আমার এক ফেসবুক বন্ধু একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন। তাতে দেখছি, ভারিক্কি চেহারার এক ভদ্রলোক বাজারে রমজানের মধ্যে কে কে রোজা রাখার বদলে ধূমপান করছে, তার হিসাব নিচ্ছেন। কাউকে পাওয়া গেলে সবার সামনে কানে হাত দিয়ে ওঠবস করাচ্ছেন।
এটি হয়তো বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা, এর ভিত্তিতে মৌলবাদ আসছে বলে পাগলা ঘণ্টি বাজানো আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে এ ঘটনার যে ধরন রয়েছে, সেটাও অস্বীকার করা যাবে না। কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক—কারও কারও মনে তার একটি পূর্বনির্ধারিত ধারণা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এ পূর্বধারণার উৎস ধর্মীয় বিশ্বাস। তাঁদের পূর্বনির্ধারিত ধারণার ব্যতিক্রম দেখলে কেউ কেউ নিজেই বিচারের দায়িত্ব তুলে নিচ্ছেন।
যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তার চোখে যথেষ্ট শালীন পোশাক না পরায় তাঁকে হেনস্তা করেছে। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকেনি; আদালত পর্যন্ত গড়ায়। জামিন পেয়ে মুক্ত হলে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে কর্মচারীটি বলে, ‘আমি এমন কী বলেছি!’
উদাহরণ আরও আছে। ঠিক-বেঠিকের পূর্বধারণা প্রয়োগ করে সারা দেশে ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। বাউলের আখড়ায় হামলা হয়েছে। হামলা হচ্ছে মাজারে। এমনকি ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়েও ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে জেলে যেতে হয়েছে হাইস্কুলের শিক্ষককে। ফেসবুকে মন্তব্যের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন কবি, সাইবার মামলায় পড়েছেন আন্দোলনকর্মী। সবার দাবি, ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে তাঁরা এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন।
ভয়টা এখানেই। আজকের বাংলাদেশে ধর্মের নামে অন্যের ব্যক্তিগত অধিকারের ওপর এমন আক্রমণের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এসব ঘটনার কোনোটির সঙ্গেই ধর্ম বা ধর্মাচারের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক রয়েছে মৌলবাদের, যার উৎস ধর্মীয় অনুশাসনের আক্ষরিক ব্যাখ্যার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যে। কাজটা ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ভেবে যাঁরা অন্যের ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করেন, তাঁরা সবাই যে নিজ ধর্ম বিষয়ে খুব সুপণ্ডিত, এ কথা বলা যাবে না। অথবা নিয়মিত ধর্ম পালন করেন, তা–ও নয়। কিন্তু তাঁদের মাথায় ‘ঠিক-বেঠিকের’ একটা সুনির্দিষ্ট ধারণা অনেক আগে থেকেই গাঁথা রয়েছে।
বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাষায়, এসবই শৈশবের শিক্ষা। আপাতত সে তর্কে নাহয় না–ই গেলাম। ব্যক্তিগত আচার-আচরণের মধ্যে তাঁদের এই বিশ্বাস সীমিত হলে এতে ভয়ের কিছু নেই। সমস্যা দেখা দেয় যখন কেউ একক বা দলগতভাবে তাঁদের সেই বিশ্বাস বা ধ্যানধারণা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিপদটা আরও বাড়ে, যখন এ প্রবণতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
মৌলবাদ যে শুধু আমাদের অঞ্চলে অথবা আমাদের ধর্মের মধ্যে বিস্তৃত, তা মোটেই নয়। বস্তুত মৌলবাদ বা ফান্ডামেন্টালিজম কথাটা আমরা পেয়েছি আমেরিকা থেকে, সেখানে গত শতকের গোড়ার দিকে প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানরা বাইবেলে আদিষ্ট ধর্মের প্রকৃত অনুসারী হিসেবে নিজেদের ‘ফান্ডামেন্টালিস্ট’ হিসেবে ঘোষণা করেন। গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে খ্রিষ্টধর্ম পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে আমেরিকায় যে ‘মোরাল মেজরিটি’ আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার সমর্থকেরাও নিজেদের ফান্ডামেন্টালিস্ট হিসেবেই পরিচিত করাতেন।
আজকের আমেরিকায় মোরাল মেজরিটির গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে বটে, কিন্তু ভিন্ন মোড়কে রিপাবলিকান রক্ষণশীল রাজনীতিক ও ধর্মগুরুদের হাতে তা নতুনভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতকায় ভোটারদের প্রায় ২৫ শতাংশ নিজেদের ‘ইভানজেলিক্যাল’—অন্য কথায় মৌলবাদী বলে পরিচয় করাতে ভালোবাসেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে ধর্মাচারী হিসেবে পরিচিত না হলেও এই খ্রিষ্টীয় মৌলবাদীদের সমর্থনেই তিনি দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন।
আগে বলেছি, ব্যক্তিগত জীবনে আপনি যেমন ইচ্ছা ধর্ম পালন করুন, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার ধর্মবিশ্বাস যখন রাজনৈতিকভাবে একটি দলীয় বা সম্প্রদায়গত ধর্মবিশ্বাস হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই ধর্মবিশ্বাসের বাইরের মানুষের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দেয়।
এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ, সবার হাতে হাতে মুঠোফোন। ভারিক্কি চেহারার লোকটির মতো যাঁরা অন্যের পাপ-পুণ্যের অডিট করতে চান, তাঁদের নাম–পরিচয় জানার চেষ্টা করুন। বাউলদের আখড়ায় যারা হামলা করে, সেসব হামলার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহ করুন। তাদের সামাজিকভাবে বর্জনের আহ্বান জানান। আমাদের নীতিজ্ঞান শেখানোর দায়িত্ব তাদের কারও ওপর ছেড়ে দিইনি, সে কথাটা জানিয়ে দিন।যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরুন। সারা দেশে ইভানজেলিক্যালদের নেতৃত্বে স্কুল ও লাইব্রেরি থেকে খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়—এমন পুস্তক সরানোর প্রতিযোগিতা চলছে। স্কুলে ডারউইনিজম বা বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছে। ধর্মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়—এ যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে লিঙ্গান্তরিত ব্যক্তিদের অধিকার এখন উপেক্ষিত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক নির্বাহী আদেশে ঘোষণা করেছেন, এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুধু পুরুষ ও নারী—এ দুই লিঙ্গকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। লিঙ্গান্তরিত মানুষদের কোনো স্বীকৃতি থাকবে না। লিঙ্গান্তর বিষয়ে স্কুলে কোনো পাঠদানও অনুমোদন পাবে না।
মজার কথা হলো মার্কিন কংগ্রেসে এই মুহূর্তে একজন ডেমোক্রেটিক সদস্য রয়েছেন, যিনি ‘ট্রান্সজেন্ডার’। ট্রাম্পের অতি বিশ্বস্ত উপদেষ্টা ইলন মাস্কের রয়েছে একটি লিঙ্গান্তরিত সন্তান।
খ্রিষ্টান মৌলবাদীদের দাবি মেনেই নারীর গর্ভপাতের অধিকার রদ বা সংকুচিত করা হয়েছে। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ বিতরণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ বিতরণ করায় ইউএসএআইডির বিশব্যাপী কার্যক্রম বাতিল করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন‘ধর্ষণ’ শব্দে ডিএমপি কমিশনারের আপত্তি কেন১৬ মার্চ ২০২৫ধর্মের নামে বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর এখনো কোনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি, কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গ, ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারের ওপর খড়্গ নেমে এসেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি গোষ্ঠীর চাপেই পাঠ্যসূচি থেকে ট্রান্সজেন্ডার–বিষয়ক আলোচনা বাদ দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের দাবিতে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু রচনা বাদ দেওয়া হয়।
মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার। নারীরা কী করতে পারেন আর কী করতে পারেন না, তা নির্দেশ করে তারা সম্প্রতি একটি আইন পাস করেছে। এতে মেয়েদের গৃহের বাইরে শুধু কাজ করাই যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা–ই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের পর স্কুল-কলেজে পড়াশোনাও নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি জনসমক্ষে উঁচু গলায় কথা বলাতেও বারণ, এমনকি তা যদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ হয়, তাতেও। এ ছাড়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত আবৃত রাখার কড়া নির্দেশ তো আগে থেকেই বলবৎ ছিল।
নারীর ব্যাপারে কট্টরপন্থী পুরুষদের এমন গাত্রদাহের কারণ কী? মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন—এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ পুরুষ নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা (ইনসিকিউরিটি) ঢাকতেই মেয়েদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে আসেন। নামজাদা মনোবিদ ক্যারেন হরনি, যিনি ‘গর্ভ ঈর্ষা’ (উম্ব এনভি) নামক তত্ত্বের প্রণেতা। তিনি বলেছেন, মেয়েরা জন্মদানে সক্ষম—এটি পুরুষদের মধ্যে গভীর ঈর্ষার জন্ম দেয়। এ থেকে যে হীনম্মন্যতার উদ্রেক হয়, তা ঢাকতেই পুরুষদের প্রয়োজন পড়ে মেয়েদের ওপর অধিকার ফলাতে। তাঁদের অনেকেই নিজেদের দাবির পক্ষে উকিল হিসেবে ধর্মগ্রন্থের একপেশে ব্যবহার করতে ভালোবাসেন।
এ অবস্থা বদলাব কীভাবে। পৃথিবীর সর্বত্র নাগরিক অধিকারের সম্প্রসারণ সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে। আর সে আন্দোলনের প্রথম পাঠ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত প্রতিবাদে। বাংলাদেশে একটি চমৎকার স্লোগান রয়েছে—ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এ কথার অর্থ ধর্ম ও রাষ্ট্রকে বিযুক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে এই বিযুক্তির বদলে সরকারের হাত ধরে ধর্ম রাষ্ট্রের ঘাড়ে চড়ে বসছে। ধর্মের নামে সরকার যখন একের পর এক ছাড় দিতে থাকে (যেমন পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন, অথবা হুমকির মুখে ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে ফেলা), তাতে মৌলবাদের হাতকে আরও শক্তিশালী করা হয়।
যাঁরা ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে সামাজিক নৈতিকতা আরোপ করতে চান, তাঁদের সে চেষ্টার প্রতিবাদ করুন। এ কাজে প্রধান ভূমিকা নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের, বিশেষত মেয়েদের নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে যুবক একটি মেয়েকে শালীনতার সবক দিতে এসেছিল, প্রতিবাদের মুখেই তাকে আটক করা হয়েছিল।
এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ, সবার হাতে হাতে মুঠোফোন। ভারিক্কি চেহারার লোকটির মতো যাঁরা অন্যের পাপ-পুণ্যের অডিট করতে চান, তাঁদের নাম–পরিচয় জানার চেষ্টা করুন। বাউলদের আখড়ায় যারা হামলা করে, সেসব হামলার সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহ করুন। তাদের সামাজিকভাবে বর্জনের আহ্বান জানান। আমাদের নীতিজ্ঞান শেখানোর দায়িত্ব তাদের কারও ওপর ছেড়ে দিইনি, সে কথাটা জানিয়ে দিন।
হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স গত প র ণ র জন ত ক আম দ র অন য র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজ রিয়াদের তাণ্ডবে অতিষ্ঠ মিশনপাড়া
নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশনপাড়ায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হুমকি ও হয়রানিমূলক মামলার ভয়ঙ্কর এক চক্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, রিয়াদ দীর্ঘদিন ধরেই এলাকার বাসিন্দাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে দোকান বসানো পর্যন্ত সবকিছুতেই চাঁদা দাবি করেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা।
চাঁদা না দিলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা, পরে দেওয়া হয় সাজানো মামলা। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন রয়েছে রহস্যজনকভাবে নীরব।
স্থানীয়রা বলছেন, রিয়াদ নিজে কোনো রাজনৈতিক আদর্শের লোক না হলেও, একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলে এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাঁদের ব্যবহার করেন নিজের স্বার্থে।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় রিয়াদ এতটাই দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করেন যে, থানায় একাধিক অভিযোগের পরও তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার অন্যতম আসামিও এই রিয়াদ। সেইসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় তাঁর নামে একাধিক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মামলা রয়েছে।
এমনকি তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও তিনি দিব্যি এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আদায় করে চলেছেন চাঁদা, দখল করে নিচ্ছেন জমি, দোকান।
মিশনপাড়ায় বর্তমানে যেসব ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে, তার মধ্যে প্রায় প্রতিটির কাজেই বাধা দেওয়া হয়েছে রিয়াদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাড়ির মালিক বলেন, “আমরা পরিবার নিয়ে এখানে থাকি।
নিজের পৈতৃক জমিতে ভবন নির্মাণ করছি। হঠাৎ একদিন ৪-৫ জন যুবক এসে জানায়, বসের অনুমতি ছাড়া কাজ হবে না। পরে রিয়াদ নিজেই ফোন করে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। না দিলে মালামাল ফেলে দেওয়া, শ্রমিকদের মারধরের হুমকি দেয়।”
এই অভিজ্ঞতা শুধু একজনের নয়। অন্তত ৮-১০ জন ভবন মালিক এবং কয়েকজন ঠিকাদার একই ধরনের ভোগান্তির কথা জানিয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, রিয়াদের নেতৃত্বে একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়মিতভাবে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে। কেউ না মানলে থেমে যায় কাজ, চলে হামলা-মামলা আর হয়রানির স্বীকারে।
মিশনপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, রিয়াদ এলাকায় একটি ভয়ঙ্কর ‘মিনি মাফিয়া নেটওয়ার্ক’ গড়ে তুলেছেন। ভবন নির্মাণ, দোকান বসানো, এমনকি ফুটপাতে ব্যবসা করতেও তাঁকে চাঁদা দিতে হয়। অন্যথায় চলতে থাকে ভয় দেখানো, ভাঙচুর, এমনকি জীবননাশের হুমকি। অনেকেই বলেন, তাঁরা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছেন রিয়াদ ও তাঁর চক্রের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, “আমার পৈতৃক জমিতে ভবন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছে। না দিলে শ্রমিকদের মারধর করবে বলে হুমকি দিয়েছে। থানায় গিয়ে অভিযোগ করলাম, কিন্তু কিছুই হয়নি। বরং রিয়াদ খবর পেয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদার পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
একজন ঠিকাদার বলেন, “ভবন নির্মাণ করতে গিয়ে আমাদের এখন বেশি খরচ হয় রিয়াদকে সামলাতে। কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই। যে যেখানে ইচ্ছা চাঁদা চাচ্ছে, না দিলে মামলা, মারধর। কোথাও নালিশ করতে পারি না, বরং নালিশ করলেই বিপদ আরও বাড়ে।”
আরেকজন ঠিকাদার বলেন, “রিয়াদ এখন এলাকাবাসীর গলার কাঁটা। কাজ শুরু করলেই তার লোকজন এসে বলে, বসের অনুমতি লাগবে। চাঁদা না দিলে মালামাল উধাও, শ্রমিক পালায়, পরে থানায় গিয়ে দেখি আমার নামে নাকি মারামারির মামলা!”
ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু ভীতি ও চাঁদাবাজি নয়, রিয়াদ ও তাঁর সহযোগীরা একটি সংঘবদ্ধ আইনি হয়রানির চক্রও তৈরি করেছেন। কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে বা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। পরবর্তীতে সেই মামলা আপোষে নিষ্পত্তির জন্য আবারও দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, রিয়াদের এতোসব অপরাধ কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়ায় মানুষের মনে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে, কেন এই নীরবতা? তাঁর নামে একাধিক মামলা ও ওয়ারেন্ট থাকার পরও কীভাবে তিনি খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়ান? পুলিশ কি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আড়াল করছে?
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন। অপরাধী হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এলাকাবাসীর দাবি ভিন্ন।
তাঁরা বলছেন, শুধু অভিযোগ নয়, ভিডিও প্রমাণ, অডিও ক্লিপস, এমনকি লিখিত অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার পাননি তাঁরা। বরং অভিযোগ জানানোর পর হুমকির মাত্রা বেড়ে যায়। অনেকে ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বা কাজ বন্ধ রেখেছেন।
রিয়াদের বিরুদ্ধে এইসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্থানীয় কাউন্সিলর ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছেও বহুবার গেছেন এলাকাবাসী। কিন্তু কেউই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসেননি। বরং অনেকে অভিযোগ করেন, রিয়াদ একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রুপের ‘অঘোষিত কার্যকর্তা’ হিসেবে কাজ করেন, এবং সেই পরিচয়ের কারণেই তাঁকে ঘিরে রয়েছে এক ধরনের অদৃশ্য নিরাপত্তা।
মিশনপাড়ার এই অবস্থা এখন পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরের নিরাপত্তা ও সুশাসনের জন্য ভয়ঙ্কর এক সংকেত হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজের প্রশ্ন , যদি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও একাধিক মামলার আসামিকে গ্রেপ্তার না করা হয়, তবে আইনের শাসন কোথায়?
সচেতন মহলের দাবি, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রিয়াদ ও তাঁর চক্র আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন শুধু মিশনপাড়া নয়, নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রতিটি প্রান্তেই গড়ে উঠবে এমন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট।
এখনই সময় রিয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার, নয়তো ঘটতে পারে ভয়ংকর অপ্রীতিকর কোন ঘটনা। আক্রান্ত হতে পারে ভুক্তভোগীরা।