চ্যালেঞ্জ নিয়েই চালু হচ্ছে স্বপ্নের ফেরি
Published: 22nd, March 2025 GMT
সুযোগ থাকার পরও এতদিন কেন অপেক্ষা করতে হলো আমাদের– মনের মাঝে এমন এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জাহিদ হাসানের। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন নগরীর হালিশহরে। কিন্তু জন্মস্থান সন্দ্বীপে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন তিনি। যতবারই সন্দ্বীপ গেছেন, ততবারই ভোগান্তি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। টিকিটে ছিল দীর্ঘ লাইন। মাড়াতে হতো কাদামাটিও। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাঁর মতো সন্দ্বীপের চার লাখ মানুষ এ দুর্ভোগ থেকে অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। পূরণ হচ্ছে তাদের স্বপ্নও। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কাল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করছে তাদের স্বপ্নের ফেরি। সোমবার চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌরুটে এ ফেরি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের সাতজন উপদেষ্টা আসার কথা রয়েছে সন্দ্বীপে। ফেরি চালুর এ কার্যক্রমে তাই দারুণ উচ্ছ্বসিত দ্বীপের মানুষ। পাশাপাশি আছে শঙ্কাও। এই সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে কতটা টেকসই হয়, উত্তাল বর্ষায় এটা কতটা সেবা দিতে পারবে– এসব নিয়ে তাদের মনে আছে প্রশ্নও।
জানতে চাইলে ফেরি কার্যক্রম নিয়ে নেপথ্যে কাজ করা বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল এ ফেরি। এর আগে কুমিরা-গুপ্তছড়াসহ সব নৌঘাট উন্মুক্ত করেছেন তিনি। এসব উদ্যোগে আমরা তাঁকে সহযোগিতা করেছি। এই রুটে কোন ধরনের ঝুঁকি রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখতেই পুরোনো ফেরি কপোতাক্ষ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ সার্ভিস চলছে পাঁচ দিন ধরে। তাতে কোনো অসুবিধা না হওয়ায় আগামীকাল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে ফেরির।’ তবে যে ফেরি দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন হচ্ছে, সেটি বর্ষাকালে চলাচল করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় সমাজকর্মী কবির সোহেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ মনে করছে বর্ষাকালে ঝুঁকি থাকবে এ ফেরিতে। তাই বিকল্প ভাবনাও আছে তাদের পরিকল্পনায়। আগামীকাল সেটিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন।’ এর আগে ফেরির কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে অবশ্য কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরে এ রুটের জন্য আসবে নতুন এক সি ট্রাক। তখন সেটি দিয়েই চলবে ফেরির কার্যক্রম।
লক্ষ্যে অটল ছিলেন ফাওজুল কবির
সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ রুটে ফেরি চলাচল কার্যক্রম শুরু করতে সন্দ্বীপের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতাও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। তিন বছর ধরে বারবার সাইট নির্ধারণ ও পরিবর্তন, ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই এসে গেছে ৫ আগস্ট। এরপর তিনি চলে যান আত্মগোপনে। দৃশ্যপটে আসে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারেরই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন ফাওজুল কবির খান। তিনি সন্দ্বীপেরই সন্তান। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পরই সন্দ্বীপবাসীর দুর্দশা দূর করতে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেন তিনি। বারবার পরিদর্শন করেন প্রকল্প এলাকা। লক্ষ্যে অটল থাকাতে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে পেরেছেন ফেরি সার্ভিস। কাল সেটি অন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন ফাওজুল কবির।
বাধা ছিল বাঁকে বাঁকে
আমাদের সন্দ্বীপ প্রতিনিধি সাজিদ মোহন জানান, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাক্কলন নির্ধারণ করতে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে গঠিত বিশেষ কমিটি তিনটি রুটের ঘাট পরিদর্শন শেষে ফেরি চলাচলের জন্য গাছুয়া (সন্দ্বীপ)-বাঁকখালী (সীতাকুণ্ড) রুট চূড়ান্ত করে। কমিটি আশ্বাস দেয় ওই বছরের শেষে কাজ শুরু করতে পারলে ২০২৩ সালের শুকনো মৌসুমে গাছুয়া-বাঁকখালী নৌরুটে ফেরি চালু করা যাবে। যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ২০২৩ সালে গাছুয়ার আমির মোহাম্মদ নৌঘাটে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করে। অথচ চালু হয়নি ফেরি। এরপর কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। এ লক্ষ্যে গুপ্তছড়া সেতুর পশ্চিম পাশে নতুন খালের মুখে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার ফেরি সার্ভিস চালুর তোড়জোড় শুরু হয়। বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগে গঠিত কমিটি ২৯ আগস্ট সাইট নির্ধারণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এলাকা পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে ফেরি চলাচলের নির্দিষ্ট কোনো রুটের কথা জানাতে পারেনি তারা।
চ্যালেঞ্জ আছে এখনও
বাঁশবাড়িয়া-গুপ্তছড়া নৌপথে ফেরি সার্ভিস চালু করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে– এমন প্রশ্নের জবাবে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে এখানে সমুদ্র উত্তাল থাকে। জোয়ার-ভাটার তারতম্য ৩ থেকে ৪ মিটার এমন জায়গায় দেশে কোথাও ফেরি নেই। সন্দ্বীপে প্রথমবারের মতো হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য পরীক্ষামূলক বিষয়। এখানে অনেক বড় চ্যালেঞ্জও আছে। আশা করি, সব জয় করতে পারব আমরা।’ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ এর আগে বলেন, ‘আমাদের কাছে ছয়টি ফেরি আছে, সেখান থেকে একটি এখানে চলবে। মার্চের পর এখানে এই ফেরিগুলো চলবে না। সার্টিফাই করা ছয়টি নতুন সি ট্রাক বানানো হচ্ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সেগুলো পেয়ে গেলে ১টি এ রুটের জন্য দেওয়া হবে।’
নির্ধারণ হয়েছে ভাড়াও
এক টন পর্যন্ত পণ্যবাহী যানবাহন বড় ট্রাক/ট্যাঙ্ক লরি কাভার্ডভ্যান (৮ টনের অধিক ১১ টন পর্যন্ত) ১৩০০ টাকা, ছোট ট্রাক/কাভার্ডভ্যান/লরি (১ টনের অধিক ৩ টন পর্যন্ত) ১৫০০ টাকা, ট্রাক/ট্যাঙ্ক লরি/ কাভার্ডভ্যান (৩ টনের অধিক ৫ পর্যন্ত) ১৬০০ টাকা, ৫ টনের অধিক ৮ টন পর্যন্ত ২০০০ টাকা, ৮ টনের অধিক ১১ টন পর্যন্ত ২৭০০ টাকা, দশ চাকা বিশিষ্ট সাধারণ পণ্যবাহী যানবাহনের ক্ষেত্রে (গ্যাস, বিস্ফোরক দ্রব্য, বাহিত ও নন স্ট্যান্ডার্ড যানবাহন ব্যতীত) গাড়ির বডির ওজন সহ ৩০ (ত্রিশ) টন পর্যন্ত হলে নির্দেশিত হারে ভাড়া আদায়যোগ্য হবে ৫৭০০ টাকা। এ ছাড়া যেসব ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান/ট্যাঙ্ক লরির ধারণক্ষমতা ৩-৮ টন অথচ সাইজে বড় বাস/কোচের সমান ২৭০০ টাকা, মিনিবাস/কোস্টার (২৫ ফুটের ঊর্ধ্বে নহে) ১৭৫০ টাকা, মাঝারি মাপের বাস/কোচ (৩৫ ফুটের ঊর্ধ্বে নহে) ২৪৫০ টাকা, বড় বাস/কোচ (৩৫ ফুটের ঊর্ধ্বে) ২৬৫০ টাকা, মাইক্রো বাস / অ্যাম্বুলেন্স/ বড় টেম্পু/ হিউম্যান হলারজাতীয় যানবাহন ১৪০০ টাকা, স্টেশন ওয়াগন/ল্যান্ডক্রুজার/স্কাউটজাতীয় গাড়ি/বড় জিপ/প্রাডো/ নিশান/পাজেরো/ প্যাট্রলজাতীয় লাক্রারি জিপ জাতীয় যানবাহন ১৩০০ টাকা, কার/টেম্পু ট্রেইলার পৃথকভাবে অথবা ট্রাকের সাথে এ ধরনের যানবাহন ৭৫০ টাকা, মোটরসাইকেল ১৫০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা/ ভ্যান/রিকশা ৪০০ টাকা, বাইসাইকেল ৭৫ টাকা, ডিলাক্স/উচ্চ শ্রেণির যাত্রী টিকিট (জনপ্রতি) ১০০ টাকা ও সুলভ শ্রেণীর যাত্রী টিকিট (জনপ্রতি) ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ প তছড় উপদ ষ ট র জন য আম দ র আগস ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দৌলতদিয়ায় ফেরির ধাক্কায় ভেঙে গেছে পন্টুনের কবজা, যানবাহন পারাপার ব্যাহত
তীব্র স্রোতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেরির ধাক্কায় ভেঙে গেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ফেরিঘাটের ৩ নম্বর পন্টুনের কবজা। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ঘাটটি। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে দৌলতদিয়ায় শুধু ৪ নম্বর ঘাট চালু আছে। এতে যানবাহন পারাপারে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে এবং সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজটের।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয় ও ঘাট-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বিকেল থেকে দৌলতদিয়া প্রান্তে পদ্মায় তীব্র স্রোত দেখা দেয়। সন্ধ্যার পর এর তীব্রতা আরও বাড়ে। রাত ১১টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে আসা রো রো ফেরি শাহ পরান দৌলতদিয়ায় পৌঁছে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারায় ফেরিটি প্রচণ্ড বেগে ৩ নম্বর ঘাটের পন্টুনে ধাক্কা দিলে কবজা ভেঙে যায়। এর পর থেকে ঘাটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এর আগে ২৩ আগস্ট থেকে তীব্র স্রোতের কারণে দৌলতদিয়ার ৭ নম্বর ঘাটও বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে চারটি ঘাটের মধ্যে কেবল ৪ নম্বর ঘাট সচল রয়েছে। সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাত্রীবাহী পরিবহন এবং জরুরি কিছু পণ্যবাহী গাড়ি পার করা হচ্ছে। তবে সাধারণ পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার বন্ধ রাখা হয়েছে।
দৌলতদিয়া জিরো পয়েন্টে (৩ নম্বর ঘাট) দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিসির নিরাপত্তা পরিদর্শক ইদ্রিস আলী ভূঁইয়া বলেন, গতকাল রাতে ফেরি শাহ পরান ঘাটে ভেড়ার সময় প্রচণ্ড ধাক্কায় পন্টুনের কবজা ভেঙে যায়। তখন থেকে ঘাটটি বন্ধ রাখা হয়।
এদিকে সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাসের প্রতিবাদে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় কয়েক দিন ধরে সড়ক অবরোধ করা হচ্ছে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা থেকে অনেক গাড়ি দৌলতদিয়া ঘাট দিয়ে পারাপার হচ্ছে। এ কারণেও দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় গাড়ির চাপ পড়ছে। আজ মঙ্গলবার সকালে দৌলতদিয়া প্রান্তে প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা গাড়ির লাইন তৈরি হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির লাইন আরও লম্বা হচ্ছে। দীর্ঘ সময় আটকে থাকায় চালকসহ যাত্রীদের বাড়তি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
সৌহার্দ্য পরিবহনের ঘাট তত্ত্বাবধায়ক মনির হোসেন বলেন, ‘শুধু একটি ঘাট চালু থাকায় যানবাহন স্বাভাবিকভাবে পার হতে পারছে না। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা ঢাকামুখী গাড়ি আটকে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়েছে। আমাদের চারটি যাত্রীবাহী বাস চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আটকে আছে। বাসগুলো ফেরিতে উঠতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগছে।’
বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, তীব্র স্রোতের কারণে ফেরি পারাপারে অনেক বেশি সময় লাগছে। গতকাল রাত পৌনে ১২টার দিকে ৩ নম্বর ঘাটের পন্টুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন শুধু ৪ নম্বর ঘাট চালু রয়েছে। যাত্রীবাহী বাস ও কিছু জরুরি গাড়ি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পার করা হচ্ছে। সাধারণ পণ্যবাহী গাড়ি আপাতত পার করা যাচ্ছে না।