বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গণের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব, সঙ্গীতজ্ঞ ও ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্জীদা খাতুন মারা গেছেন। মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল সমকালের অনলাইনে সন্জীদা খাতুনকে নিয়ে লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান ও শামসুজ্জামান খান। লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।-
এক আলোকিত বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে সকল মানুষের অন্তরে সঙ্গীত-সাহিত্য-শিল্পরুচির আলোকশিখা প্রজ্বালনের সাধনায় নিরন্তর ব্রতী রয়েছেন আপনি। ব্যক্তিগত শৈল্পিক সিদ্ধি অর্জনে গভীর অভিনিবেশে নিমগ্ন থেকেও সমাজের মুক্তি চেতনার দায় প্রতিনিয়ত তাড়িত করেছে আপনাকে। বাইরের দিক থেকে প্রত্যক্ষ প্রেরণায় ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সংগঠক, পরিসংখ্যানবিদ, দার্শনিক পিতা, রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য এবং নজরুলের স্নেহধন্য, কাজী মোতাহার হোসেন। অন্তরের গহিনে আরেক প্রেরণাদাত্রী ছিলেন মুক্তমনা মাতা সাজেদা বেগম, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে যিনি অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন রাজপথে, কন্যার সঙ্গে একই কাতারে। আর জীবনব্যাপী যে মাভৈঃবাণী বুকে নিয়ে বিরুদ্ধ স্রোতের অভিযাত্রী হয়েছেন আপনি সেই সুর-ছন্দ-কথা অন্তরে গেঁথে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'দেশকে আপনার জ্ঞানে বুদ্ধিতে প্রেমে কর্মে সৃষ্টি' করতে পারলেই প্রতিভাত হতে পারে 'স্বদেশ', রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধির সার্থক প্রকাশ আমরা দেখি আপনার মধ্যে। আপনি সন্জীদা খাতুন জাতির সৃজনশক্তির মেধাবী প্রতিভূ, বাঙালি সংস্কৃতি ভুবনের অনন্য ব্যক্তিত্ব, কতভাবেই না ঋদ্ধ করে চলেছেন বাঙালির জীবন-সাধনা।
কৈশোর-উত্তীর্ণ কাল থেকে শুরু হয়েছে আপনার মুক্তি অভিযাত্রা। সাতচল্লিশের দেশভাগে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলায়, তা পীড়িত করেছিল আপনার কিশোরী মনকে। ভাষা আন্দোলনকালে নিজ কর্তব্য নির্ধারণে আপনার মধ্যে তাই কোনো দ্বিধা ছিল না। রাজপথের সংগ্রামের পাশাপাশি সংগ্রামী মানুষদের সঙ্গে আপনার এমন এক আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে, যা জীবনব্যাপী লালন করেছেন আপনি। পাকিস্তানি আমলের বিপুল বাধানিষেধ উপেক্ষা করে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার আপনাকে আরেক বিরল অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করেছিল।
অধ্যয়নের পাশাপাশি কণ্ঠে গান তুলে নিয়েছিলেন আপনি আত্যন্তিক ভেতর প্রেরণায়, সে প্রয়াস শান্তিনিকেতনে পেয়েছিল গভীরতর আত্মপ্রকাশ। দেশে ফিরে অধ্যাপনা হয়েছিল আপনার জীবিকার অবলম্বন এবং গান হয়ে উঠল প্রাণের বাঙ্ময় প্রকাশ। সাহিত্য ও সঙ্গীতের অধ্যয়ন ও অনুশীলন, সেইসঙ্গে বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সংযোগ আপনার ব্যক্তিত্বের গড়নে যে বিশিষ্টতা যুক্ত করেছিল, তার সার্থক প্রকাশ ঘটে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীকে ঘিরে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জাগরণে। শতবার্ষিকী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানমালা হয়ে পড়ে সাংস্কৃতিক জাগরণ চেতনার এক নব্য প্রকাশ এবং তার মধ্যমণি হয়ে উঠলেন আপনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠা পায় 'ছায়ানট' সংগঠন, সঙ্গীতে দীক্ষাদানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় সুরস্পর্শে জাতীয় সাংস্কৃতিক জাগৃতির কাঙ্ক্ষিত প্রয়াস। 'ছায়ানট' হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলায় আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশের কেন্দ্র, আমাদের সংস্কৃতি ও সঙ্গীতচর্চার ব্যতিক্রমী পীঠস্থান। সঙ্গীত শিক্ষাদানে নিষ্ঠা, দক্ষতা, আকুলতা নিয়ে আপনি ও সতীর্থমণ্ডলী বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সুরচর্চায় নিবেদিত নবীন-নবীনাদের বিশাল গোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হন। 'ছায়ানটে'র উদ্যোগে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষবরণের প্রভাতি অনুষ্ঠানের সূচনা সামন্তবাদী পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক অমানিশা ঘুচিয়ে এক নতুন প্রভাতের আবাহন ঘটাল, যা উদ্বেলিত ও আলোড়িত করল পূর্ব বাংলার নবজাগ্রত বাঙালি সমাজকে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক গণসংগ্রামের সমান্তরালে, বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে, পূর্ব বাংলার বাঙালি পৌঁছে গেল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এবং কণ্ঠে গান নিয়ে আপনি এবং আপনার দীক্ষাপ্রাপ্ত সঙ্গীত দল ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই সংগ্রামে।
স্বাধীন বাংলাদেশের পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর যাত্রাপথে নানা বাধাবিঘ্ন-বঞ্চনা উপেক্ষা করে আপনি সঙ্গীতের মাধ্যমে চিত্তের জাগরণ প্রয়াসে কেবল অটল ও একাগ্র থাকেননি, আরও কতভাবেই না সৃষ্টিশীল কাজের অনন্য সব উদাহরণ তৈরি করে বিস্তার ঘটিয়েছেন সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিসরের। অধ্যাপনা ও অধ্যয়নের যুগল-সাধনায় আপনি উচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ বিশ্নেষণে জুগিয়েছেন নতুন মাত্রা, ধ্বনি ও কবিতার সম্মিলন বিচারে আপনার উপলব্ধি সৃষ্টিরস অনুধাবনে নববিস্তার ঘটিয়েছে। আপনার রচনাদি বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে কীর্তিত হয়েছে। সেইসঙ্গে চলেছে সঙ্গীতের দীক্ষাদানে আপনার নিরলস সাধনা, 'ছায়ানটে'র বৃত্ত ছাপিয়ে যা দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে 'জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ'-এর সুবাদে, আপনি ছুটে চলেছেন দেশব্যাপী চারণের মতো সঙ্গীতসুধারস বিতরণের ব্রত নিয়ে।
সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে বহমান আপনার কর্মময় জীবন জাতির সামনে অনন্য উদাহরণ মেলে ধরেছে। নিজেকে পরমভাবে উৎসর্গ করেছেন সুরস্পর্শে মানুষের অন্তর আলোকিত করবার কাজে। আপনার সেই সঙ্গীত-সাধনা স্নিগ্ধ ও গভীর, কোমল ও কঠোর; সর্বোপরি তা নিবেদিত মানবের কল্যাণে, দেশের হিতসাধনে। এমন ব্যক্তিত্বের ছায়াতলে সমবেত আমরা সবাই অন্তরের নিবিড়তম শ্রদ্ধার অঞ্জলি নিবেদন করি আপনার প্রতি, দেশজুড়ে সঙ্গীত-সংস্কৃতির বিস্তারে আপনার কর্মধারায় স্নাত জাতির পক্ষ থেকে পঁচাশিতম জন্মবার্ষিকীতে প্রদান করি ভালোবাসার অর্ঘ্য। আপনি বাঙালি সংস্কৃতির সম্পদ, শিল্পের সুষমা ও শক্তির প্রকাশক, সঙ্গীতে নিহিত সর্বজনীন কল্যাণবোধ আপনি সবার হৃদয়ে সঞ্চারিত করে চলেছেন।
আপনার মঙ্গল হোক, আপনি শতায়ু হোন, আপনি সুরের স্পর্শে, সংস্কৃতি শক্তিতে, মানবিকতার প্রত্যয়ে যে স্বদেশ মূর্ত করে তুলেছেন, তা জাগ্রত হোক সর্বজনের হৃদয়ে। পঁচাশিতম জন্মবর্ষপূর্তিতে আপনার কাছ থেকে নতুনভাবে দীক্ষা নিয়ে বলবান হবে আলোর পথে আমাদের অভিযাত্রা। সেই যাত্রাপথের আনন্দগান আমরা শুনি আপনার কণ্ঠে, আপনাকে পাই অপরিমেয় অব্যাহত প্রেরণাদাত্রী হিসেবে, আপনার প্রতি রইল আমাদের অশেষ শ্রদ্ধা ও বিনম্র অভিবাদন।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ য় নট আপন র ম আপন র ক স পর শ ন আপন
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনে জোট গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ হেফাজত আমিরের
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’–এ লিখিত বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এ কথা বলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজত আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থ থাকায় তিনি কথা বলেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হক আজিজ।
ইসলামের মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত আমির বলেন, সহিহ আকিদার সব ইসলামি দলকে এক হওয়ার জন্য আগেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, একদিকে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বহু রকম চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতার অখণ্ডতার জন্য এবং ধর্মীয় কৃষ্টির জন্য এক অশনিসংকেত। এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিল আহমদ কুরাইশী। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে কালো তুফান দেখা যাচ্ছে। কালো তুফানের সঙ্গে মোলাকাত নয়, মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে ওলামাদের নেতৃত্ব কবুল করতে হবে। তখনই তুফানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী আমলে পাখা দিয়ে নৌকাকে বাতাস করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। জুলাই আন্দোলন ছিল ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। সেই পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ইসলামের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করলে হাসিনার মতো পরিণতি হবে।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আলেম এবং ওলামারা।
১৫ দফা প্রস্তাবনা
সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। প্রস্তাবনা পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া।
১৫ দফার মধ্যে আছে—ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বিতর্কিত নারী কমিশনের সুপারিশ বাতিল ও শরিয়ার সীমারেখার আলোকে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।