বাংলাদেশে বিগত শাসনামলে করিডোর একটি অপছন্দের শব্দ ছিল জনপরিসরে। বলা হতো, ভারতকে করিডোর দিলে বহুভাবে লাভবান হবে দেশ। স্থল করিডোর দিয়ে চলাচলকারী ভারতের গাড়ির চাকায় হাওয়া দিয়ে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ এগিয়ে যেতে পারে বলেও স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন অনেকে। কেউ কেউ বলেছেন, করিডোর দেওয়া হলে আন্তঃনদীর পানি পাওয়া যাবে। ‘পানির বিনিময়ে করিডোর’ নামে একটি চোরাগোপ্তা তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তখন।

শেষ পর্যন্ত ভারত জল-স্থল বহুপথে করিডোর পেয়েছিল, কিন্তু পানি পায়নি বাংলাদেশ। জল-স্থল কোনো করিডোর থেকে আর্থিক সুবিধাও উল্লেখ করার মতো ছিল না। করিডোরকে ‘ট্রানজিট’ নাম দিয়ে বিনিময়ে পাঁচ বছর পরপর একটি দলের ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা মিলেছিল। 

চব্বিশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটার পর এবার নতুন করে দক্ষিণ সীমান্তে করিডোরের আলাপ এলো। জাতিসংঘ মহাসচিব সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে নতুন যে বিষয় এখানকার নাগরিক সমাজে ছড়ালেন, তা হলো আরাকানে (রাখাইন) ‘মানবিক সহায়তা’ পাঠাতে বাংলাদেশকে ‘চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার’ প্রসঙ্গ।
মহাসচিব সরাসরি করিডোর শব্দটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু রাখাইন বা আরাকানে ‘সাহায্য’ যেতে ‘চ্যানেল’ হওয়ার কারিগরি অর্থ করিডোরই দাঁড়ায়। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো সংগত কারণে ‘করিডোর’ শব্দটি ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে ভাষ্যকাররা এক ধাপ আগ বাড়িয়ে এটিও ভাবছেন, বাংলাদেশ আলোচিত এই করিডোর দিতে যাচ্ছে কিনা এবং এই করিডোর দিয়ে কার কাছে কী ধরনের ‘সাহায্য’ যাবে।

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব ও অধিকারী হলো বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সরকার বিস্তারিত কিছু বলেনি। হয়তো এ নিয়ে ভাবতে সময় নেবেন বাংলাদেশের কূটনীতিবিদরা। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। থাইল্যান্ডভিত্তিক ফোর্টিফাই রাইটস নামে একটি সংস্থা এ বিষয়ে প্রচারেও নেমেছে। ফলে জাতিসংঘ মহাসচিবের আসা বা তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো; এখানে এসে তাঁর মুখ থেকে এ রকম প্রস্তাব এবং এ সফরের আগেই সেই প্রস্তাবের পক্ষে বিভিন্ন সংস্থার সমর্থন ব্যাপক কৌতূহল ও আঁচ-অনুমান তৈরি করছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকারের আমলে কেন এ রকম একটি প্রস্তাব এলো; কেন এটি বিগত সরকারের সময়ে আসেনি বা কেন গুতেরেস তা আগামী নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষায় রাখলেন না– সেসবও আছে প্রশ্ন আকারে।

আবার এমন সময়ে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর কথা ওঠানো হলো যখন সেখানে রোহিঙ্গারা প্রায় বিতাড়িত; ৮০-৯০ শতাংশ এলাকা রাখাইন গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনে মানবিক ও অবকাঠামো সহায়তা চাইছে মূলত আরাকান আর্মি। তারা সেটা বিশেষভাবে বাংলাদেশের কাছেই চায়। বাংলাদেশ ওষুধের মতো কিছু মানবিক সহায়তা অনানুষ্ঠানিকভাবে সীমান্তের ওদিকে পাঠিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক পরিসরে খবর বের হয়েছিল বিগত সময়ে। আন্তর্জাতিক মহল রাখাইনে সহায়তা করতে চাইলে আরাকান আর্মি সেটাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বলেও জানা যায়। সে রকম সহায়তা সমুদ্রপথে সেখানে পৌঁছানো কঠিন কিছু নয়। রাখাইনের রয়েছে দীর্ঘ উপকূল।

আবার ইউএস-এইড বন্ধ হলেও মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অনেক সাহায্য সংস্থার উপস্থিতি রয়েছে। তাদের মাধ্যমেও সাহায্য পাঠানো যায়। সে জন্য হয়তো জান্তা সরকারের অনুমতি ও সংশ্লিষ্টতা লাগবে। এসব বিকল্প বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে ‘চ্যানেল’ তথা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে সাহায্য পাঠানো হলে আরাকান আর্মি আপত্তি না করলেও মিয়ানমার সরকার ভিন্নমত পোষণ করতে পারে। প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি মিয়ানমার সরকারের আপত্তির মুখে রাখাইনে করিডোর হবে? হলে সেটা কি ঠিক হবে? মিয়ানমারের আপত্তি কিন্তু চীনের কাছে বেশ কদর ও সহানুভূতি পাবে। এর কারণ শুধু উভয় দেশের শাসকদের বন্ধুত্ব নয়; চীনের ভূরাজনৈতিক স্বতন্ত্র বিবেচনাও বটে। 

বঙ্গোপসাগরের আশপাশে চীন-ভারত উভয়ে তৃতীয় ‘আন্তর্জাতিক’ মহলের জন্য করিডোরকে যে সন্দেহের চোখে দেখতে পারে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতজনিত বিবেচনার বাইরেও রাখাইনে তাদের উভয়ের বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। এসব বিনিয়োগের দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা নিয়ে এশিয়ার এ দুই পরাশক্তি এই মুহূর্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে দরকষাকষিতে লিপ্ত। তাদের জন্য এটি এক গুরুতর নিরাপত্তা প্রশ্নও বটে। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে রুশ সরকারের সুসম্পর্ক মিয়ানমার প্রশ্নে সম্প্রতি চীনকে বাড়তি সতর্ক করেছে।

ঠিক এ রকম সময়ে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর রাখাইনমুখী (‘মানবিক’!) করিডোর প্রস্তাব নিশ্চিতভাবে মিয়ানমারের মতো ভারত ও চীনের রাজধানীতেও চাঞ্চল্য বাড়িয়েছে।
সন্দেহ নেই– যুদ্ধবিধ্বস্ত রাখাইনে সহায়তা প্রয়োজন। রাখাইনকে ছোটখাটো সিরিয়া-লিবিয়াও বলতে পারি আমরা। সেখানে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা আছে। নিয়মিত গোলাগুলিও চলছে। এই রকম জনপদে মানবিক সহায়তার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে চলে আসে সামরিক প্রসঙ্গ। কথিত মানবিক সহায়তা অনেক সময় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর কারও অবস্থান শক্তিশালী; কারও অবস্থান করে দুর্বল। এ কারণে বহুকাল যুদ্ধ চলমান এমন জনপদে ‘আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা’র ধারণাটা বেশ স্পর্শকাতর।

বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের সরকার ও কূটনীতিবিদদের এসব অজানা নেই। সে জন্যই প্রশ্ন উঠছে– নির্বাচিত সরকারহীন অবস্থায় এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলার চলতি টালমাটাল সময়ে বাংলাদেশ এ রকম পদক্ষেপে সহায়তা করতে পারে কিনা। এ প্রশ্নও আছে, বিশেষ করে জাতিসংঘ নামে প্রতিষ্ঠানের ওপর ইউরোপ-আমেরিকার যে ব্যাপক প্রভাব এবং মিয়ানমার বিষয়ে তাদের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার যে মতদ্বৈততা দেখা যায়, সে পটভূমিতে রাখাইনমুখী করিডোরে সব পরাশক্তির ঐকমত্য থাকবে বলে আমরা কি আশা করতে পারি? আবার সে রকম ঐকমত্য না হলে বাংলাদেশের করিডোর যে কূটনৈতিক আপত্তি, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং সামরিক ঝুঁকিতে থাকবে, সেটা কে সামাল দেবে? 

সত্য, আন্তর্জাতিক পরিসরে এ রকম মানবিক সহায়তার কিছু সফল নজির আছে। কিন্তু এমন নজিরও কম নেই, যেখানে এ রকম আপাত নিরীহ সহায়তা চলতে চলতেই প্রতিদিন একটু একটু করে জটিলতা বেড়েছে। রাখাইনের বিষয়টি ইতোমধ্যে বেশ জটিল হয়ে আছে।
সেখানে সহায়তা অভিযানের জন্য আরাকান আর্মির সম্মতি জরুরি। আবার বাংলাদেশের দিক থেকে সেই সহায়তায় রোহিঙ্গাদের স্বার্থ, তাদের ফেরত যাওয়ার প্রসঙ্গ জুড়ে দেওয়ারও অনুমান আছে। এ দুই বিষয়ে সফলতা আসতে পারে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ও বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক হলেও বিশ্বাসযোগ্য সমঝোতায়। এখানে নির্বাচিত সরকার ছাড়া ওই দিকের যুদ্ধজয়ী শক্তি হিসেবে আরাকান আর্মি এ রকম সমঝোতায় রাজি হবে কিনা বা নির্বাচিত সরকারের নির্দেশনা ছাড়া এখানকার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ রকম সমঝোতার জন্য কাজ করতে এগিয়ে যাবে কিনা– সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নেরও মুখোমুখি করে গেলেন আমাদের আন্তোনিও গুতেরেস।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক, মিয়ানমার
বিষয়ে গ্রন্থ প্রণেতা

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন র ব চ ত সরক র আর ক ন আর ম ত সরক র র কর ড র দ ব যবহ র র খ ইন র জন য আপত ত এ রকম

এছাড়াও পড়ুন:

গভীর রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ইফতিখারুল আমল মাসঊদের বাড়িতে ককটেল বিস্ফোরণ করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল বুধবার গভীর রাতে বিনোদপুরের মণ্ডলের মোড় এলাকায় তাঁর বাড়ির দরজার সামনে এ ঘটনা ঘটে। তবে এতে কেউ আহত হয়নি।

মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সেখানে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ করা হয়েছে। তবে কে বা কারা এটি করেছে, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগও কেউ করেনি। তাঁরা দুর্বৃত্তদের শনাক্তের চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইফতিখারুল আমল মাসঊদের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে ঘটনার পর তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেছেন, ‘ফ্যাসিবাদী অপশক্তির জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। কোনো রক্তচক্ষুর ভয়ংকর হুমকি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তবে তারা কখনো বাড়ি পর্যন্ত আসার ঔদ্ধত্য দেখাতে পারেনি। কিন্তু আজ আমার বাড়ির দরজায় গভীর রাতের অন্ধকারে হামলার সাহস দেখিয়েছে কাপুরুষের দল! এরা কারা? এদের শিকড়সহ উৎপাটনের দাবি জানাই।’

এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। ভেবেছিলাম বাড়ির গেটে কিংবা গেটের বাইরে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম একেবারে বাড়িতে হামলা হয়েছে। গতকালই ওনার অসুস্থ বাবা হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় এসেছেন। জানি না শেষ কবে একজন শিক্ষকের বাড়িতে রাতের আঁধারে এভাবে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আমরা শঙ্কিত, স্তম্ভিত।’

এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে এ সমাবেশের আয়োজন চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ