ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে জুলাই গণহত্যার দায়ে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। গণহত্যার দায়ে সংগঠন হিসেবেও আওয়ামী লীগের বিচার চেয়েছে দলটি।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাংলামটরের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
গত বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড.
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এনসিপির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন, সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। তিনি একে ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ এবং ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, ১১ মার্চ এ প্রস্তাব ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসেছে।
এ পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করছে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যে আলোচনা করেছে, তা রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করছি। রাজনীতিবিদরাই রাজনীতি নির্ধারণ করবেন।
তিনি জানান, ১১ মার্চের বৈঠকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। সেখানে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিল। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য আমাদের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নাম, প্রতীক এবং আদর্শ– তিনটিই অপ্রাসঙ্গিক দাবি করে নাহিদ বলেন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, এজেন্সি থেকে কোনো ধরনের অপচেষ্টা চালানো হলেও, সাধারণ মানুষ, ছাত্র-নাগরিক দেড় দশক ধরে যারা নির্যাতিত-নিপীড়িত, বঞ্চিত, গুম-খুন, হত্যার শিকার তাদের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কেবল সরকার, বিদ্যমান রাজনৈতিক দল ও জনগণের। এখানে সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে মন্তব্য, পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত-প্রস্তাবনার এখতিয়ার নেই। এ ধরনের চেষ্টা যেন বাংলাদেশে না হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো রাজনৈতিকভাবেই হবে।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কি জুলাই গণহত্যার জন্য কোথাও অনুশোচনা করেছে? গণহত্যা স্বীকার করেছে? আগে গণহত্যার বিচার হতে হবে। দল হিসেবে বিচার হতে হবে। তার পর অন্য কোনো আলোচনা হলেও হতে পারে।’
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানান, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ চলমান থাকবে। সংবাদ সম্মেলনে মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা উপস্থিত ছিলেন।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে পুনর্বাসন প্রস্তাব
হাসনাত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে দাবি করেন, তিনিসহ আরও দু’জনের কাছে ১১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, তারা যেন আসন সমঝোতার বিনিময়ে প্রস্তাব মেনে নেন।
ফেসবুকে হাসনাত লিখেছেন, ‘আমাদের বলা হয়– ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা নাকি ভালো।’
আওয়ামী লীগ নিয়ে সপ্তাহ দুই ধরেই হাসনাত লিখছেন। ১২ মার্চ লেখেন, আওয়ামী লীগকে ফেরানোর পরিকল্পনা চলছে। ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ নামে নতুন একটি ‘ট্যাবলেট’ নিয়ে শিগগির হাজির হবে। ১৫ মার্চ হাসনাত লেখেন, ‘যে পথ দিয়ে আওয়ামী লীগ পালিয়েছে, ঠিক সে পথ দিয়েই আওয়ামী লীগকে ফেরানোর ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিনি ড. ইউনূসকে সম্বোধন করে লেখেন, ‘আওয়ামী লীগ ৫ আগস্টেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। উত্তরপাড়া ও ভারতের প্রেসক্রিপশনে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ওপেন করার চেষ্টা করে লাভ নেই।’ হাসনাত লেখেন, ‘আমাদের আরও বলা হয়– রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে– এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।’ এ প্রস্তাব তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করেন জানিয়ে হাসনাত লেখেন, অপর পক্ষ থেকে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ছাড়া ইনক্লুসিভ হবে না। তখন হাসনাতরা বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্পর্ক নেই। তিনি লিখেছেন, কথা কাটাকাটির পর বৈঠক অসমাপ্ত রেখেই চলে আসতে হয়। বৈঠকে আর কে কে উপস্থিত ছিলেন, তা স্পষ্ট করেননি হাসনাত।
তবে এনসিপি সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, আরেক মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ছিলেন।
হাসনাতের এ বক্তব্যের বিষয়ে সেনাবাহিনীর কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
অন্যান্য দল কী বলছে
হাসনাত অভিযোগ করেন, একাধিক রাজনৈতিক দল ক্যান্টনমেন্টের প্রস্তাবে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনে রাজি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সমকালকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের দায়িত্ব বিএনপি নেয়নি। বিএনপি ১৭ বছর রাজপথে ছিল, নিজেদের পুনর্বাসনই এখন বিএনপির কাজ।’
যদিও বিএনপি একাধিকবার দলীয়ভাবে জানিয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে তারা নয়। নেতারা বারবারই বলছেন, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে থাকবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেবে দেশের জনগণ। গতকালও দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন রেখে বলেন, যারা ছাত্র হত্যা করেনি, যারা অর্থ লোপাট করেনি, সৎ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির, তারা নেতৃত্বে এলে আওয়ামী লীগ কেন রাজনীতি করতে পারবে না?
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান শুক্রবার তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে লেখেন, আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন জনগণ গ্রহণ করবে না। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেন, আগে জুলাই হত্যার বিচার হতে হবে। আওয়ামী লীগ আমলে পাচার করা টাকা ফেরাতে হবে। এর পর দলটির বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগ হবে না
নতুন নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার গুঞ্জন নাকচ করেছেন দলটির আত্মগোপনে থাকা নেতারা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম সমকালকে বলেন, নতুন নেতৃত্বের প্রশ্নই আসে না। হাসনাত আবদুল্লাহকে যদি ১১ মার্চ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়, তাহলে এতদিন চুপ ছিল কেন?
সারাদেশে বিক্ষোভ
আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবিতে ছাত্রলীগকে গত ২২ অক্টোবর নিষিদ্ধ করা হয়। তারা আওয়ামী লীগের একই পরিণতি চান। এ দাবিতে বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল হয়। ছাত্রদের হলগুলো ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মিছিল শেষ হয়। এ ছাড়া গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এনস প ক য ন টনম ন ট গণহত য র র ফ ইন ড ১১ ম র চ প রস ত ব এনস প র এক ধ ক আম দ র এ প রস আওয় ম ব এনপ দলট র
এছাড়াও পড়ুন:
২ মে ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ, প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ৭ অপরাধ
‘গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের বিচার ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে’ আগামী ২ মে (শুক্রবার) রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করবে নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। রাজধানীর গুলিস্তানে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে এনসিপির ঢাকা মহানগর শাখার উদ্যোগে এই সমাবেশ হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের উদ্যোগে গঠিত দল এনসিপি।
সমাবেশ উপলক্ষে তৈরি করা প্রচারপত্রে আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলের সাতটি অপরাধের কথা উল্লেখ করেছে এনসিপি। এগুলো হলো ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ দমনের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ড; গুম, খুন ও ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহরণ; ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ; ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে চালানো হত্যাযজ্ঞ; লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার; ২০২১ সালে নরেন্দ্র মোদিবিরোধী আন্দোলনে চালানো হত্যাকাণ্ড এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় চালানো নজিরবিহীন গণহত্যা।
এরপর চারটি দাবিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রচারপত্রে। এগুলো হলো প্রতিটি অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্রাইব্যুনাল বা কমিশন গঠন করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচারের ব্যবস্থা; আগামী নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ প্রশ্নের মীমাংসা তথা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল; বিচার চলাকালে আওয়ামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা এবং ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার ও তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা।
দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, সমাবেশে প্রায় ২০ হাজার মানুষের জমায়েত হতে পারে। এই সমাবেশে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
দলগতভাবে আওয়ামী লীগের বিচার, দলটির নিবন্ধন বাতিল ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গত ২১ এপ্রিল থেকে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মশালমিছিল করছে এনসিপি। এর ধারাবাহিকতায় এবার কিছুটা বড় পরিসরে ঢাকা মহানগর শাখার ব্যানারে সমাবেশ হতে যাচ্ছে।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীন শিশির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগরের থানা পর্যায়ে কিছুদিন ধরে এনসিপির যে কর্মসূচিগুলো হচ্ছে, এগুলোরই চূড়ান্ত সমাবেশটা হবে আগামী ২ মে।