সৌদি আরবে বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতি কেমন হলো? কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক প্রস্তুতি ম্যাচ ছাড়াই শিলংয়ে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স ভালো হবে তো? এসব প্রশ্ন কেউ করছে না। এসব নিয়ে যেন কারও কোনো ভাবনাও নেই।
শিলংয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বাংলাদেশ-ভারত এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বের ম্যাচের আগে আপাতত সিগনেচার টাইপ প্রশ্ন একটাই– বাংলাদেশ দলে কোন পজিশনে খেলবেন হামজা? জামাল ভূঁইয়া, তপু বর্মণদের দলের অন্দরমহল থেকে যে খবর বাইরে আসছে, সে অনুযায়ী হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনেই খেলবেন হামজা।
তবে তাঁর খেলার ধরনে একটু স্বাধীনতা দিয়ে মাঝমাঠে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিতে যাচ্ছেন হ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা। সব তথ্য জোড়া লাগালে যা হচ্ছে, ভারতের ৮ নম্বর বিপৎসংকেত হতে যাচ্ছেন হামজা। কারণ বাংলাদেশ দলে ৮ নম্বর পজিশনে খেলবেন শেফিল্ড ইউনাইটেডের এই মিডফিল্ডার।
ফুটবলে ‘ওয়ান ম্যান টিম’ কথায় আমার বিশ্বাস নেই। তবে দলে দু-একজন খেলোয়াড় থাকেন, যারা বিশেষ প্রতিভায় ম্যাচের কঠিন মুহূর্তগুলো সহজ করে নিতে পারেন। তাই তাদের ফুটবলীয় টেকনিক প্রতিভা ও ট্যাকটিকস মেধার মূল্য দিয়ে দলের কৌশল সাজিয়ে থাকেন কোচরা। স্বাভাবিকভাবে ইংলিশ লিগে খেলা হামজার সর্বোচ্চ ব্যবহারের দিকেই নজর রেখে কৌশল সাজাচ্ছেন বাংলাদেশের কোচ।
বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল অবকাঠামোর মধ্যে হামজার বেড়ে ওঠা। খেলেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবল লিগেও। এমন একজন ফুটবলার দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল পর্যায়ে এসে গোলকিপার পজিশন বাদ দিয়ে যে কোনো পজিশনেই খেলতে পারবেন বলে মনে করি। কারণ আধুনিক ফুটবল দীক্ষার মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠায় ফুটবল কীভাবে খেলতে হয়, সেই মৌলিক পাঠটা তাঁর ভালো করেই জানা। কোচের কৌশল কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, এই পর্যায়ে এসে হামজার চেয়ে ভালো আর কেই বা জানেন!
সাম্প্রতিক সময়ে ৪-৪-২ ডায়মন্ড ফরমেশনে দলকে খেলিয়েছেন ক্যাবরেরা। এই ফরমেশনে একজন মাত্র হোল্ডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন মোহাম্মদ হৃদয়। দলের অন্যতম সেরা পারফরমারও তিনি। হামজার অন্তর্ভুক্তিতে হৃদয়কে ছেঁটে না ফেলে দু’জনকে একসঙ্গে ব্যবহার করার জন্য দলের ফরমেশন বদলাতে যাচ্ছেন ক্যাবরেরা।
তাই ৪-২-৩-১ ফরমেশনে হৃদয় ও হামজা– ‘ডাবল পিভট’ দুই হোল্ডিং মিডফিল্ডার খেলানোর পথ বেছে নিতে যাচ্ছেন স্প্যানিশ এই কোচ। এতে রক্ষণভাগের ওপর সরাসরি চাপটাও কম পড়বে। আবার বাংলাদেশের ওপর চড়াও হওয়ার সুযোগ পাবে না ভারতের শক্তিশালী মাঝমাঠও।
‘ডাবল পিভট’-এ হৃদয় আপাদমস্তক প্রথাগত ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও হামজার ভূমিকা হবে ভিন্ন। ৮ নম্বর পজিশনের মতো বক্স টু বক্স ওঠানামা করে খেলতে হবে হামজাকে। এতে রক্ষণভাগকেও যেমন সহায়তা করতে পারবেন, ঠিক তেমনি আক্রমণ গড়ার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবেন ২৭ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার।
সোজাকথা, ৪ জনের রক্ষণভাগের সঙ্গে আক্রমণভাগের ৪ জনের মজবুত সেতুর সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে শেফিল্ড মিডফিল্ডারের কাজ। একই সঙ্গে বল বাংলাদেশ দলের দখলে থাকা অবস্থায় গোল এরিয়ায় থাকার অবাধ সুযোগ তো থাকছেই হামজার সামনে। এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতে খেলার জন্য শারীরিকভাবে যে সামর্থ্য থাকার প্রয়োজন, তার সবই তো আছে সিলেটের বাহুবলের ছেলের মধ্যে।
৪-২-৩-১ এর পাশাপাশি পুরোনো ৪-৪-২ ডায়মন্ড শেইপ ফরমেশনের ভাবনাও মাথায় রাখছেন ক্যাবরেরা। যদি পুনরায় ৪-৪-২ ফরমেশনে খেলে বাংলাদেশ, সে ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের ডান প্রান্তের ৮ নম্বর পজিশনে খেলবেন সিলেটের বাহুবলের ছেলে। মূলত রক্ষণভাগ ও আক্রমণভাগের যোগসূত্র হিসেবে হামজাকে ব্যবহার করাটাই হতে যাচ্ছে ক্যাবরেরার কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ দিক।
হোল্ডিং মিডফিল্ডার হলেও ডিফেন্ডারের মতো হামজার পায়ে আছে নিখুঁত ট্যাকল। সঙ্গে দুর্দান্ত কাভারিং। দুই প্রান্ত থেকে ভয় ধরানো সব ক্রস যখন ভেসে আসে বক্সে তখন তাঁর অনুমান-ক্ষমতাও চোখে পড়ার মতো। সঙ্গে লড়াকু মনোভাব। এগুলো দিয়েই ৯০ মিনিট বাংলাদেশকে আগলে রাখবেন হামজা; আমাদের ভালোবাসার ঝাঁকড়া চুলের হামজা।
লেখক: সাবেক ফুটবলার, বাংলাদেশ জাতীয় দল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক য বর র ল দ শ দল ফ টবল
এছাড়াও পড়ুন:
রাগ নিয়ন্ত্রণে হাদিসের ৭ উপদেশ
রাগ মানুষের স্বাভাবিক একটি আবেগ, যা অনিয়ন্ত্রিত হলে মানুষের জীবনে বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারে। এটি মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে ইসলাম রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যা কোরআন ও হাদিসে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
রাগ একটি মানসিক অবস্থা, যা অভ্যন্তরীণ উত্তেজনা ও প্রতিশোধের ইচ্ছা থেকে উৎপন্ন হয়। যখন এ উত্তেজনা তীব্র হয়, তখন ক্রোধের আগুনকে আরও উসকে দেয়। ফলে মানুষের মন ও বুদ্ধি নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং শিষ্টাচার ও নির্দেশনার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।
ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই এই রাগ হলো শয়তানের প্রজ্বলিত একটি স্ফুলিঙ্গ, যা আদম সন্তানের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে।’ (আল-কুলায়নী, আল-কাফি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩০৪, হাদিস: ১২)
নিশ্চয়ই এই রাগ হলো শয়তানের প্রজ্বলিত একটি স্ফুলিঙ্গ, যা আদম সন্তানের হৃদয়ে জ্বলে ওঠে।ইমাম বাকির (আ.), আল-কুলায়নী, আল-কাফিরাগকে অনেকে শক্তির প্রকাশ মনে করলেও এটি আসলে একটি দুর্বলতা। রাগের কারণে মানুষ অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা তার জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়।
রাগের ক্ষতিরাগ যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তবে এটি ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব হলো উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অপরাধবোধ, হতাশা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। শারীরিকভাবেও এটি মাথাব্যথা, চোখের সমস্যা, পেটের গোলযোগ ও হৃদ্রোগের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে।
সামাজিক পরিসরে রাগ সম্পর্কের অবনতি ঘটায়। রাগের বশে মানুষ এমন কথা বলে বা কাজ করে, যা তার সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক ছিন্ন করে। কখনো কখনো এটি হত্যা বা রক্তপাতের মতো চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, রাগের কারণে মানুষ আল্লাহর অসন্তুষ্টি অর্জন করে এবং সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এ ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করা অপরিহার্য।
শারীরিকভাবেও এটি মাথাব্যথা, চোখের সমস্যা, পেটের গোলযোগ ও হৃদ্রোগের মতো সমস্যা সৃষ্টি করে।রাগ নিয়ন্ত্রণ আল্লাহর সন্তুষ্টির উপায়রাগ একটি শক্তিশালী আবেগ, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে কোরআন এ সমস্যার সমাধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যারা সচ্ছলতায় ও অভাবে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, যারা রাগ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৪)
এ আয়াতে রাগ দমনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কথা বলা হয়েছে।
কোরআনে নবীদের জীবন থেকে উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। নবী ইবরাহিম (আ.)-এর পিতা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারার হুমকি দিলে তিনি শান্তভাবে বলেছিলেন, ‘তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ (সুরা মারয়াম, আয়াত: ৪৭)
কোরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘তোমাদের যা দেওয়া হয়েছে, তা এই পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী ভোগ। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। এটি তাদের জন্য যারা ঈমান আনে, তাদের রবের ওপর ভরসা করে, বড় পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকে এবং রাগের সময় ক্ষমা করে।’ (সুরা শুরা, আয়াত ৩৬-৩৭)
এ আয়াতে রাগ নিয়ন্ত্রণকে সততার লক্ষণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা জান্নাতের পথ প্রশস্ত করে।
আরও পড়ুনহজরত আলী (রা.)-এর ১০টি কালজয়ী উক্তি২৮ জুন ২০২৫হাদিসে রাগ নিয়ন্ত্রণের উপদেশইসলামে রাগকে শয়তানের কুমন্ত্রণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মহানবী (সা.) বিভিন্ন উপায় বাতলে দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
যারা সচ্ছলতায় ও অভাবে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, যারা রাগ দমন করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের ভালোবাসেন।সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৩-১৩৪১. শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা: সুলায়মান ইবনে সারদ বলেন, ‘আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বসেছিলাম। দুজন লোক একে অপরের বিরুদ্ধে গালমন্দ করছিল। তাদের একজনের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল এবং তার ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠেছিল।
নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমি এমন একটি কথা জানি, যদি সে তা বলে, তার এ অবস্থা দূর হয়ে যাবে। তা হলো, আউযু বিল্লাহি মিনাশ শাইতনির রজিম (আমি শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি)’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০২)।
২. নীরব থাকা: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ক্রুদ্ধ হলে সে যেন নীরব থাকে।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৬৯৩, ৪০২৭)
রাগের সময় কথা বললে অযৌক্তিক বা ক্ষতিকর কথা বেরিয়ে আসতে পারে, যা সম্পর্ক নষ্ট করে। তাই নীরব থাকা রাগ নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর উপায়।
৩. শারীরিক অবস্থান পরিবর্তন: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ক্রুদ্ধ হলে যদি সে দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে যেন বসে পড়ে। তাতে তার রাগ দূর না হলে সে যেন শুয়ে পড়ে।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ৪৭৬৪)
আবু জর (রা.) রাগের সময় এ নির্দেশ পালন করেছিলেন এবং শান্ত হয়েছিলেন।
৪. নবীর (সা.) পরামর্শ অনুসরণ: একজন সাহাবি নবীজি (সা.)-এর কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বারবার বলেছিলেন, ‘ক্রুদ্ধ হয়ো না।’ (সহিহ বুখারি, ফাতহুল বারী, ১০/৪৫৬)
৫. জান্নাতের প্রতিশ্রুতি স্মরণ: নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে, যখন তার রাগ প্রকাশ করার ক্ষমতা থাকে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার হৃদয়কে সন্তুষ্টিতে ভরিয়ে দেবেন।’ (তাবারানি, হাদিস: ১২/৪৫৩)।
৬. নবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণ: মহানবী (সা.)-এর জীবনে রাগ নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ উদাহরণ রয়েছে। একবার একজন বেদুইন তাঁর গলায় রুক্ষভাবে ধরে তাঁকে কিছু দেওয়ার দাবি করেন। নবীজি (সা.) শান্তভাবে হেসে তাঁকে কিছু দিতে আদেশ করেন। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৩৭৫)
৭. দোয়া: দোয়া মুমিনের শক্তিশালী অস্ত্র। নবীজি (সা.)-এর একটি দোয়া ছিল, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে প্রকাশ্যে ও গোপনে তোমার ভয় করার তৌফিক প্রার্থনা করি এবং সন্তুষ্টি ও রাগের সময় সত্য কথা বলার তৌফিক চাই।’ (সহিহ আল-জামি, হাদিস নং ৩০৩৯)
তবে রাগ যদি আল্লাহর অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে হয়, তবে তা প্রশংসনীয়। নবীজি (সা.) যখন দেখতেন যে কেউ আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করছে, তখন তিনি রাগ প্রকাশ করতেন, তবে তা ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
আরও পড়ুনরাগ নিয়ন্ত্রণ করতে যা করা যায়১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫