গুলশানে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী হত্যায় ‘একে-৪৭’ গ্যাং
Published: 22nd, March 2025 GMT
রাজধানীর গুলশানে বৃহস্পতিবার রাতে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়া হত্যার পর আলোচনায় এসেছে একে-৪৭ নামের একটি গ্যাং। একসময় এই গ্রুপের নাম ছিল ‘সেভেন স্টার’। দলনেতা একে-৪৭সহ ধরা পড়ার পর থেকে এটি একে-৪৭ নামে পরিচিতি পায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রক টিবি গেট এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী রুবেল ও তার বোন জামাই সেন্টু। গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বিরোধের জেরে একে-৪৭ গ্রুপের হাতে খুন হন সুমন। তিনিও ‘বন্ধু গ্যাং’ নামে একটি গ্রুপ চালাতেন। সেন্টু ওই এলাকায় ‘টিবি গেটের দুলাভাই’ ও ‘টিবি গেটের জামাই’ হিসেবে পরিচিতি।
একসময় সুমনও একে-৪৭ গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করতেন। সেখান থেকে বেরিয়ে পাঁচ-সাত বছর হয়েছে বন্ধু গ্যাং গড়ে তোলেন। এর পর থেকে দুই গ্রুপের ঝামেলা শুরু। মূলত এলাকায় চাঁদাবাজি, আধিপত্য ও ফুটপাত বাণিজ্য নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ২০২০ সালে রোজায় একবার একে-৪৭ গ্রুপের টার্গেট হন সুমন। হামলার শিকার হলেও তখন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
বৃহস্পতিবার রাতে গুলশান পুলিশ প্লাজার উত্তর পাশের সড়কে সুমন মিয়াকে (৩৫) গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার গতকাল শুক্রবার গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, সেভেন স্টার গ্রুপের রুবেল ও তার সহযোগীরা এর আগেও সুমনের ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং মারধরও করে। ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরেই সুমনকে হত্যা করা হয়েছে।
মৌসুমী বলেন, মহাখালীর টিবি গেট এলাকায় ‘প্রিয়জন’ ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা রয়েছে সুমনের। ২০২০ সালে রুবেলের সহযোগী জামাল, সেন্টু ও আফজাল মারধর করে সুমনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওই ঘটনার পর তৎকালীন গুলশান থানার ওসিকে অনুরোধ করে পুলিশের হস্তক্ষেপে সংযোগ আবার চালু করা হয়। সম্প্রতি আবার ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ঝামেলা শুরু করে রুবেল গ্রুপ। এতে টিবি হাসপাতাল এলাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাসানটেকে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা। তার পরও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি।
গত ৫ আগস্ট তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাপে পড়েন বন্ধু গ্যাংয়ের বস সুমন মিয়া। এর দু’দিন পর মহাখালী টিবি গেট এলাকায় ডিস ও ফলের দোকান ভাঙচুর করে একে-৪৭ গ্রুপের সদস্যরা। এর পর এলাকা ছেড়ে তারা মিরপুর ভাসানটেকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। কিন্তু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই গ্রুপের রেষারেষি থামেনি। সুমনের নিয়ন্ত্রণে বন্ধু গ্রুপের সদস্য তাঁর শ্যালক বাদশা ওরফে রুবেল, মনিরুল, নুর আলম অনি, আমিনুল ইসলাম কালুসহ ১০-১২ জন। ঘটনার সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন সহযোগী অনি।
তবে ঘটনার পর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। সেই অনির খোঁজ করছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে একে-৪৭ গ্রুপের বস রুবেল। তার সহযোগী বোন জামাই সেন্টু, আফজাল, বিন্দু, শ্যামল, করিম ও জাহিদ। দীর্ঘদিন এলাকায় থাকে না রুবেল। কিন্তু গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডার তার নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, কয়েক বছর আগে একে-৪৭ অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন রুবেল। এর পর থেকে তাকে এলাকায় ‘একে-৪৭ রুবেল’ বলেই চেনে সবাই। তিনি সেভেন স্টার গ্রুপের হয়ে এলাকায় ত্রাস হয়ে ওঠেন। ওই গ্রুপের হয়ে কাজ করার সময় রুবেল অস্ত্রসহ আটক হন।
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ছোট থেকেই রুবেল, সুমন, সেন্টুসহ বাকিদের টিবি কলোনিতে বড় হতে দেখেছি। তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। কিন্তু এরা হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট ব্যবসা, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সেন্টুকে অস্ত্রসহ ধরিয়ে দেয় সুমন। দু-তিন দিন আগে সেন্টু জামিনে বেরিয়ে এলাকায় আসে। তার পরই এ হত্যাকাণ্ড। এতে তো বোঝা যায় সুমনের হত্যার পেছনে কারা দায়ী। আমরা এলাকায় শান্তিতে ব্যবসা করতে চাই। কারও রোষানলে পড়তে চাই না।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে নিহত সুমনের শ্বশুর মোহাম্মদ আক্তার শেখ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার আল্লাহ কীভাবে দুই সন্তান রেখে সুমনকে নিয়ে যেতে পারলেন। তার ছেলে-মেয়ে অনেক ছোট। মেয়ে তো বাবার মৃত্যুর বিষয়টি বোঝাও শেখেনি। আর ছেলে বাবার অসুস্থতার কথা শুনে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন নাতির সামনে কীভাবে সুমনের লাশ নিয়ে যাব? কী জবাব তাকে দেব?’ তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী রুবেল এলাকার সব নিয়ন্ত্রণ করছে। তার হাতে হাসপাতালের সব টেন্ডার জমা পড়ে। থানা পুলিশ তার কেনা। এর আগে দুলাভাই সেন্টুকে অস্ত্রসহ পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল সুমন। তার পর থেকে একে-৪৭ গ্রুপের সদস্যরা তার ওপর ক্ষিপ্ত। রুবেল বাহিনী কয়েকবার সুমনকে মারধর করে। তারা সম্প্রতি সুমনকে হত্যার হুমকি দেয়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্ধু গ্যাংয়ের এক সদস্য বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সুমনকে হত্যা করা হলো। ২৪ ঘণ্টা পার না হওয়ার আগেই তার দোকান সরিয়ে নিতে কমিশনারের ছেলে নয়ন ও রতন হুমকি দিয়েছে। নিহতের শ্যালক বাদশা বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। টিবি গেটে একটি জানাজা শেষে রংপুরের মিঠামইনের গ্রামের বাড়িতে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।
ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, সুমনের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয়দের নামে হত্যা মামলা করেছেন। এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের বিষয়ে কাজ চলছে।
গ্রামের বাড়িতে নির্বাক মা
মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, রংপুরের মিঠাপুকুরে সুমনের গ্রামের বাড়িতে চলছে কান্না। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাঁর নিহত হওয়ার খবরে হতবাক। শুক্রবার বিকেলে উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের শালাইপুর ডোবার পাড়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুমনের মা ঘরের বারান্দায় নির্বাক বসে আছেন। বোন ও প্রতিবেশীরা মরদেহ ঢাকা থেকে কখন আসবে– সে অপেক্ষায় আছেন।
সুমনের মা বলেন, ‘আর কয়েকদিন পর মোর ছইলটা বাড়িত আসিলো হয়। ফোন করি কইল, এবার সবাকে নিয়া বাড়িত ঈদ করিম। মোর বাবা আইসোছে; কিন্তু লাশ হয়ে। এই ভার কী করি সহ্য করিম।’
প্রতিবেশী রহিম মিয়া জানান, সুমনের বাবার নাম মাহফুজার রহমান। সুমন দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। নানাবাড়ি ঢাকায়। তাই ছোট থেকে নানাবাড়িতে থাকত। বিয়ে করেছে ঢাকাতেই। ইয়াস (১০) এবং সুমাইয়া (৭) নামে তাঁর ছেলে-মেয়ে রয়েছে।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হত য গ র প র সদস য ৪৭ গ র প র র পর থ ক ব যবস য় এল ক য় স মন র এল ক র স মনক সহয গ
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই হত্যাকাণ্ডের মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁওয়ে শহিদুল ইসলাম শহিদকে হত্যার মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। এ মামলায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ ২৩১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নুরুল হক গত বুধবার (৩০ জুলাই) আদালতের প্রসিকিউশন শাখায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।
শনিবার (২ আগস্ট) চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব আহমেদ অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।
আরো পড়ুন:
সিলেটে স্কুলছাত্র সুমেল হত্যা: ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড, ৭ জনের যাবজ্জীবন
চবি ছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
পুলিশ জানিয়েছে, গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলার সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা কোনো মামলায় চট্টগ্রামে প্রথম অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো।
২০২৪ সালের ৩ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় একাধিক পিস্তল, শটগানসহ ভারী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।
এর আগে নিউ মার্কেট মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে ষোলশহর মেয়র গলিতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বাসভবনে হামলা চালায়। এর পর বহদ্দারহাট মোড়-সংলগ্ন সাবেক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসভবনে হামলা হয়। ওই সময় গুলিবিদ্ধ হন অটোরিকশাচালক শহিদ। তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শহিদের ভাই শফিকুল ইসলাম চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন।
আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি আইনের ৩০২ ধারায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য অপর আসামিরা হলেন— চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন, সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, এম এ লতিফ, আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভী, মহিউদ্দিন বাচ্চু, আবদুচ ছালাম, দিদারুল আলম দিদার, এস এম আল মামুন ও নোমান আল মাহমুদ, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, চসিকের সাবেক কাউন্সিলর এসরারুল হক, নুর মোস্তফা টিনু, সলিমুল্লাহ বাচ্চু, জিয়াউল হক সুমন ও নুরুল আজিম রনিসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
আগামী ২৫ আগস্ট বাদীর উপস্থিতিতে অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগপত্রে ১২৮ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৮ জন সাধারণ মানুষ, ৯৯ জন পুলিশ ও ১ জন চিকিৎসক।
ঢাকা/রেজাউল/রফিক