বাড়ির ছেলেশিশুটিকে ঠিকভাবে বড় করছেন তো
Published: 19th, March 2025 GMT
পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ভূমিকা
শৈশবে মেয়েরা মায়ের শাড়ি পরে খেলছে, ছেলেরা বাবার জুতা-জামা পরছে, বাবার মতো করে শেভিং ক্রিম মেখে দাড়ি কামানোর চেষ্টা করছে, এমন দৃশ্য আমাদের সবার কাছে পরিচিত। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা চারপাশে যা দেখে, তা–ই শেখে। বিশেষ করে জেন্ডার রোল বা লিঙ্গভূমিকা শেখার ক্ষেত্রে ছেলেরা বাবা এবং পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের দেখে শেখে এবং মেয়েরা শেখে মাসহ পরিবারের অন্য নারী সদস্যদের দেখে। পরিবারে নারী ও পুরুষ সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক শিশুর মনস্তত্ত্বকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। পরিবারে নারী ও পুরুষ সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিভিন্ন বিষয়ে বা কাজে উভয় পক্ষের অংশগ্রহণ, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। শিশুরা যেন শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যই নয়, সব সদস্যকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পারে। একটি শিশু ‘প্রতিটি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ’ ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠলে নিজের পাশাপাশি অন্যদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে। অন্যদিকে ‘আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ’ বা ‘আমি কম গুরুত্বপূর্ণ’—এমন আত্মমূল্যায়ন শিশুকে নিজের বা অন্যের প্রতি আগ্রাসী করে তুলতে পারে।
আরও পড়ুনআপনার সন্তানকে পর্নো দেখতে দেখলে কী করবেন?১৯ এপ্রিল ২০২৪যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষাযৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ও সুস্থ ধারণা শিশু–কিশোরদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপদ থাকতে সহযোগিতা করে। শিশু–কিশোরেরা যেন যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জ্ঞান লাভ করে, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সজাগ থাকতে হবে। পর্নোগ্রাফি দেখা বা যৌনতা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ, অবাস্তব ও বিকৃত ধারণা শিশু–কিশোরদের মনে যৌনতা সম্পর্কে ভীতি, অতি আগ্রহ বা যৌনবিকৃতির প্রবণতা তৈরি করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর এসব তার যৌনজীবনকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তারা যেন যৌনতা সম্পর্কে ভুল ও বিকৃত বার্তা না পায়, সে ব্যাপারে অভিভাবককে সচেতন থাকতে হবে। পাশপাশি বয়স উপযোগী করে তাদের শরীর ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা প্রদানে উদ্যোগ নিতে হবে। শিশু–কিশোরদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বয়স উপযোগী তথ্য দিতে বিজ্ঞাননির্ভর বিভিন্ন বইয়ের সাহায্য নিতে পারেন অভিভাবকেরা। বয়ঃসন্ধিতে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন যেমন শারীরিক গঠনে পরিবর্তন, ঋতুস্রাব, স্বপ্নদোষ, প্রজনন অঙ্গের কার্যপ্রণালি ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব সম্পর্কে তাদের তথ্য দেওয়া দরকার। সেই সঙ্গে নিরাপদ ও পরস্পরের সম্মতিতে সম্পর্ক, গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত সীমারেখা সম্পর্কেও তাদের সচেতন করা জরুরি। ছেলেশিশুরাও যে যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন থাকা দরকার। অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ থেকে সুরক্ষার উপায়গুলো মেয়েশিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুদেরও শেখানো জরুরি। যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বয়স উপযোগী জ্ঞান শিশু–কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করতে যেমন সাহায্য করে, তেমনি অন্যকে নিপীড়ন করা থেকেও বিরত রাখে।
আরও পড়ুনছেলেশিশুকে যেভাবে গুড টাচ ও ব্যাড টাচ বিষয়টি জানাবেন২৩ আগস্ট ২০২৪আবেগময় বুদ্ধিমত্তার বিকাশআবেগময় বুদ্ধিমত্তা হলো বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের অনুভূতি ও চাওয়াগুলো বুঝতে পারা। সেই সঙ্গে অন্যরা কী অনুভব করছে, কী চাইছে, তা বুঝে যথাযথ আচরণ করতে পারা। আমাদের সমাজে আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষের ভেতর ভিন্নতা দেখা যায়, যার জৈবিক তেমন কোনো ভিত্তি নেই। এটি মূলত পরিবেশগত একটি বিষয়। ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’, এমন ধারণা আমাদের এখানে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কষ্ট পেলে মানুষ কাঁদবে, তার আবেগপ্রবণতা নিরাময় হবে, এই স্বাভাবিক ও মৌলিক প্রক্রিয়া থেকে ছেলেদের বঞ্চিত করা হয়। এতে তাদের আবেগের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং রাগসহ বিভিন্ন ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি সামলানোর বিষয়ে তারা অদক্ষ হয়ে ওঠে। আবার ছেলেরা রাগ, ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারবে, এমন সামাজিক অনুমতি থাকায় ছেলেদের মধ্যে অস্বস্তিকর যেকোনো আবেগকেই রাগ দিয়ে প্রকাশ করার প্রবণতা তৈরি হয়। কিন্তু ছেলেদের এমনভাবে বড় করা দরকার, যেন তারা শুধু রাগ নয়, অন্যান্য আবেগ–অনুভূতির সঙ্গেও পরিচিত হয়, সেগুলোর নাম জানে এবং সহজভাবে সেগুলো প্রকাশ করতে পারে।
ছোটবেলা থেকেই শিশুকে শেখাতে হবে যেন সে আগ্রাসী আচরণ না করে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র র
এছাড়াও পড়ুন:
জন্মনিরোধে তরুণদের সচেতনতা জরুরি
নিরাপদ যৌনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে বের হয়ে তরুণদের সঙ্গে এসব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। যাতে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। নানা ধরনের যৌনবাহিত রোগ থেকে রক্ষা, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ রোধ ও মাতৃমৃত্যু কমাতে জন্মনিরোধক সামগ্রীর ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে। ‘বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস’ ২৬ সেপ্টেম্বর। এ উপলক্ষে গতকাল বুধবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।
‘বিশ্ব জন্মনিরোধ দিবস: প্রজননস্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও তরুণদের ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আয়োজন করে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড (এসএমসি)। এ আয়োজনে প্রচার সহযোগী হিসেবে ছিল প্রথম আলো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামের (সিসিএসডিপি) লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম অনেক দূর এগোলেও তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো জন্মনিরোধক–সম্পর্কিত সঠিক তথ্য ও পরামর্শ থেকে বঞ্চিত। ফলে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ বাড়ছে, যা মাতৃস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।’
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, এই প্রেক্ষাপটে দুটি বিষয় জরুরি। প্রথমত, তরুণদের কাছে পৌঁছাতে হলে ডিজিটাল মাধ্যম ও মোবাইল অ্যাপসকে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হেল্পলাইন, অনলাইন কনটেন্ট তরুণদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, প্রচলিত নানা কুসংস্কার ও সামাজিক বাধা কাটিয়ে উঠতে হবে। ভ্রান্ত ধারণা দূর করতে স্থানীয় ধর্মীয় নেতা, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সেবাগ্রহীতা পরিবারগুলোকে সচেতনতার কাজে যুক্ত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলাম বলেন, ‘অ্যাকসেস টু কন্ট্রাসেপশন (গর্ভনিরোধ পদ্ধতিতে প্রবেশগম্যতা) কিন্তু হিউম্যান রাইটস, আমাদের অধিকার এটা।
এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ক্ষমতা আমাদের কারও নেই।’
কন্ট্রাসেপশনের ফলে ইতিমধ্যে পৃথিবীতে বহু জীবন বেঁচে গেছে উল্লেখ করে কাজী মহিউল ইসলাম বলেন, ‘জীবন বাঁচানোর যে সাফল্য, এটা আমাদের এটা প্রমোট করতে হবে। একইভাবে তরুণদের সঙ্গে আমাদের খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, জন্মনিরোধক ব্যবহার না করলে বিপদটা কোথায়, এসটিআই (যৌনবাহিত সংক্রমণ) ও এসটিডির (যৌনবাহিত রোগ) ভয়াবহতাটা কী। তা না হলে কিন্তু তারা এগুলো এত সিরিয়াসলি নেবে না।’
সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পরিবার পরিকল্পনাসামগ্রীর নামকে একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখার পরামর্শ দেন কাজী মহিউল ইসলাম।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, তরুণদের মধ্যে কনডম ব্যবহারে অনীহা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। কনডম শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণই নয়; বরং যৌনবাহিত সংক্রমণ, যেমন গনোরিয়া, ক্ল্যামাইডিয়া, সিফিলিস ও এইচআইভি থেকে রক্ষা করে।
কিন্তু সচেতনতার ঘাটতি, সামাজিক সংকোচ এবং অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের পণ্যের কারণে তরুণেরা কনডম ব্যবহারে তরুণেরা আগ্রহী হচ্ছেন না বলে জানান তিনি।
নিজের চিকিৎসক জীবনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে করে মো. সাইফুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, অনেক তরুণ জানেই না কনডম সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে বা নিম্নমানের কনডম ব্যবহারে কী ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এতে শুধু সংক্রমণ নয়, ত্বকে অ্যালার্জি বা কন্ট্যাক্ট ডার্মাটাইটিসের মতো জটিলতাও হতে পারে।’
জনসংখ্যা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. উবায়দুর রব পরিবার পরিকল্পনা বিদ্যমান কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বলেন, তরুণদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষায় জন্মনিরোধক ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। বাল্যবিবাহ ও অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণের ঝুঁকি কমাতে তাঁদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সঠিক পরামর্শ ও সহজলভ্য কন্ট্রাসেপশন শুধু অনিরাপদ গর্ভপাত কমায় না; বরং মাতৃ ও শিশুমৃত্যুও হ্রাস করে।
যৌনবাহিত রোগ প্রতিরোধেও কনডমের ব্যবহার কার্যকর ভূমিকা রাখে উল্লেখ করে ফারহানা দেওয়ান বলেন, তরুণ দম্পতিদের নিয়মিত কাউন্সেলিং, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রজননস্বাস্থ্য শিক্ষা এবং গণমাধ্যমে প্রচারণা তাঁদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। নিরাপদ মাতৃত্ব, সুস্থ পরিবার ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জন্মনিরোধক ব্যবহারের প্রসার এখন সময়ের দাবি।
জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমাদের পলিসিতে অবিবাহিত তরুণদের জন্মনিরোধক সামগ্রী দেওয়া যায় না। এ জায়গায় নীতিগত পরিবর্তন আনা যায় কি না, সেটা ভাবতে হবে। তরুণদের মধ্যে তরুণদের ভাষায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে। তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি জন্মনিরোধক সামগ্রী তাদের জন্য সহজলভ্য করতে হবে।’
উন্নয়ন সংস্থার বিভিন্ন কার্যক্রম কমে যাওয়ায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জানিয়ে এসএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তছলিম উদ্দিন খান বলেন, পরিকল্পনা কার্যক্রম অব্যাহত থাকা খুবই জরুরি ছিল। কীভাবে শুরু করা যায়, সেটা নিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে।
এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েফ উদ্দিন নাসির বলেন, ‘নানা আইনি ফাকফোঁকর দিয়ে নকল ও মানহীন কনডম বাজারে ঢুকছে। আমরা আশা করব, সরকার এসব বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এমএমসি প্রতিটি পণ্যের মান নিশ্চিত করে সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে।’
গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।