এ রায় কলঙ্কিত ছাত্র রাজনীতির ‘ভ্যাকসিন’ হয়ে থাকুক
Published: 20th, March 2025 GMT
ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা। এই হত্যার বিচার নিয়ে পরিবারের ছিল প্রবল সন্দেহ, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ– সুবিচার আদৌ হবে কী? সন্দেহের কারণটাও সংগত। কেননা, আসামিরা ক্ষমতার ছায়ায় লালিত-পালিত ও হৃষ্টপুষ্ট! তাই এমন ভাবনা অমূলক নয়। অবশেষে উৎকণ্ঠা প্রায় কেটে গেল; এখন রায় কার্যকর হওয়ার পালা। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে বিচারিক আদালত যে রায় দিয়েছিলেন, সেটিই এখন বহাল।
এবার আপিলে সেই মামলা যখন হাইকোর্টে এলো, আবরার ফাহাদের পরিবারের তখনও একই শঙ্কা। নিম্ন আদালতের রায় টিকবে তো? সব খুনির সাজা বহাল থাকবে তো? নাকি আইনের ফাঁকফোকরে খুনিরা পার পেয়ে যাবে? অবশেষে সেই শঙ্কা-সন্দেহকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১৬ মার্চ মহামান্য হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায়, সাজা হুবহু বহাল তো রাখলেনই; সঙ্গে পর্যবেক্ষণে বললেন, ‘নিম্ন আদালত যে ফাইন্ডিংস দিয়েছেন, এখানে ইন্টারফেয়ারের মতো কিছু নেই’ (সমকাল)। এই মামলায় নিম্ন ও উচ্চ আদালতের দেওয়া রায় নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক। একই সঙ্গে অনন্য বিচারিক নজির। তবে এটি শুধু একটি ফৌজদারি মামলার রায় নয়। এই রায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নীরব বার্তা:
এক, এই মামলায় দণ্ডিত ২৫ জনই বুয়েটের শেরেবাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই নিম্ন আদালতের রায়টি ঘোষিত হয়। এর অর্থ এই, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী হওয়ার কারণে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার দিন বুঝি এখন শেষ। অপরাধীর পরিচয় একটাই– তারা অপরাধী। যে কয়টি ব্যর্থতা বিগত আওয়ামী সরকারের গায়ে বারবার কালিমা লেপন করেছে; প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে; তার মধ্যে এক.
দুই. এই মামলা দ্রুত বিচারের একটি গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সাগর-রুনি হত্যা মামলায় ১৩ বছরেও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পেছায় ১১৬ বার (প্রথম আলো); সেখানে এই মামলায় ঘটনার মাত্র ১ মাস ৭ দিনের মাথায় চার্জশিট, মাত্র ৭৮ কার্যদিবসে ৪৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, যুক্তি-তর্ক শুনানি শেষে নিম্ন আদালত রায় প্রদান করেন। এমন দ্রুত বিচার খুবই কাম্য ছিল। এ মামলায় পুলিশ প্রমাণ করেছে– সদিচ্ছা থাকলে দ্রুত তদন্ত সম্ভব। সম্ভব ‘তদন্তের ধীরগতি’র চিরচেনা গল্পকে মিথ্যা প্রমাণ করা। এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া থেকে সুস্পষ্ট– যত সীমাবদ্ধতাই আমাদের থাকুক; পুলিশসহ বিচারিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিক হলে এ দেশে দ্রুত ও ন্যায়বিচার সম্ভব।
তিন. দূষিত ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ত থাবা যুগ যুগ ধরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বিষফোড়া হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এর ছোবলে কত মেধাবী ছাত্র যে বলি হয়েছে; কত মা-বাবার কোল খালি হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবরার ফাহাদের প্রতিষ্ঠান বুয়েটেই তো এমন ঘটনা ঘটেছে একাধিক। এই যেমন সাবেকুন নাহার সনি। ২০০২ সালের ৮ জুন টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে নিহত হয় বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সনি। ২০১৩ সালে এক হেফাজত কর্মীর এলোপাতাড়ি কোপে নিহত হয় বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বষের্র শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দ্বীপ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সনি হত্যা মামলায় একজন ছাড়া দণ্ডিত খুনিরা কেউ সাজা ভোগ করেনি। মূল খুনিরা এখনও পলাতক। তবে এই রায়ে একটি বার্তা খুবই পরিষ্কার– ক্ষমতার দাপটে অন্ধ হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধরাকে সরা জ্ঞান করার দিন শেষ। সবাইকে আইনের আওতায় আসতেই হবে।
চার. বুয়েট এ দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠ। অতি মেধাবীরাই এখানে পড়ার সুযোগ পায়। এই মামলার সব আসামিই বুয়েটের ছাত্র। এই ‘অতি মেধাবীদের’ কারা, কীভাবে খুনি বানাল, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। কারণ আমরা চাই না, এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক। আমরা চাই, এ ঘটনাই বুয়েটে শেষ ‘হত্যার’ ঘটনা হোক।
আবরারের পরিবারের মতো আমরাও চাই, আপিল বিভাগ, রিভিউ ও ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ পর্বগুলোও দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ হোক। পলাতক চার খুনিকে গ্রেপ্তার করে অবিলম্বে এই রায় কার্যকর হোক। চাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুনের রাজনীতির রাহুমুক্ত হোক। আমরা চাই না, পড়তে গিয়ে আর কোনো সন্তান লাশ হয়ে ঘরে ফিরুক। পাশাপাশি চাই দ্রুত ন্যায়বিচারের যে ধারা শুরু হয়েছে, তা যেন আমাদের বিচার ব্যবস্থার নিয়মিত চিত্র হয়।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব: প্রাবন্ধিক ও
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
aftabragib2@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আবর র ফ হ দ র র জন ত র এই র য় তদন ত আবর র
এছাড়াও পড়ুন:
স্ত্রী-সন্তানসহ সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের আয়কর নথি তলবের নির্দেশ
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবু হেনা মোহাম্মদ মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল, তাঁর স্ত্রী কাশমিরি কামাল এবং তাঁদের দুই মেয়ে কাশফি কামাল ও নাফিসা কামালের আয়কর নথি তলবের নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার একটি আদালত। দুদকের পৃথক চারটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র জজ সাব্বির ফয়েজের আদালত আজ সোমবার এ আদেশ দেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ এ আবেদনগুলো করেন। পরে আদালত তা মঞ্জুর করেন। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা তানজির আহমেদ এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
লোটাস কামালের আয়কর নথি তলবের আবেদনে বলা হয়, লোটাস কামালের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন। তাঁর নামে ৩২টি ব্যাংক হিসাবে সন্দেহজনক অর্থ লেনদেন করার অভিযোগটি তদন্তাধীন রয়েছে।
কাশমিরি কামালের আবেদনে বলা হয়, মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধভাবে ৪৪ কোটি ১১ লাখ ৬২ হাজার ১৪৬ টাকা অর্জন করেছেন। এই অবৈধ সম্পদ তিনি তাঁর স্ত্রীর নামে দেখিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে উক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নিজ নামে মোট ২০টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মোট ২৯ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার ২০৭ টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে সন্দেহজনক অসংখ্য লেনদেন করার অভিযোগটি তদন্তাধীন রয়েছে।
কাশফি কামালের আয়কর নথি তলবের আবেদনে উল্লেখ করা হয় যে মুস্তফা কামাল তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত ৩১ কোটি ৭৮ লাখ ৮৩ হাজার ১৯৫ টাকা বৈধ করতে নিজ কন্যা কাশফি কামালের নামে দেখিয়েছেন। এ ছাড়া কাশফি কামালের নামে খোলা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ মোট ৩৮টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৮৭ কোটি ৪৮ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি তদন্তাধীন।
নাফিসা কামালের আবেদনে দাবি করা হয় যে মুস্তফা কামাল তাঁর অবৈধ ৬২ কোটি ৬৪ লাখ ৭৭ হাজার ৫১৬ টাকা বৈধ করতে মেয়ে নাফিসা কামালের নামে স্থানান্তর করেছেন। এখানেও নাফিসা কামালের নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। তাঁর নামে মোট ১৮টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ১৯৯ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে, যা নিয়ে তদন্ত চলছে।