সুযোগ থাকার পরও এতদিন কেন অপেক্ষা করতে হলো আমাদের– মনের মাঝে এমন এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জাহিদ হাসানের। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন নগরীর হালিশহরে। কিন্তু জন্মস্থান সন্দ্বীপে নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন তিনি। যতবারই সন্দ্বীপ গেছেন, ততবারই ভোগান্তি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। টিকিটে ছিল দীর্ঘ লাইন। মাড়াতে হতো কাদামাটিও। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তাঁর মতো সন্দ্বীপের চার লাখ মানুষ এ দুর্ভোগ থেকে অবশেষে মুক্তি পেতে যাচ্ছেন। পূরণ হচ্ছে তাদের স্বপ্নও। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কাল আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করছে তাদের স্বপ্নের ফেরি। সোমবার চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌরুটে এ ফেরি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। এ উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের সাতজন উপদেষ্টা আসার কথা রয়েছে সন্দ্বীপে। ফেরি চালুর এ কার্যক্রমে তাই দারুণ উচ্ছ্বসিত দ্বীপের মানুষ। পাশাপাশি আছে শঙ্কাও। এই সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে কতটা টেকসই হয়, উত্তাল বর্ষায় এটা কতটা সেবা দিতে পারবে– এসব নিয়ে তাদের মনে আছে প্রশ্নও।
জানতে চাইলে ফেরি কার্যক্রম নিয়ে নেপথ্যে কাজ করা বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, ‘বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফসল এ ফেরি। এর আগে কুমিরা-গুপ্তছড়াসহ সব নৌঘাট উন্মুক্ত করেছেন তিনি। এসব উদ্যোগে আমরা তাঁকে সহযোগিতা করেছি। এই রুটে কোন ধরনের ঝুঁকি রয়েছে, সেটি খতিয়ে দেখতেই পুরোনো ফেরি কপোতাক্ষ দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ সার্ভিস চলছে পাঁচ দিন ধরে। তাতে কোনো অসুবিধা না হওয়ায় আগামীকাল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে ফেরির।’ তবে যে ফেরি দিয়ে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন হচ্ছে, সেটি বর্ষাকালে চলাচল করাটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় সমাজকর্মী কবির সোহেল বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী হচ্ছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ মনে করছে বর্ষাকালে ঝুঁকি থাকবে এ ফেরিতে। তাই বিকল্প ভাবনাও আছে তাদের পরিকল্পনায়। আগামীকাল সেটিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন।’ এর আগে ফেরির কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে অবশ্য কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরে এ রুটের জন্য আসবে নতুন এক সি ট্রাক। তখন সেটি দিয়েই চলবে ফেরির কার্যক্রম।
লক্ষ্যে অটল ছিলেন ফাওজুল কবির
সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ রুটে ফেরি চলাচল কার্যক্রম শুরু করতে সন্দ্বীপের সাবেক এমপি মাহফুজুর রহমান মিতাও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। তিন বছর ধরে বারবার সাইট নির্ধারণ ও পরিবর্তন, ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সংযোগ সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি এবং কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেই এসে গেছে ৫ আগস্ট। এরপর তিনি চলে যান আত্মগোপনে। দৃশ্যপটে আসে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারেরই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন  ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে আছেন ফাওজুল কবির খান। তিনি সন্দ্বীপেরই সন্তান। তাই দায়িত্ব নেওয়ার পরই সন্দ্বীপবাসীর দুর্দশা দূর করতে আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নেন তিনি। বারবার পরিদর্শন করেন প্রকল্প এলাকা। লক্ষ্যে অটল থাকাতে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করতে পেরেছেন ফেরি সার্ভিস। কাল সেটি অন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন ফাওজুল কবির। 
বাধা ছিল বাঁকে বাঁকে
আমাদের সন্দ্বীপ প্রতিনিধি সাজিদ মোহন জানান, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাক্কলন নির্ধারণ করতে বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে গঠিত বিশেষ কমিটি তিনটি রুটের ঘাট পরিদর্শন শেষে ফেরি চলাচলের জন্য গাছুয়া (সন্দ্বীপ)-বাঁকখালী (সীতাকুণ্ড) রুট চূড়ান্ত করে। কমিটি আশ্বাস দেয় ওই বছরের শেষে কাজ শুরু করতে পারলে ২০২৩ সালের শুকনো মৌসুমে গাছুয়া-বাঁকখালী নৌরুটে ফেরি চালু করা যাবে। যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য ২০২৩ সালে গাছুয়ার আমির মোহাম্মদ নৌঘাটে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করে। অথচ চালু হয়নি ফেরি। এরপর কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। এ লক্ষ্যে গুপ্তছড়া সেতুর পশ্চিম পাশে নতুন খালের মুখে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আবার ফেরি সার্ভিস চালুর তোড়জোড় শুরু হয়। বিআইডব্লিউটিএর উদ্যোগে গঠিত কমিটি ২৯ আগস্ট সাইট নির্ধারণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য এলাকা পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে ফেরি চলাচলের নির্দিষ্ট কোনো রুটের কথা জানাতে পারেনি তারা।
চ্যালেঞ্জ আছে এখনও
বাঁশবাড়িয়া-গুপ্তছড়া নৌপথে ফেরি সার্ভিস চালু করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ আছে– এমন প্রশ্নের জবাবে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে এখানে সমুদ্র উত্তাল থাকে। জোয়ার-ভাটার তারতম্য ৩ থেকে ৪ মিটার এমন জায়গায় দেশে কোথাও ফেরি নেই। সন্দ্বীপে প্রথমবারের মতো হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য পরীক্ষামূলক বিষয়। এখানে অনেক বড় চ্যালেঞ্জও আছে। আশা করি, সব জয় করতে পারব আমরা।’ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ এর আগে বলেন, ‘আমাদের কাছে ছয়টি ফেরি আছে, সেখান থেকে একটি এখানে চলবে। মার্চের পর এখানে এই ফেরিগুলো চলবে না। সার্টিফাই করা ছয়টি নতুন সি ট্রাক বানানো হচ্ছে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে সেগুলো পেয়ে গেলে ১টি এ রুটের জন্য দেওয়া হবে।’
নির্ধারণ হয়েছে ভাড়াও
এক টন পর্যন্ত পণ্যবাহী যানবাহন বড় ট্রাক/ট্যাঙ্ক লরি কাভার্ডভ্যান (৮ টনের অধিক ১১ টন পর্যন্ত) ১৩০০ টাকা, ছোট ট্রাক/কাভার্ডভ্যান/লরি (১ টনের অধিক ৩ টন পর্যন্ত) ১৫০০ টাকা,  ট্রাক/ট্যাঙ্ক লরি/ কাভার্ডভ্যান (৩ টনের অধিক ৫ পর্যন্ত) ১৬০০ টাকা, ৫ টনের অধিক ৮ টন পর্যন্ত ২০০০ টাকা, ৮ টনের অধিক ১১ টন পর্যন্ত ২৭০০ টাকা, দশ চাকা বিশিষ্ট সাধারণ পণ্যবাহী যানবাহনের ক্ষেত্রে (গ্যাস, বিস্ফোরক দ্রব্য, বাহিত ও নন স্ট্যান্ডার্ড যানবাহন ব্যতীত) গাড়ির বডির ওজন সহ ৩০ (ত্রিশ) টন পর্যন্ত হলে নির্দেশিত হারে ভাড়া আদায়যোগ্য হবে ৫৭০০ টাকা। এ ছাড়া যেসব ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান/ট্যাঙ্ক লরির ধারণক্ষমতা ৩-৮ টন অথচ সাইজে বড় বাস/কোচের সমান ২৭০০ টাকা,  মিনিবাস/কোস্টার (২৫ ফুটের ঊর্ধ্বে নহে) ১৭৫০ টাকা, মাঝারি মাপের বাস/কোচ (৩৫ ফুটের ঊর্ধ্বে নহে) ২৪৫০ টাকা, বড় বাস/কোচ (৩৫ ফুটের ঊর্ধ্বে) ২৬৫০ টাকা, মাইক্রো বাস / অ্যাম্বুলেন্স/ বড় টেম্পু/ হিউম্যান হলারজাতীয় যানবাহন ১৪০০ টাকা, স্টেশন ওয়াগন/ল্যান্ডক্রুজার/স্কাউটজাতীয় গাড়ি/বড় জিপ/প্রাডো/ নিশান/পাজেরো/ প্যাট্রলজাতীয় লাক্রারি জিপ জাতীয় যানবাহন ১৩০০ টাকা, কার/টেম্পু ট্রেইলার পৃথকভাবে অথবা ট্রাকের সাথে এ ধরনের যানবাহন ৭৫০ টাকা, মোটরসাইকেল ১৫০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা/ ভ্যান/রিকশা ৪০০ টাকা, বাইসাইকেল ৭৫ টাকা,  ডিলাক্স/উচ্চ শ্রেণির যাত্রী টিকিট (জনপ্রতি) ১০০ টাকা ও সুলভ শ্রেণীর যাত্রী টিকিট (জনপ্রতি) ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ প তছড় উপদ ষ ট র জন য আম দ র আগস ট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজধানীমুখী মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট

ঈদের ছুটি শেষে রাজধানীমুখী মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট। আজ শুক্রবার সকাল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা—রাজবাড়ী, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ থেকে আসা কর্মজীবীরা বিভিন্ন যানবাহনে ঘাটে পৌঁছে লঞ্চে নদী পার হচ্ছেন। মাত্র তিন থেকে চার মিনিটে প্রতিটি লঞ্চ যাত্রী বোঝাই করে পাটুরিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে।

রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি থেকে আসা পোশাকশ্রমিক মো. সাব্বির হোসেন হাত ধরে নববধূর সঙ্গে লঞ্চে উঠছিলেন। তিনি জানান, ঢাকার হেমায়েতপুরের একটি পোশাক কারখানায় দুজনেই কাজ করেন। ঈদের ছুটিতে বাড়ি এসে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর এটাই তাঁদের একসঙ্গে কর্মস্থলে ফেরার প্রথম যাত্রা।

সাব্বির বলেন, বালিয়াকান্দি থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রাজবাড়ী হয়ে দৌলতদিয়ায় এসেছেন। রাস্তায় তেমন ভোগান্তি না থাকলেও লঞ্চঘাটে এসে ভিড়ে পড়েছেন। শনিবার থেকে তাঁদের কারখানা খুলছে, তাই আজই রওনা হয়েছেন। ভিড়ের মধ্যে যাতে কেউ হারিয়ে না যায়, সে জন্য এক হাতে লাগেজ ও আরেক হাতে নববধূর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন।

রাজবাড়ীর কালুখালী থেকে আসা আরেক পোশাকশ্রমিক মিম আক্তার বলেন, তিনি সাভারের একটি কারখানায় কাজ করেন। ছুটিতে বাড়ি এসে ঈদ করেছেন। শনিবার কারখানা খুলবে—জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাগনেকে সঙ্গে নিয়ে আজই রওনা হয়েছি। দেরি করলে ঝামেলা হতে পারে।’

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত দৌলতদিয়া ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, কাঠের সেতু পেরিয়ে সারিবদ্ধভাবে যাত্রীরা পন্টুনে দাঁড়াচ্ছেন। টিকিটকর্মীরা সেতুতে উঠে টিকিট দিচ্ছেন। প্রতিটি লঞ্চ কয়েক মিনিটেই যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে। ঘাটে আনসার, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও বিআইডব্লিউটিএর সদস্যদের সহায়তায় ভিড় সামলানো হচ্ছে।

দৌলতদিয়া নৌ ফাঁড়ির পুলিশ সদস্য মাসুদ হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার ভিড় কম ছিল, তবে আজ শুক্রবার সকাল থেকে চাপ বাড়ছে। শনিবার থেকে অফিস ও কারখানা খোলার কারণে অনেকে আজই ফিরছেন।

ঘাট ইজারাদারের প্রতিনিধি আবদুল আউয়াল জানান, বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রী চলাচল শুরু হলেও আজ সকাল থেকে ঘাটে ভিড় বেড়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়ছে। এই চাপ শনিবার পর্যন্ত থাকতে পারে।

বিআইডব্লিউটিএর আরিচা কার্যালয়ের টার্মিনাল সুপারভাইজার মো. শিমুল হোসেন বলেন, যাত্রীদের নির্বিঘ্ন পারাপারের জন্য দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে ২০টি লঞ্চের মধ্যে ১৮টি চলাচল করছে। অতিরিক্ত চাপ পড়লে বাকি দুটি লঞ্চও চালু করা হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • যমুনা সেতুর যানজট এড়াতে কাজীরহাট-আরিচা নৌপথে যানবাহনের চাপ
  • দ্বিতীয় ট্রিপেই মেঘনায় ডুবল বালুবাহী বাল্কহেড
  • নৌযানের অভাবে নদী তীরে ঢাকামুখী যাত্রীদের অপেক্ষা
  • ভোলা লঞ্চঘাটে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়ে বৈধ নৌযান–সংকট, ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল মেঘনা পাড়ি
  • রাজধানীমুখী মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট