৪০ শতাংশেই অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) সমালোচনা করে তৈরি করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভুয়া টক শো। বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য রয়েছে ১০ শতাংশ করে ভুয়া টক শোতে।

বেশিবার দেখা হয়েছে, এমন পাঁচটি ভুয়া টক শো খুঁজে বের করেছে। এসব টক শোতে প্রচার করা হয়েছে অশনিবার্তা, আলোর রাজনীতি ও রাজনৈতিক আলোচনা নামের ইউটিউব চ্যানেল থেকে। পাঁচটি টক শো দুই থেকে ছয় লাখ বার দেখা হয়েছে।

নিজের নিয়মই মানছে না ইউটিউব

ইউটিউবের স্প্যাম ও প্রতারণামূলক আচরণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, এমন শিরোনাম, থাম্বনেইল বা বিবরণ ব্যবহার করা যাবে না, যার সঙ্গে ভিডিওর প্রকৃত বিষয়বস্তুর মিল নেই এবং যা দর্শকদের বিভ্রান্ত করে। এসব ভুয়া টক শোতে এ নীতি মানা হয়নি।

ইউটিউবের ছদ্মবেশ ধারণ নিষেধাজ্ঞা নীতিমালায় বলা আছে, অন্য কারও আসল নাম, ব্যবহারকারী নাম, ছবি, ব্র্যান্ড, লোগো বা ব্যক্তিগত কোনো তথ্য ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুমতি ছাড়া সাংবাদিক, টক শো উপস্থাপক ও কনটেন্ট (আধেয়) নির্মাতাদের ফুটেজ ব্যবহার করায় এগুলো ইউটিউবের কপিরাইট নীতিমালাও লঙ্ঘন করতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া–বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নিজস্ব নীতিমালা থাকলেও ইউটিউব এ ধরনের ভুয়া ভিডিওকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। এতে গুণগত সাংবাদিকতা পিছিয়ে পড়ে।

২০২২ সালে একটি খোলাচিঠিতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্টচেকিং নেটওয়ার্ক অভিযোগ করেছিল, ইউটিউব তাদের প্ল্যাটফর্মকে অপব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে—যেখানে অসাধু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বিভ্রান্তি ছড়ানো, মানুষকে প্রতারিত করা, এমনকি সংগঠিত হয়ে অর্থ সংগ্রহ পর্যন্ত করছে।

মিরাজ আহমেদ চৌধুরী বলেন, এ ধরনের ভুয়া কনটেন্ট বা আধেয় বন্ধ করতে প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব নীতি মনে করিয়ে দিয়ে তাদের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ